রক্ষক যেখানে ভক্ষক

  • কাজল সরকার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, হবিগঞ্জ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

গাছ নিধন চলছেই/ছবি: বার্তা২৪.কম

গাছ নিধন চলছেই/ছবি: বার্তা২৪.কম

সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনভূমি রেমা-কালেঙ্গা। এটি একটি শুকনো ও চিরহরিৎ বন। ১৭৯৫.৫৪ হেক্টর আয়তনের এই বনভূমিটি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত। মাত্র ২৪ বছরে এই বনভূমি থেকে উজার হয়েছে মহামূল্যবান সব গাছ।

অভিযোগ রয়েছে, বন বিভাগ, পরিচালনা কমিটি এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাই মূলত রেমা-কালেঙ্গা ধ্বংসের পেছনে দায়ী। তাদের সহযোগিতায়ই বছরের পর বছর ধরে প্রকাশ্যে চলছে গাছ পাচারের মহোৎসব।

বিজ্ঞাপন

তবে গাছ পাচারের ইস্যুতে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বক্তব্য ‘আমি এখানে নতুন’। গাছ পাচার রোধে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

বনের মূল্যবান গাছ উজাড় হয়ে যাচ্ছে

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৮২ সালে বনটিকে অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণার পর ১৯৯৬ সালে সম্প্রসারিত করা হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় গাছ কাটা। এক সময় এই বনে ৫০০ প্রজাতির গাছ থাকলেও অব্যাহতভাবে নিধনের কারণে এখন অনেক প্রজাতির গাছই বন থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মূলত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গাছ কাটা হয়েছে গেল ২৪ বছর ধরে। নুহ বাহিনীর প্রধান নুহ, হোসেন বাহিনীর প্রধান হোসেন ও মনা মিয়াসহ স্থানীয় একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি এই চক্রের নিয়ন্ত্রণ করে। বন সম্প্রসারণের পর থেকেই গাছ পাচারকারীদের সহযোগিতা করে আসছে বন বিভাগের কর্মকর্তারা। যখন যে দায়িত্বে এসেছেন তখনই তিনি হাত মিলিয়েছেন বনদস্যুদের সঙ্গে। ক্ষতি করেছেন এই বনের।

শুধু বন কর্মকর্তাই নন, অভিযোগ রয়েছে রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য পরিচালনা কমিটির সদস্যরাও এই গাছ পাচারের সঙ্গে জড়িত। অনেকটা অন্তরালে থেকে গাছ পাচারকারীদের প্রশাসনিক সাপোর্ট দিচ্ছেন। ব্যবস্থাপনা কমিটির শীর্ষ নেতারাও অনেক সময় লোকজন দিয়ে গাছ পাচার করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

মোদ্দাকথা যখন যে রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করেছে সেই দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের নিয়ন্ত্রণেই থেকেছে বন ব্যবস্থাপনা কমিটি। ফলে অনেকটা নির্ভয়েই দিনের পর দিন পাচার হয়েছে গাছ।

গাছ পাচারের মহোৎসব

স্থানীয়দের দাবি প্রশাসনের লোকজনের নাকের ডগা দিয়ে গাছ পাচার হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। অনেক সময় কাটা গাছসহ পাচারকারীদের আটক করলেও মামলা দেয়া হয়েছে হিসেব করে। ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের তদবিরে মামলা না দিয়ে শুধু কাটা গাছ জব্দ দেখিয়েছে বন বিভাগ। আর যে মামলাগুলো রয়েছে সেগুলো ছোটখাট পাচারকারী।

গাছ পাচারের দিক থেকে পিছিয়ে নেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও। বনদস্যুদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিরা গাছ পাচার করে আসছেন বছরের পর বছর ধরে। যদিও তাদের দাবি রেমা-কালেঙ্গার গাছ পাচার রোধে সবসময় সচেষ্ট ছিলেন তারা।

অভিযোগ রয়েছে বনাঞ্চলের রেমা অংশ থেকে গাছ নিধন করেছেন গাজীপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে। সম্প্রতি গাছ কাটার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করেছে বন বিভাগ।

অভিযোগ অস্বীকার করে তাজুল ইসলাম বলেন, বনভূমি থেকে ১০ বছর আগে গাছ কাটা হতো। এখন আর আগের মতো গাছ কাটা হয় না। এছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে গাছ পাচার রোধে যতটুকু দায়িত্বপালন করার কথা তার চেয়ে বেশি পালন করেছি।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গেল কয়েক বছরে অন্তত শতাধিক গাছ পাচারের মামলা করেছে জেলা বন বিভাগ। তাদের তালিকায় শীর্ষ পাচারকারীদের মধ্যে রয়েছে নুহ বাহিনীর প্রধান নুহ, হোসেন বাহিনীর প্রধান হোসেন ও মনা মিয়া। অনেকবার জেলও কেটেছেন এইসব প্রভাবশালী বনদস্যু। বর্তমানেও তারা গাছ পাচার মামলায় কারাগারে রয়েছেন।

গাছ পাচারের বিষয়ে জানতে চাইলে ‘নতুন এসেছি’ বলে দায় সারার চেষ্টা করেন সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তাই।

 দাপটের সঙ্গে গাছ কাটছে বনদস্যুরা

রেমা-কালেঙ্গা বন বিটের রেঞ্জ অফিসার মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘আমি এই বিটে নতুন যোগদান করেছি। তবে এখন কোন গাছ পাচার হয় না।’

বন কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আগের কথা বলতে পারব না। তবে আমি এখানে আসার পর বন কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা করবে দূরের কথা, কোন পাচারকারী বনে ঢোকারই সাহস পায় না। কিছু কিছু গাছ কাটা হচ্ছে সেগুলো বনাঞ্চলের না। নিজেদের খাস জমি থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা গাছগুলো কাটছেন।’

এই বন কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমি এই বনের দায়িত্ব পাওয়ার পর বনদস্যু নুহ ও হোসেনসহ একাধিক শীর্ষ চক্রের প্রধানকে আটক করে আইনের আওতায় এনেছি। তারা বর্তমানে জেল-হাজতে রয়েছেন।’

এ ব্যাপারে জানতে রেমা-কালেঙ্গা পরিচালনা কমিটির একাধিক নেতার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে জেলা বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মো. মারুফ হোসেন বলেন, ‘আমি এই এলাকায় নতুন এসেছি। বন থেকে গাছ পাচার হয় এ বিষয়টি জানা নেই। তবে বেশ কিছু মামলা রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘যদি বন কর্তৃপক্ষ গাছ পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে সেটা আগে ছিল। বর্তমানে কোন গাছই পাচার হচ্ছে না।’