বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৮ বছর

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

তুরস্কের একজন কবি ছিলেন। নাম নাজিম হিকমত। রূপকথার মতোই জনপ্রিয় এই কবিকে দীর্ঘ ১৮ বছর কাটাতে হয়েছিল তাঁরই দেশের কারাগারে। সরকারের উদ্ভট আদেশে বাকী জীবনটাও তাঁকে কাটাতে হয় বিদেশে, নির্বাসনে। সে দেশের নৌসেনাদের বিদ্রোহে প্ররোচিত করার অভিযোগে নাজিমের ভাগ্যে জুটেছিল এই শাস্তি।

এক যুদ্ধজাহাজে অবস্থিত তাঁর বিচার সভার বর্ণনা করতে করতে তিনি বলেছিলেন, জাহাজের ডেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় তাঁকে দৌড়াতে হয়েছিল ততক্ষণ, যতক্ষণ না তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তারপর তাঁকে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল পায়খানাঘরে। সেই ঘরের মলের স্তূপে তাঁর কোমর পর্যন্ত ডুবে ছিল। দুর্গন্ধে তাঁর মাথা ঘুরছিল, তখন তাঁর শরীর অবসন্নপ্রায়। এমন সময় তাঁর মনে হয়েছিল, যারা তাঁকে শাস্তি দিতে চায়, তারা সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে; দেখতে চাইছে কখন তিনি এই অসহ্য যন্ত্রণা আর অত্যাচারে ভেঙে পড়েন।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু এক অভূতপূর্ব গর্ববোধে হৃতশক্তি ফিরে পেলেন তিনি। শুরু করলেন গান, গলা ছেড়ে চিৎকার করে তিনি গান গাইতে লাগলেন নিজের রচিত গান, কৃষকের গান, খামারের গান, প্রেমের গান, স্বাধীনতার গান। অত্যাচারীর অত্যাচার আর শরীরের সমস্ত নোংরা ও যন্ত্রণা যেন মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল।

স্বাধীনতার পক্ষে জনতার গানের ভূমিকা বাদ দিয়ে ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসও লেখা সম্ভব নয়। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারির জনতা গান গেয়েই বাস্তিল দুর্গ দখল করেছিল। বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতার স্বীকৃতি আদায়ের জন্যে, সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনার জন্যে প্রচার-প্রচারণার অসংখ্য পত্র-পত্রিকার মতোই সৃষ্টি হয়েছিল সংখ্যাতীত সঙ্গীত। এইসব গানে উচ্চকিত হয়েছিল গণদাবি, জন-আকাঙ্ক্ষা। বিপ্লব যতই এগিয়ে চলেছে, গানের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে স্বৈরাচারী রাজা, অভিজাতদের বিরুদ্ধে তীব্র দ্রোহে।

গানের রচয়িতারা কোনো এক বিশেষ সম্প্রদায়ের ছিল না। সমস্ত বৃত্তির লোকেরাই গান লিখত, সুর করত, কাগজে ছেপে বিক্রি ও বিলি করত। কদাচিৎ গানের সঙ্গে স্বরলিপি থাকত, বেশির ভাগ গানই হত পুরনো কোনো গানের সুরে। রচয়িতা নিজে কিংবা অন্যরা বেহালা বাজিয়ে গান গেয়ে বেড়াত। আর গানের কলি মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ত ফরাসি দেশের পথে-প্রান্তরে। যার মূল কথাই ছিল স্বাধীনতা, যেখানে ধ্বনিত হতো আত্মার কণ্ঠস্বর। সে কণ্ঠস্বরে স্বাধীনতা ও মুক্তির গানই আত্মপ্রকাশ করতো।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Mar/26/1553573271900.jpg

স্বাধীনতার বাণী গান হয়ে একেক জনের কণ্ঠে একেকভাবে গীত হয়। স্বাধীনতার দিক-নিদের্শনা দেন দার্শনিকেরা; সংগ্রাম করেন রাজনীতিবিদগণ। কিন্তু একে পুষ্প-পল্লবে সুসজ্জিত করে মানুষের তন্ত্রীতে গেঁথে দেন কবিগণ। ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়...’ উচ্চারণটি তো একজন কবির পক্ষেই করা সম্ভব। স্বাধীনতা নিয়ে কাব্যকথা নির্মাণ করেন নি, এমন কোনও কবিরই সন্ধান পাওয়া অসম্ভব। বাংলা, উর্দু, হিন্দি, ফারসি, ইংরেজি, স্পেনিশ, আরবি, ফরাসি তথা বিশ্বের সকল ভাষার কবিরাই তাঁদের শ্রেষ্ঠ কবিতাটি রচনা করেছেন স্বাধীনতা আর মুক্তির আলোয় আলোয়। আর জনগণ সেই স্বাধীনতার স্পৃহায় মুক্তির সোপান গড়ে তোলেন।

সংগ্রামমুখর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। এই দিনে স্বাধীনতা নিয়ে সবচেয়ে সুন্দর, তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী কথা বলবেন রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, কবি, সাংবাদিক এবং সর্বস্তরের মানুষ। সবাই মিলে স্বাধীনতার অর্থ, ব্যাঞ্জনা ও ভাবকল্পকে বহুদূরগামী স্বপ্নের মতোন প্রসারিত করবেন মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে। স্বাধীনতাকে দিনযাপনের ভাবনায় আর ভবিষ্যতের সুখজাগানিয়া রোমাঞ্চের পথে একটি অদেখা নান্দনিক ভুবনের দিকে নিয়ে যাবেন। মানবাত্মার অতল গভীরে উড়ে উড়ে স্বাধীনতার অনিন্দ্য প্রভা ও দ্যোতনাকে  কোকিলের সুর-ব্যঞ্জনায় নিত্য গুঞ্জরিত করবেন এক সুনিবিড় ভালবাসায়: মুক্তির গানে গানে; সকলের প্রাণে প্রাণে।

একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের উত্তরাধুনিক সময়ে, এই ২০১৯ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৮ বছরের প্রাক্কালে, প্রকৃত স্বাধীনতা হলো ফরাসি দার্শনিক রুশোর মতো মানবের প্রত্যাশায় আত্মজিজ্ঞাসায় চিৎকার করা, নাজিমের মতো গলা খুলে মুক্তির গান গাওয়া, যে গানের স্মৃতি এখনো মিশে আছে মহান ফরাসি বিপ্লবের পরতে পরতে এবং বিশ্বের প্রতিটি মুক্তিকামী উদ্যোগে এবং বাংলাদেশের গৌরবময় একাত্তরে।

অতএব স্বাধীনতাকে সামনে রেখে আত্মসমীক্ষার মাধ্যমে মুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার চেয়ে বড় ও মহৎ কাজ আর কিছুই নেই।  এই কাজটিই এখন অতীব গুরুত্বের সঙ্গে করা দরকার। সন্দেহ নেই, স্বাধীনতার আটচল্লিশ বছরে আবেগ ও বাস্তবতার উথাল-পাথাল বহু স্রোত বয়ে গেছে এবং প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির নানা সমীকরণ মিশে আছে জাতির ইতিহাসের নদী ধরে। এমনও হয়েছে, স্বাধীনতা, স্বাধীনতার চেতনা কখনও কখনও আক্রান্ত হয়েছে ভেতর ও বাইরে থেকে। বাইরের আক্রমণগুলো চেনা-জানা:  সেগুলো সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও আগ্রাসনবাদ-সৃষ্ট। আর ভেতর থেকে যখন স্বাধীনতা, স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধ আহত-ক্ষত-বিক্ষত-আক্রান্ত হয় রাজনৈতিক স্বার্থান্ধতায়, দলীয় হীন ষড়যন্ত্রে, তখন সমগ্র জাতিকে সতর্ক হতে হয়। ভেতর ও বাইরে থেকে স্বাধীনতা, স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বুনো মোষের মতো ধেয়ে আসা  এই ধরনের ঐতিহাসিক আক্রমণে, সঙ্কটে, বিভ্রান্তির বেনোজলে, শাঠ্য-ষড়যন্ত্রের কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে মানববংশের রক্তাক্ত আর্তনাদে প্রতিরোধের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি উচ্চকিত করতে হয় প্রতিটি স্বাধীন সত্ত্বার মানুষকেই।

পৃথিবীর পথে পথে, দেশে দেশে, পরিবারে পরিবারে, যুদ্ধে, সংগ্রামে, দ্রোহে, সঙ্কল্পে, স্বপ্নে বহু বহু পথ-প্রান্তর, রক্ত, মৃত্যু, রণাঙ্গণকে মাড়িয়ে মানুষ এগিয়ে চলে সামনের ভবিষ্যতের দিকে। অতীতের শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতই সামনে এসে দাঁড়ায় পথ বাড়িয়ে। যুদ্ধ শেষ হয়, রক্ত শুঁকিয়ে যায়, হিংসার বাষ্প হাওয়ায় মিলিয়ে যায়  ধ্রুবতম সত্যের প্রতিনিধি হয়ে শেষ নির্যাসরূপে থেকে যায় মুক্তি ও স্বাধীনতার অমল চেতনা।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Mar/26/1553573300977.jpg

মুক্তি ও স্বাধীনতার অমল চেতনায় মানুষ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। দেশ ও পৃথিবীর মানুষকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়।  স্বপ্ন এবং এগিয়ে যাওয়া মানবসমাজের জন্য জরুরি, সত্য এবং কল্যাণকর। ১৯৭১ সালের মার্চে বাংলাদেশের এগিয়ে চলার সূচনা। এই চলার পথে প্রতিপক্ষে নানা ষড়যন্ত্র ও আঘাতের পরও বাংলাদেশ থেমে থাকে নি; বাঙালি জাতি পিছিয়ে পরে নি। অনেক অর্জনের পরেও সর্বসাধারণের মৌলিক স্বার্থের বহুক্ষেত্রে পূর্ণতা আণয়ন করা এখনও সম্ভব হয় নি। সামাজিক সুরক্ষা জাল বা সোস্যাল সেফটি নেট-এর মাধ্যমে দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, বেকারত্ব, নারীর অধিকার সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত করা যায় নি।  অনেক বৈষম্য ও সমস্যার শেকড় ধরে টান দেওয়া সম্ভব হয় নি। সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রসমূহ যথার্থ মনোযোগ ও পরিচর্যা পায় নি।

বর্তমানে বিদ্যমান উন্মাতাল আন্তর্জাতিক পালাবদলে টিকে থাকার প্রয়োজনে সুচিহ্নিত দেশজ-বাস্তবতাভিত্তিক জনগুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডাসমূহকে সর্বাধিক প্রাধান্য  দেওয়াই কাম্য। দুর্নীতি, কুশাসন, দারিদ্র্য ও অবিচারের অন্ধকার থেকে সমতাভিত্তিক বাংলাদেশের আলোকিত উত্থান হওয়া দরকার। চ্যালেঞ্জিং দ্য ইনজাস্টিস অব পোর্ভাটি: অ্যাজেন্ডাস ফর ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট ইন সাউথ এশিয়া গ্রন্থে  ড. রেহমান সোবহান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছেন: “আমরা দুই অর্থনীতির মধ্যে বন্দী ছিলাম, এখন সেখান থেকে বেরিয়ে দুটি বিভক্ত সমাজের কাছে বন্দী হয়ে পড়েছি; একদিকে বিশেষ সুবিধাভোগী অভিজাতেরা, অন্যদিকে বাদ পড়া সিংহভাগ জনগণ।” বাদ পড়া জনগণকে সমান সুযোগের আওতায় আনতে হবে।

অতীতে বাংলাদেশের মানুষের পূর্ণ সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে: দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন, রাজনৈতিক সংঘাত, সুশাসনের অভাব, সম্পদে নাগরিকগণের অসম অধিকার, অর্থনীতি ও বাজার-ব্যবস্থার ওপর রাজনীতির ছত্রছায়ায় সিন্ডিকেশন, শিক্ষা-জনস্বাস্থ্য-সেবা ব্যবস্থার ভঙ্গুর দশা, সামাজিক স্থিতি ও আইন-শৃঙ্খলার ভারসাম্যহীনতা এবং এসবের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন ইস্যু ও চ্যালেঞ্জকে। বাংলাদেশকে অধিকতর ন্যায্য ও পূর্ণ নাগরিক অধিকারযুক্ত সমাজ, টেকসই অর্থনৈতিক ক্ষেত্র এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাময় রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে গড়ে তোলার স্বপ্নটা ১৯৭১-২০১৯ পর্যন্ত দীর্ঘ পরিক্রমায় এখনও প্রাসঙ্গিক।

আগামী দিনগুলোতে একটি সম্পূর্ণ নতুন বিশ্ব গড়ার সূচনায় কাজ চলছে। অতীতের ধ্যান-ধারণা, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামোতে একটি বিরাট পরিবর্তন এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের শক্তিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হলে শোষণ ও বৈষম্য তৃণের মতো ভাসিয়ে দিতে হবে। শ্বাশত-অর্থে আমাদেরকে এমন রাজনীতি ধারণ করতে হবে যা রাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের পারস্পরিক সম্পর্ক, দায়িত্ব ও অধিকার সম্পর্কিত জায়গাগুলোকে আলোকিত করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়।

রাষ্ট্র বা রাজনীতি কেবল ক্ষমতা আর শক্তির  প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র নয়। আত্মস্বার্থের ময়দানও নয় রাজনীতি। রাজনীতি হলো জ্ঞানালোকিত-উন্নত রাষ্ট্র ব্যবস্থা আর হিংসামুক্ত-সমৃদ্ধ-নিরাপদ-সুখী-অধিকারপূর্ণ-নাগরিক সমাজ গঠনের চলমান প্রক্রিয়া। রাজনীতিতে সবচেয়ে সামনে ও গুরুত্বের জায়গাটিতে জনগণের অবস্থান। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পূর্তির মহান লগ্নকে সামনে রেখে, অনাগত দিনের শত-সঙ্কুল-সমস্যাকে মাড়িয়ে স্বপ্ন ও প্রত্যাশার আশাবাদী প্রত্যয়ে জেগে উঠতে চায় জাতি। স্বাধীনতা ও মুক্তির চিরায়ত গানকেই সামনে নিয়ে এগুতে চায় মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ও শ্বাশত চেতনায় মুক্ত, জ্ঞানালোকিত, দুর্নীতিহীন-সুশাসনে ভরপুর, উন্নয়নমুখী, শান্তি ও স্থিতিপূর্ণ রাষ্ট্র ও সমাজ চায় সকলেই।

ড. মাহফুজ পারভেজ: কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম।