অভিধানের ভেতর দিয়ে ভাষার গহীনে

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

ভাষার গভীরে প্রবেশ করতে হয় অভিধান ও ব্যাকরণের হাত ধরে। ভাষা, বিশেষত শব্দ ও অর্থগত বুনিয়াদ মজবুত করার জন্য অভিধান হলো সবশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। অভিধান কেবল শব্দভাণ্ডার নয়, অভিধানকে বলা হয় ভাষার আকর, যা এখন ডিজিটালাইজও হচ্ছে। অভিধান শব্দের বানান ও ব্যবহারের শুদ্ধতা জ্ঞাপন করে ব্যবহারবিধি ও ভাষাচর্চাকে পরিশীলিত অবয়ব দেয়।

কম্পিউটার-নির্ভর তথ্য প্রযুক্তির বিকাশের ফলে অভিধানের ডিজিটাল রূপও তৈরি হয়ে গিয়েছে। সিডি বা ডিভিডি ছাড়াও অভিধান এবং বিশ্বকোষ (এনসাইক্লোপিডিয়া) ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে। এক নিমেষের মধ্যেই এখন শব্দ, বানান, অর্থ, উৎপত্তি, সংজ্ঞা ইত্যাদি জেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

ছাপানো বা ডিজিটাল আকারে অভিধান দুই রকমের হতে পারে। একটি সাধারণ। আরেকটি স্পেশালাইজড বা বিশেষায়িত। সাধারণ অভিধানে ভাষার মূল শব্দগুলোর অর্থসহ নানা পরিচয় ও ব্যবহার দেওয়া থাকে। এই পরিচয় কত গভীর ও ব্যাপক, তা নির্ভর করে অভিধানের আয়তন ও প্রণেতার কৃতিত্বের উপর। তবে একটি অভিধানে যেসব তথ্য থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়, তা হলো: শব্দের উৎস ও ব্যুৎপত্তি, শব্দার্থ ও প্রতিশব্দ, পদরূপ, বানা বৈচিত্র্য, উচ্চারণ, প্রত্যয়জাত ও সমাসবদ্ধ পদের উদাহরণ, প্রয়োগবৈচিত্র্য ইত্যাদি।

অগ্রসর অভিধানে আরও কিছু ভাষাভিত্তিক তথ্য দেওয়া থাকে। যেমন: লিঙ্গান্তর, শব্দের মূলানুগ অর্থ, প্রায়োগিক অর্থ, পরিবর্তিত অর্থ, মান্য ও চলিত উচ্চারণ, বিকল্প বানান বিধি, আন্তর্জাতিক ধ্বনি-সংকেত ইত্যাদি। ইংরেজি ভাষায় এই ধরনের ব্যবহার-প্রাচুযের তথ্যসমৃদ্ধ একটি অভিধান হচ্ছে থর্নডাইক সেঞ্চুরি সিনিয়র ডিকশনারি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় অভিধানটির প্রকাশক। এছাড়াও অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, কলিংস ডিকশনারি তো রয়েছেই।

তবে থর্নডাইক সেঞ্চুরি সিনিয়র ডিকশনারির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, শব্দের পাশে অর্থ ইত্যাদি ছাড়াও ১ থেকে ২০-এর মধ্যে একটি সংখ্যা লেখা থাকে। কোনও শব্দের পাশে ১ থাকলে তার অর্থ, শব্দটি ইংরেজি ভাষায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ১০০০ শব্দের মধ্যে একটি। সংখ্যাটি ১১ হলে বুঝতে হবে সেই শব্দের জনপ্রিয়তা ১০,০০০ থেকে ১১,০০০ এর মাঝামাঝি।

একটি সাধারণ অভিধানের চরিত্র হতে পারে নির্দেশাত্মক অথবা বর্ণনাত্মক। নির্দেশাত্মক অভিধানে নির্দেশ দেওয়া হয় শব্দের নির্ভুল বানান, অর্থ ও প্রয়োগের উপর। ভাষার শুদ্ধতা বজায় রাখা ও উন্নত করা হলো এই ধরনের অভিধানের প্রধান লক্ষ্য। অন্যদিকে বর্ণনাত্মক অভিধান রচিত হয় ভাষার আধুনিক ব্যবহারের ভিত্তিতে।

সাধারণত বাজারে প্রচলিত অভিধানগুলো একভাষিক ও দ্বিভাষিক হয়। কখনো ত্রিভাষিক অভিধানেরও দেখা যাওয়া যায়। তবে সেগুলো সাধারণ ব্যবহারের চেয়ে গবেষণায় বেশি ব্যবহৃত হয়। একাধিক ভাষায় অভিধান রচিত হলে তার একটি হয় উৎসভাষা ও অন্যগুলো লক্ষ্যভাষা। অভিধানে উৎসভাষার শব্দগুলো বর্ণানুক্রমে সাজানো থাকে। এগুলোকে বলা হয় মুখশব্দ। মুখশব্দের অর্থ, জাতি, ব্যুৎপত্তি ইত্যাদি নানা ধরনের পরিচয় দেওয়া হয় লক্ষ্যভাষার মাধ্যমে।

অন্যদিকে বিশেষায়িত অভিধান একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ও বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে রচিত হয়। এ ধরনের অভিধানকে ‘ভাষা-সংক্রান্ত’ ও ‘বিষয়-সংক্রান্ত’ ভাগে ভাগ করা যায়। ভাষা-সংক্রান্ত অভিধানের মধ্যে বানান অভিধান, উচ্চারণ অভিধান, পরিভাষার অভিধান, আঞ্চলিক ভাষা অভিধান, অশিষ্ট শব্দ অভিধান এবং থিসরাস বা সমার্থ অভিধান উল্লেখযোগ্য।

থিসরাস ভাষার জগতকে বহুমাত্রিক করে। একই বা এক ধরনের নানা শব্দের সমাবেশ ঘটায়। ভাষাকে শ্রুতিমধুর, নিটোল ও সুন্দর করতে যুৎসই শব্দের প্রয়োগ একটি অপরিহায শর্ত। থিসরাস সেক্ষেত্রে সাহায্য করে।

ভাষার উপর দখল রাখার জন্য অভিধান একটি নিত্যসঙ্গী। ছাত্রজীবনে তো বটেই, ব্যবহারিক জীবনেও অভিধান ব্যবহারের শেষ নেই। অকস্মাৎ একটি শব্দ, বাংলায় বা ইংরেজিতে পাওয়া গেলো, যার ভাব বোঝা গেলেও মূল অর্থটি আমরা জানতে পারি অভিধান থেকে। কখনো এমন হয় যে কোনও শব্দের ভাসা ভাসা অর্থ জানা থাকে অনেকেরই। কিংবা শব্দটি দিয়ে কি বুঝানো হচ্ছে, সেটাও টের পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু শব্দটির প্রকৃত ও যথার্থ অর্থটি জানার জন্য অভিধান লাগবেই।

আসলে ভাষার উপর দখল একদিনে আসে না, আসে অবিরাম চেষ্টার মাধ্যমে, চর্চার মাধ্যমে। যে কোনও ক্ষেত্রের মতোই ভাষা বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য চেষ্টার বিকল্প নেই। পঠন ও লিখন পদ্ধতির মাধ্যমে তখন ভাষা-দক্ষতা অর্জিত হয়, যখন বহু শব্দ লেখকের জানা থাকে। আর এক্ষেত্রে অভিধান হলো সবচেয়ে নির্ভযোগ্য সাহায্যকারী। একটি নির্ভুল ও ব্যাপকভিত্তিক অভিধান যে কোনও ব্যক্তি বা পরিবারের জন্য সার্বক্ষণিক বন্ধু ও সহযোগী।