নির্বাচন কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষ হওয়া বাঞ্ছনীয়

  • ইকতেদার আহমেদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

নির্বাচনের কাজের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিকে নির্বাচন কর্মকর্তা বলা হয়। এরূপ ব্যক্তিদের অনেকে নির্বাচনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে আবার অনেকে পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। জাতীয় সংসদের নির্বাচন একটি বৃহৎ কর্মযজ্ঞ। এ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সহায়তা গ্রহণ করতে হয়। এ ধরনের সহায়তা গ্রহণের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধানে নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতায়ন করে বলা হয়েছে নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীর প্রয়োজন হবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেরূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করবেন।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে মাঠ পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে রিটার্নিং অফিসার, সহকারি রিটার্নিং অফিসার, প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারি প্রিজাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসাররা নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সহায়তা করেন।

বিজ্ঞাপন

নির্বাচন কমিশন এক বা একাধিক আসনের জন্য একজন রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দিতে পারেন। সচরাচর দেখা যায় সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি জেলার বিপরীতে একাধিক আসনের জন্য একজন রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দেয়া হয় এবং প্রতিটি আসনের জন্য একজন করে সহকারি রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়। প্রতিটি ভোট কেন্দ্রের জন্য একজন করে প্রিজাইডিং অফিসার এবং প্রতিটি ভোট কক্ষের জন্য একজন সহকারি প্রিজাইডিং অফিসার ও দুইজন পোলিং অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়।

রিটার্নিং অফিসার ও সহকারি রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে সরকারের কোন্ বিভাগের কোন্ ধরণের পদধারীদের নিয়োগ দেয়া হবে এ বিষয়ে এতদসংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এ কোনো কিছু উল্লেখ নেই। এযাবৎকাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের বিভাগীয় কমিশনার বা জেলা প্রশাসক পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের সহকারি রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়নি।

বিভিন্ন সরকারি ও সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে রিটার্নিং অফিসারের যাচনা মোতাবেক সংশ্লিষ্ট সরকারি ও সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারি প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারদের তালিকা প্রদান করে থাকে। এ তালিকা থেকে রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এ সকল কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয়।

নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত এ ধরনের নির্বাচন কর্মকর্তা কমিশন বা ক্ষেত্রমতো রিটার্নিং অফিসারের কাছে গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া তার দায়িত্ব গ্রহণে বা পালনে অপারগতা বা অস্বীকৃতি প্রকাশ করতে পারেন না। নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত এরূপ ব্যক্তিকে তার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে কোনোরূপ বাঁধা দিতে পারেন না।

নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি তার উক্তরূপ নিয়োগের তারিখ থেকে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি না পাওয়া পর্যন্ত তার চাকরির অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে কমিশনের অধীন প্রেষণে চাকরিরত আছেন বলে গণ্য হন। উক্তরূপ প্রেষণে চাকরিরত থাকাকালে নির্বাচন কর্মকর্তা নির্বাচন সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে কমিশন এবং ক্ষেত্রমতে রিটার্নিং অফিসারের নিয়ন্ত্রণে থাকেন এবং তিনি তাদের যাবতীয় আইনানুগ আদেশ বা নির্দেশ পালনে বাধ্য থাকেন। একজন নির্বাচন কর্মকর্তার নিকট উক্তরূপ প্রেষণে চাকরিরত থাকাকালে নির্বাচন সংক্রান্ত দায়িত্ব প্রাধান্য পায় এবং এ দায়িত্বের সাথে সাংঘর্ষিক বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে তিনি তার অন্যান্য দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

একজন নির্বাচন কর্মকর্তা নির্বাচন সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রদত্ত কমিশন বা ক্ষেত্রমতে রিটার্নিং অফিসারের কোনো আদেশ বা নির্দেশ পালনে ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যর্থ হলে বা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে বা নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো আইনের বিধান ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করলে এরূপ কাজ অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে এবং উক্তরূপ অসদাচরণ তার চাকরিবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এরূপ অসদাচরণের জন্য অভিযুক্ত কর্মকর্তার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে অপসারণ বা বরখাস্ত করতে পারবে বা বাধ্যতামূলক অবসর দিতে পারবে বা পদাবনতি করতে পারবে বা পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি অনধিক দুই বছরের জন্য স্থগিত করতে পারবে।

উপরোল্লিখিত অসদাচরণের কারণে কমিশন বা ক্ষেত্রমতে কমিশনের সম্মতিক্রমে রিটার্নিং অফিসার অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তার চাকরিবিধি অনুযায়ী শৃঙ্খলামূলক কার্যধারা গ্রহণ সাপেক্ষে তাকে অনধিক দুই মাসের জন্য সাময়িকভাবে চাকরি থেকে বরখাস্তের আদেশ দিতে পারেন এবং এরূপ বরখাস্তের আদেশ তার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তার চাকরিবিধি অনুযায়ী প্রদত্ত হয়েছে বলে গণ্য হবে এবং তদনুযায়ী তা কার্যকর হবে।

কমিশন বা ক্ষেত্রমতে রিটার্নিং অফিসার অসদাচরণের জন্য কোনো নির্বাচন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কার্যধারা গ্রহণের জন্য কোনো নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করলে উক্ত কর্তৃপক্ষ উক্তরূপ অনুরোধ প্রাপ্তির একমাসের মধ্যে উপযুক্ত কার্যধারা গ্রহণ করে কমিশনকে অবহিত করবে।

উক্তরূপ অসদাচরণের জন্য অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শৃঙ্খলামূলক কার্যধারা ছাড়াও কমিশন বা কমিশন কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে আদালতে অসদাচরণজনিত অপরাধের বিচারের প্রার্থনা করে প্রতিকার চাওয়া যাবে। এ ধরণের অসদাচরণের সাজা অনধিক একবছর কারাদণ্ড অথবা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড।

রিটার্নিং অফিসার, সহকারি রিটার্নিং অফিসার, প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারি প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার এবং নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীগুলোর সদস্যরা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচনের কাজের সাথে সম্পৃক্ত। অপরদিকে উপরোক্ত কর্মকর্তাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ পরোক্ষভাবে নির্বাচনের কাজের সাথে সম্পৃক্ত।

নির্বাচন কমিশন প্রতক্ষভাবে নির্বাচনের কাজের সাথে সম্পৃক্ত কোনো নির্বাচনী কর্মকর্তা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অনিয়ম করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। অপরদিকে পরোক্ষভাবে যারা নির্বাচনের দায়িত্বের সাথে সম্পৃক্ত নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়ার আদেশ দিতে পারেন।

সম্প্রতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্বাচনের কাজের সাথে সম্পৃক্ত জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও বিচার প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ দেশের একটি অন্যতম দল পক্ষপাতিত্ব ও নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্নের অভিযোগ কমিশন বরাবর দাখিল করেছে। কমিশন এ ব্যাপারে কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কমিশনের পক্ষ থেকে  অদ্যাবধি এমন কিছু ব্যক্ত করা হয়নি।

দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত প্রতিটি ব্যক্তির জনসাধারণকে নিঃস্বার্থ সেবা প্রদান অত্যাবশ্যক। প্রজাতন্ত্রের কর্ম বলতে অসামরিক বা সামরিক ক্ষমতায় বাংলাদেশ সরকার সংক্রান্ত যে কোনো কর্ম, চাকরি বা পদকে বোঝায়। নির্বাচন কমিশনসহ নির্বাচনী কাজের সাথে সম্পৃক্ত সরকারি ও সায়ত্বশাসিত সংস্থার সকল ধরণের অসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারিগণ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তি। এরূপ ব্যক্তিদের বেতন, ভাতা ও সুযোগসুবিধাদি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে রক্ষিত জনসাধারণের প্রদত্ত কর থেকে নির্বাহ করা হয়। এদের নিকট দেশের সাধারণ জনমানুষ নিরপেক্ষতার পাশাপাশি সততা, বিশ্বস্ততা, একাগ্রতা ও আন্তরিকতা প্রত্যাশা করে। এদের কারো মধ্যে প্রত্যাশিত গুণাবলির ঘাটতি পরিলক্ষিত হলে তা প্রতিষ্ঠানসমূহের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের বিতর্কিত করে তোলে। বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান বা বিতর্কিত কর্মকর্তা কখনো দেশের ও দেশের জনমানুষের জন্য সুখকর, কল্যাণকর  ও স্বস্তিদায়ক নয়। আর তাই দেশ ও জনমানুষের কথা ভেবে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকলকে নিরপেক্ষ থেকে নিজেকে ও নিজ প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কের উর্ধ্বে রাখা উচিত।

ইকতেদার আহমেদ: সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক