কেন যেই লাউ সেই কদু, যেই বর সেই বধূ?

  • এরশাদুল আলম প্রিন্স
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

লাউ-কদু ও বধূ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে এমন ‘লাউ-কদু ও বর-বধূ’ আলোচনা হচ্ছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রায় চুড়ান্ত। ৩০০ আসনের মধ্যে ২৪৮টি আসনে প্রার্থীদের মনোনয়নের চিঠি দেওয়া হয়েছে। বাকি আসনগুলো জোটের মধ্যে ভাগাভাগি হতে পারে। তবে প্রাপ্ত মনোনয়নের ওপর ভিত্তি করে একথা বলা যেতেই পারে-যেই লাউ সেই কদু!

বিজ্ঞাপন

সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে প্রাথমিকভাবে বর্তমান সাংসদদের ৩৮জন বাদ পড়েছেন। মন্ত্রীদের মধ্যে আরিফ খান ছাড়া কেউ বাদ পড়েননি। এদিকে দলের সিনিয়র বেশকিছু নেতা বাদ পড়েছেন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগে বেশ কিছু নতুন মুখের আবির্ভাব হয়েছিল। সেবার নির্বাচনের মাঠে দলটির অন্যতম নির্বাচনী শ্লোগান ছিল ‘পরিবর্তন’ ও  ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’। আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে জয়ী হয়েছে এবং সে নির্বাচনে নতুন প্রজন্মের অনেককে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। তারা নির্বাচিতও হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নতুনদের দলে ও মন্ত্রিসভায়ও স্থান দিয়েছেন।

কিন্তু বাস্তবতা হলো নতুনরা দলে এসে দল, রাজনীতি ও দেশকে নতুন কিছু দিতে পারেননি। এর কারণও আছে। রাতারাতি রাজনীতিতে পরিবর্তন সম্ভব না। ফলে নতুনরা গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে গিয়ে দলের ভেতরে ও বাইরে নতুন কিছু করতে পারেননি। দলের সিনিয়ররা যে রাজনীতির চর্চা করেন, সে আদলেই নতুনরাও রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ফলে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব না। যা-ও দুই-একজন দলের মধ্য থেকেও একটু সংস্কারবাদী কথা-বার্তা বলেছেন তাদেরকে ভোগ করতে হয়েছে করুণ পরিণতি।

দল ও রাজনীতির গতানুগতিক চিন্তা-চেতনার বাইরে গিয়ে উদারপন্থী চেতনা চর্চার রাজনৈতিক পরিণতি ভালো নয়। একথা বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কামাল হোসেন, কাদের সিদ্দিকী এমনকি হালে গোলাম মাওলা রনিও জানে। রনি জেল ঘুরে এসে আজ বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিকল্প ধারার কুলা নিয়ে নৌকায় ভোটের সাগর পাড়ি দিতে চান। ফলে, নিকট অতীতের এই শিক্ষাগুলো নতুনরা ভুলবেন কেন? ফলে, নতুনদের কাছ থেকে নতুন কিছুই আমরা পাইনি। যেই লাউ, সেই কদু।

গত এক দশকে আওয়ামী লীগ বাহ্যত শক্তহাতে সরকার পরিচালনা করলেও ভেতরে ভেতরে অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে তাকে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা করতে হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এছাড়া ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে বিরোধী রাজনীতির মুখে সে নির্বাচনটি সম্পন্ন করতে গিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে সরকারকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। সেই সাথে হলি আর্টিজানসহ অপরাপর জঙ্গি হামলার প্রেক্ষাপটে দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিয়েও তাকে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে অনেক চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দলকে চুলপাকাদের ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে। নতুনরা তেমন কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেননি। অনেক নতুনদের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে। কিন্তু তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়াতো দূরের কথা ছোটোখাটো বিষয়েও গণমাধ্যমকে মোকাবেলা করতে হিমশিম খেয়েছেন। এদিকে দলের শূন্যতা পুরণের জন্য এক পর্যায়ে দলকে ১/১১ এর সংস্কারবাদীদের ফিরিয়ে আনতে হয়েছে। এবং তারাই দলকে দুর্দিনে শক্ত ভীতের ওপর দাঁড় করিয়েছে। অবদান রাখাতো দূরের কথা, নতুনার নিজেদের জন্য কোনো ইমেজই তৈরি করতে পারেননি যা দেখে অন্তত তরুণ ভোটাররা আকৃষ্ট হতে পারে। । ফলে নতুনরা দলের জন্য তেমন কোনো অবদান রাখতে পারেনি।

অনেকেই আশা করেছিলেন আওয়ামী লীগ ২০০৮-এর মতো এবারও বেশকিছু নতুন মুখকে মনোনয়ন দেবেন। নতুন মুখ মানে তরুণ মুখ। কিন্তু সেই তারুণ্য এবারের মনোনয়নে দেখা যায়নি। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এজন্য দলকে কতটুকু দায়ী করা যায়। দলকে তো রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে হয়। সরকার গঠন করার পরেও তাকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। শেখ হাসিনা নতুনদের জায়গা দিয়েছিলেন, কিন্তু তারা সাফল্যের নজির দেখাতে পারেননি। তাই তিনি আর নতুনদের নিয়ে নৌকা ডুবাতে চাননি। নতুনরা কিছু নজির দেখাতে পারলে এবারও হয়তো আরো বেশ কিছু নতুন ও তরুণ মুখ আমরা দেখতে পেতাম। পথিকৃৎরা যদি পথ না দেখান, তবে নতুন মুখের আবির্ভাব হবে কীভাবে? ফলে যেই লাউ সেই কদু।

কিন্তু এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো-রাজনীতি কি তাহলে এভাবেই চলবে? রাজনীতিতে কি তবে নতুন ও তরুণরা কখনো আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না? তরুণ, প্রগতিশীল ও উদারপন্থীরা কি রাজনীতিতে আসতে পারবে না? প্রতিবেদন অনুযায়ী এবার আগের ৩৮জন এমপি বাদ পড়েছেন। সেখানে নিশ্চয় নতুন ৩৮জন আসবেন। এই ৩৮ জনের মধ্যে যে সবাই একেবারে নতুন তা না-ও হতে পারে। আগের কোনো সময় বাদ পড়ারাও আবার নতুন করে আসতে পারেন। কিন্তু মূল বিষয় নতুন মুখের আবির্ভাব নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, তারুণ্য নির্ভর প্রগতিশীল ও উদারপন্থী রাজনীতিকের অভিষেক। কিন্তু আমাদের রাজনীতিতে সেটি হচ্ছে না। নতুন যারাও আসছেন তারাও পুরনোদের পথেই চলছেন। ফলে, উগ্র রাজনৈতিক ভাবাদর্শের প্রচলনটি রয়েই যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দলের জন্য তা এক সময় বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। আমরা ইতিমধ্যে সে নমুনা দেখেছিও।

আমাদের মনে রাখতে হবে, বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বায়নের এই শ্লোগানে দেশও আজ শামিল। বৈশ্বিক চিন্তা চেতনার বিকাশ আজ বাস্তবতা। গত এক দশকে নতুন করে ভোটার হয়েছে নতুন প্রজন্ম। এরা সবাই তরুণ। তাদের চিন্তা চেতনায় বৈশ্বিক চিন্তা চেতনার প্রকাশ স্পষ্ট। দেশ, রাজনীতি, সমাজ, আবেগ, ধর্ম এমনকি যৌনতা নিয়েও রয়েছে তাদের ভিন্ন চিন্তাধারা যা বিগত প্রজন্ম থেকে ভিন্নতর। এই নতুন প্রজন্মকে চলমান রাজনীতির গতানুগতিক সংস্কৃতি দিয়ে বাধা যাবে না। তাদের রয়েছে নিজস্ব রাজনৈতিক চেতনা। আমাদের মনে রাখতে হবে, তারাই আগামী প্রজন্ম। তারাই আগামী দিনের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। ফলে রাজনীতিকরা যদি নতুন প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করতে না পারে তবে আদতে দলগুলোর জন্যই নেতিবাচক প্রভাব বয়ে নিয়ে আসবে। এক্ষেত্রে যে দল নতুন প্রজন্মের উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শ ধারণ করতে পারবে তারাই লাভবান হবে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে যুগোপযুগী চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ও প্রচারের সুযোগ দিতে হবে।

 

অতি সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলন ও কিশোরদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে আমরা তাদের এক ধরনের চিন্তা-চেতনার বহি:প্রকাশ দেখেছি। সরকার ও বিরোধী পক্ষ উভয়ই তাদের ন্যায্য দাবিকে রাজনীতিকরণ করতে চেয়েছে। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত কারও রাজনৈতিক ফাঁদে পা দেয়নি। মার খেয়েছে কিন্তু অরাজনৈতিক দাবিকে রাজনৈতিক দিকে ধাবিত হতে দেয়নি। এদিকে গতানুগতিক রাজনৈতিক চিন্তা-ধারার রাজনীতিকরা তাদেরকে নানাভাবে গালমন্দ করেছেন। কিন্তু তাতেও তারা তাদের নৈতিক অবস্থান থেকে সরে যায়নি। ফলে প্রয়োজন রয়েছে এই প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারণ করার। না হলে দল পিছিয়ে পড়বে। নতুন ও উদারপন্থী রাজনীতিকদের দলে জায়গা দিতে হবে। তবেই নতুন প্রজন্মকে, নতুন ভোটকে আকৃষ্ট করা যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাধবে কে? কারণ, মাঠের রাজনীতিতো এখনো পুরনোদের দখলেই।

 

রাজনীতিতে ভালো ভালো কথা বলা সহজ। কিন্তু ভোটের মাঠে ভালো কথায় চিড়ে ভেজে না,  রাজনীতিকরা এটা ভালোই জানেন। সে কারণেই এবারের মনোনয়নে আওয়ামী লীগ চমক দেখাতে পারেনি। নতুন মুখের সন্ধান মেলেনি। এক তন্ময় আর নওফেল উদাহরণ নয়, ব্যতিক্রম। এমনকি এখানে রয়েছে পারিবারিক রাজনৈতিক পরিচয়ে ব্যাপার-স্যাপার।

 

নতুন মুখ না আসার আরেকটি বড় কারণ- পুরোনোরা জায়গা ছাড়তে চান না। তাদেরকে একরকম জোড় করেই মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত করতে হয়। না হলে কেউ পদ-পদবী ছাড়তে চান না।

 

অধিকাংশ নেতাই স্থানীয়ভাবে নতুনদের মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেন না। কোনোভাবে যদি নতুন কেউ মনোনয়ন পেয়েও যান তবে পুরনোরা নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের বিরোধীতা করেন। এবারের নির্বাচনে এ ভয়টিই আওয়ামী লীগের বড় ভয়। এর পেছনে নির্বাচনের বর্তমান সাংবিধানিক বিধানটিও একটি বড় কারণ।

 

এবারের নির্বাচন সরকারের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। বর্তমান সরকারের অধীনেই এবারের নির্বাচন হচ্ছে। নিজেদের অধীনে নির্বাচন করেও যদি পরাজয় বরণ করতে হয় সেটি সরকারের জন্য বড় পরাজয়। যদিও এ পরাজয় গৌরবেরও হতে পারে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এরকম গৌরবের ভাগিদার হতে চায় না। সবাই চায় নগদ নারায়ণ, ক্ষমতা।

সরকারই সংবিধান সংশোধন করেছে। বর্তমান সংবিধানের অধীনে রাজনৈতিক সরকারের তত্ত্বাবধানে যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে সেটি প্রমাণ করার দায়িত্ব তাদের। এ চ্যালেঞ্জটি যদি সরকার গ্রহণ করে তবে তাকে সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে হবে। আবার সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে হলে

মাঠে যোগ্য প্রার্থী দিতে হবে। মাঠের যোগ্যতা নির্ভর করে টাকা, ক্ষমতা ও লোকবল (Money, Muscle Manpower)। হুণ্ডা আর গুণ্ডামুক্ত রাজনীতি এখনও নিশ্চিত হয়নি।

ফলে ভোটের রাজনীতিতে এমন প্রার্থী দরকার যারা যেকোনো ভাবেই নির্বাচনে জয়লাভ করে আসতে পারে। তরুণরা মাঠ দখলের রাজনীতি এখনো রপ্ত করতে পারেনি। এছাড়া গত এক দশকে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচী প্রায় না থাকায় আওয়ামী লীগের মধ্যেও স্থানীয় নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। কারণ, মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠে রাজনৈতিক কর্মসূচীর মধ্যদিয়ে।

এছাড়া সংসদ বহাল রেখে এবারের নির্বাচন হচ্ছে। ফলে এমনিতেই পুরনোরা নতুনদের জায়গা দিতে চান না। তদুপরি সাংসদ থাকার ফলে স্থানীয়ভাবে তাদের প্রভাব আরও বেশি। বিদ্যমান এমপি ও মন্ত্রীরা যদি এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেন তবে নতুনরাতো দাঁড়াতেই পারবে না। যদিও দলের সাধারণ সম্পাদক দলের বিরুদ্ধে কেউ ভূমিকা পালন করলে তাকে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহি:ষ্কারের হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে হুমকি ধামকি দিয়ে তাদেরকে এসব থেকে বিরত করা যায় না। কারণ, তলে তলে নিজ দলের বিরোধীতা করলে কিছুই করার থাকে না। বিশ্বাসঘাতকতা তো কেউ বলে কয়ে করে না।

নতুনরা না আসার আরেকটি বড় কারণ হলো এবারের নির্বাচনটি অংশগ্রহণমুলক হচ্ছে। এরকম একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে সেখানে শক্তিশালী প্রার্থীই লাগবে। ভোটের রাজনীতিতে নতুন- দুর্বলের চেয়ে পুরনো-শক্তিশালী প্রার্থীই বেশি দরকার। পুরনো চাল ভাতে বাড়ে, নতুন প্রার্থী ভোটে মরে। তবে, এ থেকে আরেকটি বিষয় প্রকাশ পায় তা হলো সরকার হয়তো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায় এবং সে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসতে চায়। নতুনরা হয়তো এ চ্যালেঞ্জটি নিতে পারবে না। এ বোধ থেকেই নতুনরা এবার বাদ পড়েছেন। তাই যেই লাউ, সেই কদু, যেই বর, সেই বধূ।

এরশাদুল আলম প্রিন্স: কন্ট্রিবিউটিং এডিটর বার্তা২৪.কম, আইনজীবী ও কলামিস্ট।