দিন দিন বৈরী হয়ে উঠছে আবহাওয়া। কখনো তীব্র খরা আবার অতিবৃষ্টিতে বীজতলা নষ্ট হয়ে ব্যহত হয় চারা উৎপাদন। এতে মৌসুমী সবজি ও ফল আবাদে পিছিয়ে পড়ে চাষিরা। এসকল ঝামেলা এড়াতে পাবনার দাপুনিয়া ইউনিয়নের মির্জাপুর এলাকায় বিজ্ঞানভিত্তিক পলিনেট হাউজে চারা উৎপাদন করে সফলতা পেয়েছেন কৃষক আনিসুর। প্রাকৃতিক বিপর্যয় এড়িয়ে রোগ বালাই মুক্ত এসব চারাতে ভালো ফলন পাওয়ায় সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন তিনি। নিজ জমিতে চাষের পাশাপাশি চারা বিক্রি করেও বেশ লাভবান হচ্ছেন এই উদ্যোক্তা।
গ্রিনহাউসের আদলে তৈরি এ দেশীয় কৃষি ব্যবস্থাপনায় আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ, রোগ-বালাই প্রতিরোধ, বীজতলার মান নিয়ন্ত্রণ ও অমৌসুমে উচ্চমূল্যের ফসল চাষে যুগান্তকরী আবিষ্কার এই ‘পলিনেট হাউজ’ পদ্ধতি। এর ব্যবহারে ভারী বৃষ্টি, তীব্র তাপদাহ, কীটপতঙ্গ, ভাইরাসজনিত রোগের মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিরাপদ থাকে চারা উৎপাদন। পলিনেট হাউজে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় মাটি ও নারিকেল খোসায় তৈরী কোকো পিট টবে উৎপাদিত চারার গুণগত মান ভালো হওয়ায় ফলন বৃদ্ধিতে লাভবান হচ্ছে কৃষক। ফলে এসব চারার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের।
পলিনেট হাউজে চারা উৎপাদনকারী সফল উদ্যোক্তা আনিসুর রহমান জানান, রোগ বালাই মুক্ত এসব চারাতে ভালো ফলন হওয়ায় নিজ জমিতে চাষের পাশাপাশি বিক্রি করেও বেশ লাভবান হচ্ছেন তিনি। তিনি আরও জানান, পলিনেট হাউজে উন্নত মানের পলি ওয়ালপেপার ব্যবহার করায় সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। এ কারণে ফসল নষ্টও হয় না। এছাড়াও ক্ষতিকর কোন পোকা-মাকড় আক্রমণ করতে না পারায় পলিনেট হাউজে কোন কিটনাশক ব্যবহার করতে হয় না তার। যার ফলে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করা যায় বলে জানান তিনি।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. জামাল উদ্দীন বলেন, পলিনেট হাউজে ফসলের উৎপাদন সনাতন পদ্ধতির চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি, পোকামাকড়ের আক্রমণ হয় ৭০ শতাংশেরও কম। প্রাথমিক খরচ কিছুটা বেশি হলেও এতে উৎপাদন খরচ খুবই কম হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হন কৃষকেরা।
অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় কৃষি আবাদে বড় রকমের ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন দেশের ২৩ জেলার বিপুল সংখ্যক কৃষক। বন্যার এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার চার ধাপের পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এতে ব্যয় হবে ১৯৩ কোটি তিন লাখ ৭০ হাজার টাকা।
কৃষি মন্ত্রণালয়াধীন সংস্থা কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক ড. সুরিজত সাহা রায় এ তথ্য জানিয়েছেন।
পুনর্বাসন কর্মসূচি
১. বোনা আমন/রোপা আমন ধান (বরাদ্দকৃত)
(৯টি জেলায় এই কর্মসূচির উপকারভোগী হবেন ৮০ হাজার কৃষক। এই কর্মসূচিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তের কোটি ৬৬ লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা)
- ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক বিনামূল্যে রোপা আমন ফসলের উফশী জাতের বীজ, সার সহায়তা এবং অন্যান্য
- মাঠে ১ বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে চাষের জন্য জন প্রতি সহয়তা ১৭০৭.৫ টাকা (চারা/বীজ এবং ১০ কেজি ডিএপি ও ১০ কেজি এমওপি এবং বীজ প্রদান করা হবে।যারমধ্যে বীজ এর মুল্য ৫৫ টাকা /কেজি, ডিএপি ১৯ টাকা /কেজি, এমওপি ১৮ টাকা /কেজি
-বপন ও অন্যান্য বাবদ ১০০০ টাকা সহায়তা বিকাশে যাবে;
২. বসতবাড়িতে আগাম শীতকালীন সবজি চাষ (প্রস্তাবিত)
- এই কর্মসূচির আওতায় বন্যা উপদ্রুত ২২টি জেলার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের বিনামূল্যে গ্রীত্মকালীন সবজি চাষের জন্য (টমেটো, বেগুন, পালংশাক, লাল শাক, শিম, লাউ, কলমিশাক ও মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদি) উন্নত জাতের হাইব্রিড ও উচ্চ ফলনশীল বীজ বিতরণ করা হবে বিনামূল্যে।
- বসতবাড়িতে ৫ শতাংশ জমিতে চাষের জন্য জনপ্রতি সহয়তা দেওয়া হবে ১৫২০ টাকা (বিভিন্ন জাতের ৫২০ টাকার সবজি বীজ ও অন্যান্য বাবদ বিকাশে ১০০০ টাকা)
-এই কর্মসূচিতে উপকারভোগী হবেন ১ লক্ষ ৫০ হাজার কৃষক। এতে ব্যয় হবে ২২ কোটি ৮৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
৩. আগাম শীতকালীন সবজি (প্রক্রিয়াধীন)
দেশের ২২টি জেলার ৩ লাখ কৃষক এই কর্মসূটির উপকারভোগী হবেন। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ১শ’ ১৭ কোটি ৬৬ লক্ষ টাকা। কর্মসূচির আওতায় কৃষকদের বিনামূল্যে গ্রীষ্মকালীন সবজির (মরিচ, টমেটো, লাউ, গাজর, বেগুন, মিষ্টিকুমড়া, ফুলকপি ও বাঁধাকপি) উন্নত জাতের হাইব্রিড ও উচ্চ ফলনশীল বীজ বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে।
- বিঘাপ্রতি জমিতে চাষের জন্য জনপ্রতি সহয়তা ৩৯২২ টাকা (বিভিন্ন জাতের ২৫০০ টাকার সবজি বীজ. ১০ কেজি ডিএপি, ১০ কেজি
এমওপি ও শ্রমিক, সেচ ও অন্যান্য বাবদ কৃষক প্রতি বিকাশে ১০০০ টাকা সহায়তা)
৪. বোরো ধান (প্রস্তাবিত)
দেশের ২২টি জেলার ২ লাখ ২৬ হাজার কৃষকের জন্য ৩৮ কোটি ৮৭ লাখ ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হবে এই পুনর্বাসন কর্মসূচি।
-ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বোরো ফসলের উফশী জাতের বীজ, সার এবং অন্যান্য সহায়তা প্রদান করা হবে।
-প্রতি বিঘা জমিতে চাষের জন্য জনপ্রতি সহয়তা ১৭২০ টাকা। এর মধ্যে বীজ ৫ কেজি এবং ১০ কেজি ডিএপি ও ১০ কেজি এমওপি এবং বীজ বপন ও অন্যান্য খরচ বাবদ বিকাশে ১০০০ টাকা সহায়তা)
বন্যায় কৃষিতে ক্ষয়ক্ষতি
১৬ আগস্ট ২০২৪-৩০ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত কৃষি বিভাগের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় দেশের ২৩টি জেলার কৃষি আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলাগুলো হচ্ছে-নারায়নগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, ফেনী, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, নাটোর, খুলনা, নড়াইল, বাগেরহাট ও যশোর। জেলাগুলোর ৩ লাখ ৭২ হাজার ৭৩৩ হেক্টর জমির ফসল এই বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২লাখ ৮ হাজার ৫৭৩ হেক্টর জমি পরিপূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কৃষি বিভাগ আরও জানিয়েছে, বন্যায় ৯ লাখ ৮৬ হাজার মেট্রিক টন ফসলের ক্ষতি হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১৪ লাখ ১৪ হাজার ৮৯ জন কৃষক।
অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় দেশের ১১টি জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় ধুঁকছে অর্ধ কোটিরও বেশি মানুষ। জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে বন্যা উপদ্রুত জনপদে বিপর্যস্ত কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাও। বন্যায় দূর্গতদের উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে ফসলের বড় রকমের এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তৎপর কৃষি বিভাগ।
বন্যার সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা যাতে সংকটে না পড়ে সেজন্য এরই মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ ও গবেষণাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বৈঠক করেছেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বন্যায় ফসলের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে গুচ্ছ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।
গৃহীত পদক্ষপের বিষয়ে বার্তা২৪.কম এর সঙ্গে সোমবার বিকেলে কথা বলেছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিশেষায়িত সংস্থা কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক ড. সুরজিত সাহা রায়।
বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সমন্বিত পদক্ষেপের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গত শনিবার মাননীয় কৃষি উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বন্যায় কৃষিতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে পানি নেমে যাওয়ার উপর। বন্যার পানি যদি ৭ সেপ্টেম্বরের (২০২৪) মধ্যে নেমে যায় তাহলে কিছু ধান নতুন করে লাগানো যাবে। সর্বোচ্চ ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লাগানো যাবে, তারপরও অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে।’
ড. রায় বলেন, ‘প্রধান খাদ্য শস্য ধানের উৎপাদনের কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা চেষ্টা চালাব। শাকসবজি হয়ত হবে। কৃষি উপদেষ্টা মহোদয় এ নিয়েই কথা বলেছেন আমাদের সঙ্গে। তিনি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন-যেসব উঁচু জায়গা আছে; বিশেষ করে কৃষি প্রশিক্ষণণ ইনস্টিটিউট (এটিআই), কৃষির গবেষণা ইনস্টিটিউটসমূহ, অন্যান্য পতিত সরকারি জমি, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান নাবী জাতের রোপা আমন ধানের বীজতলার জন্য ২/৩ একর করে জায়গা দিচ্ছে। ফেনী, কুমিল্লা ও আশেপাশেও কিছু জায়গা পাওয়া গেছে।’
‘‘যেহেতু এখন কৃষকদের বীজ দিয়ে লাভ নেই, তাই চারা উৎপাদন করে বিনামূল্যে পৌছে দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। আমরা কিছু প্রযুক্তিগত সহযোগিতাও কৃষকদের দিচ্ছি যা লিফলেট আকারে বিতরণ করা হবে। সম্প্রচার মাধ্যমগুলোতেও প্রচার করা হবে। প্রচার করা হবে বেতার ও কমিউনিটি রেডিওতেও’’-যোগ করেন এই জ্যেষ্ঠ কৃষি কর্মকর্তা।
তিনি আরও জানান, ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়ে বন্যা পরবর্তী সময়ে কৃষকরা কী ধরণের ফসল করতে পারে তাও পরামর্শ দেওয়া হবে। পানি সরতে যদি সেপ্টেম্বর মাস চলে যায় তাহলে তো ধানের কথা আর চিন্তা করা যাবে না। তখন শীতকালীন শাক-সবজি করতে হবে। উচু বেডে চারা করে আগাম সবজি কিভাবে করা যায় সে চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টা করতে হবে ভুট্টা-সরিষার মতো ফসল আবাদ করে যাতে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যায়। সরকার চেষ্টা করছে কৃষকদের সার-বীজ প্রণোদনা দেওয়ার ।
সাম্প্রতিক বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও বন্যা পরবর্তী করণীয় বিষয়ে কৃষি সচিব ড. এমদাদ উল্লাহ মিয়ান এর সভাপতিত্বে কৃষি মন্ত্রণালয় গৃহীত ১২টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়-জানান ড. সুরজিত সাহা রায়।
প্রণোদনাবৃদ্ধি ও পুনর্বাসন কর্মসূচিতে জোর দেওয়া সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে-
১.অতিরিক্ত পরিচালক, উপপরিচালক, উপজেলা কৃষি অফিসার এবং কৃষি সম্প্রসারণ অফিসারগণের সমন্বয়ে টিম গঠন করে দুর্যোগ মোকাবেলায় সম্ভাব্য করণীয় নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে;
২. চলমান কৃষি প্রণোদনা ও পুনর্বাসন কর্মসূচি জোরদার করতে হবে;
৩. বন্যায় ক্ষতি মোকাবেলার জন্য উপযুক্ত জাতের আমন ধানের বীজের পর্যাপ্ত সংস্থান ও সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে;
৪. অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় আপদকালীন বীজতলা তৈরীর কাজ শুরু করতে হবে;
৫. নাবী জাতের রোপা আমন ধান চাষে কৃষকদের পরামর্শ দিতে হবে;
৬. নাবী জাতের ধানের বীজ দেশের বন্যামুক্ত এলাকা হতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে;
৭. বন্যা কবলিত ঝুঁকিপূর্ণ গুদামে রক্ষিত সার নিরাপদ জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে;
৮. আগাম জাতের শীতকালীন সবজি উৎপাদনের বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে;
৯. বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতার লক্ষ্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণপূর্বক মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব প্রেরণ করতে হবে;
১০. বন্যা দুর্গত এলাকার কৃষি অফিসসমূহে সকল কর্মকর্তা/কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়;
১১. বন্যা দূর্গত এলাকার সার্বক্ষণিক তথ্য সরবরাহের লক্ষ্যে উপজেলা, জেলা, অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপনপূর্বক হালনাগাদ তথ্য সরবরাহ করতে হবে;
১২. বন্যা কবলিত এলাকায় সরকারি অফিসসমূহের মালামাল নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করতে হবে।
এ পর্যন্ত পাওয়া ক্ষয়ক্ষতির চিত্র
গত ১৬ আগস্ট থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে আক্রান্ত ফসলি জমির ক্ষয়ক্ষতির তুলনামূলক তথ্য দিয়েছে কৃষি তথ্য সার্ভিস।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, কৃষিতথ্য সার্ভিসের ৮টি অঞ্চলের সবখানেই এ বন্যায় আউশ, রোপা আমন, রোপা আমন বীজতলা ও শাকসবজির আবাদ কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কুমিল্লা, সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চল। এর মধ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।
বন্যা কবলিত কুমিল্লা অঞ্চলের মধ্যে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর জেলায় আউশ, রোপা আমন, রোপা আমন বীজতলা ও শাকসবজির আবাদ হয় ১ লক্ষ ৮৪ হাজার ৫৮ হেক্টর। এখন পর্যন্ত আক্রান্ত ফসলি জমির পরিমাণ ৮৪ হাজার ১৪৫ হেক্টর।
সিলেট অঞ্চলের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলায় ৩ লক্ষ ৫৬ হাজার ৭৭০ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে বন্যা কবলিত ৫৪ হাজার ৬৭১ হেক্টর এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত চট্টগ্রাম অঞ্চলের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষীপুর জেলার ৪ লক্ষ ৬ হাজার ৯২০ হেক্টর ফসলি জমির মধ্যে ১ লক্ষ ৮২ হাজার ৪২৩ হেক্টর জমি। এছাড়া ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাঙ্গামাটি, বগুড়া ও খুলনা অঞ্চল মিলে সারাদেশে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মোট ৩ লক্ষ ৩৭ হাজার ৪১০ হেক্টর আবাদি জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নাবী আমন ধান চাষ ও পরিচর্যায় জরুরি করণীয়
চলতি আমন মওসুমে দেশের যেসব অঞ্চল বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে এবং জমির ফসল ও বীজতলার চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে সকল এলাকায় আমন ধান চাষ যাতে বিঘ্নিত না হয় সে জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বন্যা পরবর্তী সময়ে কৃষকদের জরুরি করণীয়সমূহ জানিয়ে তা অনুসরণ করতে বলেছেন। করণীয়সমূহ হচ্ছে-
১) বন্যা উপদ্রুত সকল এলাকায় ব্রি উদ্ভাবিত আলোক সংবেদনশীল উফশী জাত যেমন- বিআর৫, বিআর২২, বিআর২৩, ব্রিধান৩৪, ব্রিধান৪১, ব্রিধান৪৬, ব্রিধান৫৪ এবং আলোক সংবেদনশীল স্থানীয় জাত যেমন - নাইজারশাইল, রাজাশাইল, কাজলশাইল ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরাসরি বপন এবং ১৫ সেপ্টেম্বর এর মধ্যে রোপণ করতে হবে। এক্ষেত্রে গোছাপ্রতি ৪-৫ টি চারা ঘন করে ২০ ১৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে রোপণ করতে হবে।
২) বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ব্রি ও বিনা উদ্ভাবিত স্বল্প জীবনকালীন জাত যেমন- ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৭১, ব্রিধান৭৫, বিনা ধান-৭ এবং বিনা ধান-১৭ সরাসরি বপন পদ্ধতিতে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত শুধুমাত্র নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষীপুর ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন্যা আক্রান্ত এলাকায় চাষ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কাদাময় জমিতে অংকুরিত বীজ বপন করা ভালো। রোপণ পদ্ধতিতে ধান চাষের ক্ষেত্রে ১২-১৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হবে। লক্ষ্যণীয় যে, এ সকল জাতে উল্লিখিত বপন সময়ের ক্ষেত্রে নভেম্বরের ১৫-৩০ তারিখ পর্যন্ত প্রজনন পর্যায়ে দিন ও রাতের গড় তাপমাত্রা একটানা ৩-৫ দিন ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর নিচে থাকলে ধানের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উল্লেখ্য বন্যা উপদ্রুত কুমিল্লা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, চাঁদপুরসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে স্বল্প জীবনকালীন জাত এ মুহূর্তে চাষ করা যাবে না।
৩) যেসব এলাকায় বীজতলা করার উঁচু জমি নেই সে সমস্ত এলাকায় ভাসমান বা দাপোগ বীজতলা অথবা ট্রেতে চারা তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে। ভাসমান বীজতলার ক্ষেত্রে কচুরিপানা ও মাটি দিয়ে কলার ভেলায় ভাসমান বীজতলা করা যেতে পারে। দাপোগ বীজতলার ক্ষেত্রে বাড়ির উঠান বা যেকোন শুকনো জায়গায় কিংবা কাদাময় সমতল জায়গায় পলিথিন, কাঠ বা কলাগাছের বাকল দিয়ে তৈরি চৌকোণা ঘরের মত করে প্রতি বর্গমিটারে ২-৩ কেজি অংকুরিত বীজ ছড়িয়ে দিতে হবে। এভাবে তৈরিকৃত ১২-১৫ দিন বয়সের চারা মূল জমিতে প্রচলিত পদ্ধতি বা ট্রা্ন্সপ্লান্টারের সাহায্যে রোপণ করতে হবে।
8) বন্যা-উপদ্রুত এলাকার উঁচু জমিতে অথবা নিকটবর্তী যে সমস্ত এলাকায় বন্যা হয়নি সে সব এলাকায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তত্তাবধানে প্রয়োজনীয় পরিমাণ বীজতলা তৈরির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে বন্যা-উপদ্রুত এলাকায় বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে চারা বিতরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে আমন ধানের আবাদ নিশ্চিত করা যায়।
৫) বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ার পর যেসব ক্ষেতের ধান গাছ বেঁচে আছে সেসব গাছের পাতায় কাদা বা পলিমাটি লেগে থাকলে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার ৭ দিন পর পরিস্কার পানি স্প্রে করে পাতা ধুয়ে দিতে হবে।
৬) বন্যার পানি নেমে যাওয়ার ৮-১০ দিন পর ধান গাছে নতুন কুশি দেখা দিলে বিঘা প্রতি ৭-৮ কেজি ইউরিয়া এবং ৫-৬ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করুন। এছাড়াও গাছের বৃদ্ধি পর্যায় বিবেচনা করে অনুমোদিত মাত্রার ইউরিয়া ও পটাশ সার প্রয়োজন অনুযায়ী উপরি প্রয়োগ করতে হবে। সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে অর্থাৎ অতিরিক্ত সার ব্যবহার করা যাবে না।
৭) বন্যায় আক্রান্ত হয়নি এমন বাড়ন্ত আমন ধানের গাছ (রোপণের ৩০-৪০ দিন পর্যন্ত) থেকে ২-৩ টি কুশি শিকড়সহ তুলে নিয়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ধান ক্ষেতে রোপণ করা যেতে পারে।
৮) বন্যামুক্ত বা বন্যা উপদ্রুত এলাকায় যেখানে আমন ধানের বেশী বয়সের চারা (সর্বোচ্চ ৬০ দিন বয়স্ক) পাওয়া যাবে তা বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর গোছাপ্রতি ৪-৫ টি চারা ঘন করে ২০ %& ১৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে রোপণ করতে হবে। উল্লেখ্য, শেষ চাষের সময় প্রয়োজনীয় টিএসপি (বিঘা প্রতি ১০ কেজি) ও এমওপি (বিঘা প্রতি ১৪ কেজি) সার প্রয়োগ করতে হবে এবং রোপণের ৭-১০ দিন পর বিঘা প্রতি ২০-২৫ কেজি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
৯) নাবীতে বপন অথবা রোপণের ক্ষেত্রে ধানের স্বাভাবিক ফলন নিশ্চিত করার জন্য খরায় আক্রান্ত হলে প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
১০) বন্যা পরবর্তীতে ধান গাছে খোলপোড়া এবং পাতাপোড়া রোগ হতে পারে। সুষম মাত্রায় সার ব্যবহারসহ খোলপোড়া রোগ দমনে প্রোপিকোনাজল/নেটিভো/এমিন্টার টপ বিকাল বেলা অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। পাতাপোড়া রোগ দমনে বিঘা প্রতি অতিরিক্ত ৫ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
১১) বন্যা পরবর্তী সময়ে ধান ক্ষেতে পাতা মোড়ানো এবং বাদামি গাছফড়িং এর আক্রমণ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সমন্বিতত বালাই দমন ব্যবস্থাপনাসহ নিয়মিত মাঠ পর্যবেক্ষণ করে ব্যাপক আক্রমণ হওয়ার পূর্বেই উপযুক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
লক্ষ্মীপুরের উত্তর জয়পুর গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা সিরাজুল ইসলাম। থাইল্যান্ড থেকে আনা ‘থাই গোল্ড’ জাতের পানি কচু চাষ করে এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন তিনি। চলতি বছরের কচু চাষ থেকে প্রায় ৬ লাখ টাকা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে এই সফল কৃষি উদ্যোক্তার।
প্রথমে প্রবাসী বন্ধুর মাধ্যমে থাইল্যান্ড থেকে ২৮০ টি থাই গোল্ড জাতের কচুর চারা গাছ এনেছিলেন সিরাজুল ইসলাম। চারাগুলো বড়ির পাশের ৫ শতাংশ জমিতে লাগানো হয়। বছর না ঘুরতেই সেই চারা থেকে এক বিঘা জমিতে প্রায় ২ হাজার কচুর ফলন হয়েছে।
সিরাজুল ইসলাম জানান, এ জাতের প্রতিটি কচুর উচ্চতা ১২ ফুট পর্যন্ত এবং কাঠের ওজন ( ডাল ছাড়া মূল কচু) ৪০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এ ছাড়া প্রতিটি লতির দৈর্ঘ ৪ ফুট ও বেড় ১২ মিলি মিটার হয়ে থাকে। বর্তমানে তার চাষকৃত একটি কচুর ওজন ৪ মাসে ২০ থেকে ২৫ কেজি ও উচ্চতা প্রায় ৮ ফুট পর্যন্ত হয়েছে এবং ৮ থেকে ১০ পিস লতির ওজন ১ কেজি হয়েছে। তিনি আশা করছেন আগামী চার মাসের মধ্যে তার চাষ করা প্রতিটি কচু ৪০ কেজি ওজন হবে।
সিরাজুল ইসরামের কচু চাষের সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে সাধারণ মানুষ কচু ক্ষেত দেখতে ছুটে আসছেন। তিনি জানান ইতিমধ্যে ১০ জন চাষীকে এ কচুর চাষ করার জন্য চারা দিয়েছেন। তার কচু ক্ষেতে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোক ঢুকে হাত উঁচু কররেও বাহির থেকে দেখা সম্ভব হয়না।
লক্ষ্মীপুর জেলার সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের উত্তর জয়পুর দৌলত বাড়ির স্কুল শিক্ষক মরহুম আজহারুল ইসলাম মাষ্টারের তৃতীয় পুত্র সিরাজুল ইসলাম। তিনি ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) এর চাকরি ছেড়ে এলাকায় ফিরে শখের বসে নার্সারী দিয়ে বিভিন্ন জাতের ফলজ, বনজ, ফুল ও সবজির চারা উৎপাদন শুরু করেন। পশাপাশি তিনি এলাকার যুবকদের হাতে কলমে চারা উৎপাদন করা শিখাতে থাকেন। তার কাছে চারা উৎপাদন শিখে ইতিমধ্যে ৫০ জন বেকার যুবককে স্বাবলম্বী করে তুলেছেন। তিনি কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। সিরাজুল ইসলাম বর্তমানে লাউ, কলা, লেবু চাষ করে যাচ্ছেন। কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন ফসল চাষ করে স্বাবলম্বী সিরাজুল ইসলাম ইউটিউবে থাইগোল্ড জাতের কচুর চাষ দেখেন। পরে তিনি তার বন্ধুর মাধ্যমে থাইল্যান্ড থেকে এ কচুর চারা সংগ্রহ করে চাষ শুরু করেছেন।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাজারে তার উৎপাদিত কচুর লতি নিয়ে গেলে মানুষ এক নজর তার উৎপাদিত কচুর লতি দেখার জন্য ভীড় জমিয়ে ফেলেন। বর্তমানে তিনি তার ক্ষেতে উৎপাদিত কচু বিক্রি শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে ২০টি কচু চার হাজার টাকা বিক্রি করেছেন। তিনি জানান সব কিছু ঠিক থাকলে চলতি বছর কচু চাষ থেকে তার ৬ লাখ টাকা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
এলাকার আরেক সবজি চাষী মো. শরীফ বলেন, সিরাজুল ইসলাম থেকে তিনি ইতি মধ্যে থাই গোল্ড জাতের কচুর চারা নিয়ে লাগিয়েছেন। সিরাজুল ইসলাম একজন সফল উদ্যোক্তা। তার কাছে কৃষি চাষাবাদ বিষয়ে পরামর্শ নিয়ে অনেকেই আজ স্বাবলম্বী হয়েছেন।
উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. শাহ জাহান বলেন, সিরাজুল ইসলামের কচুর ক্ষেত আমি সরেজমিনে দেখে এসেছি। এ কচুর চাষ সম্প্রসারণে সহযোগিতা করবো।