হজ পরবর্তী জীবনের শিক্ষা ও করণীয়

  • মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মসজিদে হারামের বারান্দা ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল হাজীদের একাংশ, ছবি: সংগৃহীত

মসজিদে হারামের বারান্দা ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল হাজীদের একাংশ, ছবি: সংগৃহীত

জিলহজ মাসের ৯ তারিখ (২০ আগস্ট, সোমবার) পবিত্র হজপালন সম্পন্ন হয়েছে। সৌদি আরবের পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্যমতে এবার ১৬৫টি দেশের ২৩ লাখ ৭১ হাজার ৬৭৫ জন নাগরিক হজপালন করেছেন।

বিপুল পরিমাণ হাজীরা ইতোমধ্যে শুক্রবার (২৪ আগস্ট) থেকে নিজ নিজ দেশে ফিরতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশ থেকে চলতি (২০১৮) বছর ব্যবস্থাপনা সদস্যসহ ১ লাখ ২৭ হাজার ২৯৮ জন যাত্রী হজপালনের জন্য সৌদি আরব গেছেন।

বিজ্ঞাপন

সোমবার (২৭ আগস্ট) থেকে বাংলাদেশি হজযাত্রীদের ফিরতি হজ ফ্লাইট শুরু হবে। সর্বশেষ ফিরতি হজ ফ্লাইট হবে আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর। বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে লক্ষাধিক মানুষ হজপালনের জন্য সৌদি আরব যান।

হজ একটি ফরজ ইবাদত। হজের অনেক ফজিলতের অন্যতম একটি হলো- হজের মাধ্যমে মানুষ অতীত জীবনের যাবতীয় গুনাহ থেকে মুক্তি লাভ করে। তবে বান্দার হক (মানুষের অধিকার সংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়া) ব্যতীত। এ প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তির আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ করে এবং সকল অশ্লীল ও গুনাহর কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকে সে সদ্যজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়।’ –সহিহ বোখারি:১/২০৬

অর্থাৎ হজ মানুষের জীবনের সব গুনাহ মুছে দেয়। তবে মানুষের কোনো হক অনাদায়ী থাকলে তা ব্যতীত। এজন্যই হজে যাওয়ার আগে হজের প্রধান প্রস্তুতি হচ্ছে মুরব্বিদের কাছ থেকে দোয়া নেওয়া ও কারো হক অনাদায়ী থাকলে তা পরিশোধ করে দেওয়া। আর পরিশোধ করা সম্ভব না হলে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া।

আমরা জানি, হালাল উপার্জনের টাকায়, আল্লাহর প্রেমের ব্যাকুলতায়, আল্লাহর রাস্তায় নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার এক দৃপ্ত প্রশিক্ষণের নাম হজ। প্রবৃত্তির অনুসরণ, মনের খেয়ালখুশি ও অহংবোধের অস্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে মনের কাবায় শুধু আপন রবকে স্থান দেওয়া এবং মনে সর্বদা এ অনুভূতি জাগ্রত করা যে আল্লাহ আমাকে দেখছেন, এটাই শিক্ষা দেয় হজ।

ইমানি চেতনা দৃঢ়করণসহ মনের মাঝে আল্লাহর প্রেম সৃষ্টি এবং নিজে থেকে শুরু করে পরিবারের সদস্যদের ইসলামি মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্যই মূলত হজ ও কোরবানি। যাতে হজের পর হাজী পরিবারের সদস্যরা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হন ইসলামি অনুশাসনের আদর্শ ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে। আর কোরবানিকারী পরিবার পরস্পরে আত্মত্যাগের শিক্ষায় শিক্ষিত হন- ঔদার্য, সততা ও নৈতিক শক্তিবলে।

প্রতি বছর সারাবিশ্ব থেকে লাখ লাখ হাজী সাহেব হজে যান, কাবা তাওয়াফ করেন, হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করেন, সাফা-মারওয়া দৌঁড়ান, মিনায় শয়তানের প্রতি ঘৃণাভরে পাথর নিক্ষেপ করেন, পশু কোরবানী দেন, জমজমের পানি পান করেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা জিয়ারত করেন, হজরত ইবরাহিম (আ.), হজরত হাজেরা (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.)-এর জীবনের প্রেমময় ঘটনার অনুসরণে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান শেষে দেশে ফেরেন।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Aug/26/1535279472503.jpg

পবিত্র কাবাকে সামনে রেখে নামাজ আদায় করছেন তাওয়াফকারীরা, ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু ভেবে দেখার বিষয় হচ্ছে- তাদের ত্যাগ, আদর্শ ও মূল্যবোধের শিক্ষা হজ-পরবর্তী সময়ে কতজনের জীবনে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়? অথচ পাপাচার, মিথ্যা, হিংসা, বিদ্বেষ, অসৎ ব্যবসা, সুদ, মুনাফেকিমুক্ত হয়ে সৎ ও সুশৃঙ্খল ইমানি জীবনযাপন করা হচ্ছে হজের শিক্ষা।

বর্তমানে পৃথিবীতে নামাজীর সংখ্যা বাড়ছে, হাজীর সংখ্যাও বাড়ছে। অন্যদিকে মুসলমানদের সমাজে অপশাসন-শোষণ, জুলুম-অত্যাচার, হিংসা-বিদ্বেষ, মিথ্যা, পাপাচার ও বঞ্চনা কমছে না। নিষ্পাপ হওয়ার পরিবর্তে পাপের পঙ্কিলতায় ডুবছে পৃথিবী। এর কারণ কী?

হজ করতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ধর্মপ্রাণ মুসলমান দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে, কাজকর্ম ছেড়ে, অনেক অর্থ ব্যয় করে মক্কা-মদিনা যাচ্ছেন। তবুও সেই নিষ্পাপ হাজির সংখ্যা বাড়ছে না কেন? যাদের চরিত্র, কর্ম ও আচরণের ছোঁয়ায় সমাজ, দেশ ও জাতি সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও আদর্শবান হবে?

যারা হজ-পরবর্তী সময়েও আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্যের আশায় হজের প্রশিক্ষণ কাজে লাগবেন। ইমানি চেতনা বৃদ্ধি করে নৈতিক চরিত্রের উত্তরোত্তর উন্নতি সাধন করবেন। ইবরাহিমী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পরিবার গঠন করবেন এবং মানুষকে ঐক্য ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করবেন।

হজ থেকে ফিরে আশা মানে কাবার দূত হয়ে আদর্শবান মানুষ হিসেবে ইসলামের শিক্ষা, আদর্শ ও বাণী নিয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়া। মানুষকে সঠিক ইসলামি শিক্ষার দাওয়াত দিয়ে শান্তিময় পৃথিবী গড়ে তোলা। হজ থেকে ফিরে এসে শুধু চল্লিশ দিন ভালোভাবে শরিয়তের বিধিবিধান মেনে চলে পরবর্তী সময়ে শরিয়তের বিধিবিধান হুকুম-আহকামের রশি খুলে একেবারে মুক্ত হয়ে যাওয়া নয়!

আমাদের মনে রাখতে হবে, নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাতসহ সব ইবাদত হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। হজ ও কোরবানিও তদ্রূপ।

সবাইকে মনে রাখতে হবে, শুধু ইবাদতের ক্ষেত্রে নিয়তের বিশুদ্ধতা আর একনিষ্ঠতা যথেষ্ট নয়। বরং জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি কাজে নিয়তের বিশুদ্ধতা দরকার। সেই সঙ্গে বর্জন করা দরকার, লোক দেখানো মনোভাব ও হারাম উপার্জন। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘হারাম উপার্জন দ্বারা গঠিত শরীর দোজখের জ্বালানি হবে।’

তাই মুসলমানদের শুধু আচরণীয় হজ পালনের মাধ্যমে দায়িত্ব শেষ- এটা মনে করলে চলবে না। বরং বিশ্ব মানবতার শান্তি ও কল্যাণের জন্য সবাইকে উৎসর্গিত ও নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে। মানুষের অন্তর থেকে পাশবিক শক্তি ও চিন্তা-চেতনাকে দূর করতে হবে।

ইসলাম শিক্ষা দেয়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে নিজে পাপমুক্ত থাকার ও অন্যকে পাপমুক্ত রাখার। কিন্তু বর্তমান পরিবেশে যেহেতু গুনাহ থেকে বাঁচা কঠিন কাজ, তাই এ পরিবেশে পাপমুক্ত থাকার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্যে থাকা। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়া, তাদের কথা মান্য করা।

এছাড়া নিম্নোক্ত আমলগুলো নিয়মিতভাবে করে যাওয়া-

১. প্রতিদিন নিয়মিত কোরআনে কারিম তেলাওয়াত করা।
২. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে তাকবিরে উলার সঙ্গে আদায়ের চেষ্টা করা।
৩. প্রতিদিনের ফরজ ও সুন্নত নামাজের পাশাপাশি নফল নামাজের অভ্যাস গড়ে তোলা।
৪. নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাদ পড়তে চেষ্টা করা।
৫. প্রতিদিন ইস্তেগফার, দরূদ শরিফ ও অন্যান্য দোয়া-জিকির ইত্যাদি পাঠ করা।

প্রিয় হাজী সাহেবান! আসুন, আমরা ইসলামের দেখানো পথে জীবন পরিচালনা করি। হজের গুরুত্ব অনুধাবন করে, হজ-পরবর্তী জীবন সেভাবে পরিচালনা করি।