মক্কা নগরী (সৌদি আরব) থেকে: স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) সকাল ৮টা। মসজিদে হারামের দেয়ালে লাগানো স্ক্রিনে দেখাচ্ছে তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যদিন তাপমাত্রা সকালেই ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রিতে ওঠানামা করে। বইতে থাকে গরম ও লু হাওয়া।
আজও বাতাস বইছে, কিন্তু তা ঝড়ো বাতাস। রোদের তেমন তেজ নেই, তবে রয়েছে ভ্যাপসা গরম। কিন্তু গত সোমবার (৫ আগস্ট) সন্ধ্যা থেকে বাতাস বইছে, তবে সেটা লু হাওয়া নয় অনেকটা ঝড়ো বাতাস, ধূলিযুক্ত বাতাস। দৃষ্টিসীমার মধ্যেই অন্ধকার দৃশ্যমান।
বিজ্ঞাপন
আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখে কিং আবদুল্লাহ গেটে দায়িত্বপালনকারী অফিসার হাম্মাদ নেসারের কাছে জানতে চাইলাম, হাবিবি! আকাশ নতুন বউয়ের মতো ঘোমটায় মুখ ঢেকেছে কেন? তিন বললেন, ‘বন্ধু! এ মেঘ খুব একটা সুবিধার নয়। ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস। যেকোনো সময় ভারী বর্ষণ হতে পারে।’
এখানকার মেঘ-রোদের লুকোচুরির হিসেব হজপালনকারীদের সবার জানা নেই, তবে তারা অপেক্ষায় আছেন বৃষ্টির। যে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কাবার তাওয়াফ করবেন, হাতিমে কাবায় মিজাবে রহমতের নিচে ভিজে মোনাজাত করবেন, মাতাফে দাঁড়িয়ে নফল নামাজ আদায় করবেন।
কমবেশি হজপালনকারীদের চাওয়া থাকে বৃষ্টির। হজের আগে হজপালনকারীরা সেই বৃষ্টিরই অপেক্ষা করছেন। অনেকে তো বৃষ্টিতে ভেজার আশা নিয়ে মসজিদের হারামে অবস্থান করছেন, কখন আসবে কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি।
হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতে আর বাকি মাত্র দু’দিন। এ সময়টাতে হজপালন করতে আসা সবাই মক্কা মোকাররমে অবস্থান করেন। যে কারণে এখন মক্কায় প্রচুর ভিড়। মসজিদে হারামের চারপাশের রাস্তাগুলোতে নামাজের দেড় থেকে দুই ঘণ্টা আগেই লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। ফলে বন্ধ করে দেওয়া হয় প্রবেশপথগুলো। তখন মসজিদে হারামের এক্সটেনশন অর্থাৎ নতুন হারামে প্রবেশ করতে হয় নামাজের জন্য।
জারওয়াল, গাজা ও জান্নাতুল মোয়াল্লা এলাকার হোটেল কিংবা বাড়িতে ওঠা হজপালনকারীরা সহজে প্রবেশ করার সুযোগ পান নতুন হারামে। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয় মিসফালা, কেদুয়া ও আজিজিয়া এলাকায় অবস্থানরত হজযাত্রীদের। তাদেরকে অনেকটা পথ ঘুরে নতুন হারামে প্রবেশ করতে হয়। না হলে নামাজ আদায় করতে হয় রাস্তায়। তারপরও ক্লান্তি নেই কারও মাঝে। নামাজের সময় হওয়ার অনেক আগে থেকেই মানুষ যেতে থাকেন মসজিদে হারামের দিকে। লক্ষ্য একটাই মক্কায় অবস্থানকালীন সময়ে মসজিদে হারামে নামাজ আদায় করা।
লোকে-লোকারণ্য মক্কা। দলে দলে হজপালনকারীরা আসছেন। প্রত্যেক রাস্তায় ইহরাম পড়া মানুষের জটলা, মুখে তালবিয়া- লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...।
মূলত হজের আগের সময়টাতে হজ পালনকারীরা মসজিদের হারামে নামাজ আদায় এবং তাওয়াফ করে সময় কাটান। অনেকে শুধু নামাজ আদায় না করে বিশ্রাম নেন, যেন মূল হজের আনুষ্ঠানিকতায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। তারপরও প্রচুর ভিড়, প্রতি মুহূর্তেই আসছেন হজপালনকারীরা। আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ দর্শনের আজন্ম ইচ্ছা বলে কথা।
মুসলমান মাত্রই বায়তুল্লাহ তথা কাবাঘর দর্শন এবং তাওয়াফের তীব্র আকাঙ্ক্ষা লালন করেন মনে। যে কাবাঘরের দিকে মুখ করে প্রতিদিন নামাজ আদায় করেন সেই ঘরকে সরাসরি সামনে রেখে নামাজ আদায় এবং আল্লাহতায়ালার কাছে নিজেকে সমর্পণ, তার ঘরের সামনে বসে তার কাছে মোনাজাতের অনুভূতিই আলাদা। যে অনুভূতির বলে বা লিখে বুঝানো মুশকিল।
কাবাঘর হচ্ছে প্রথম ঘর, যা মানুষের ইবাদতের জন্য নির্মিত হয়েছে এবং যেকোনো উপাসনালয়ের চেয়ে কাবা ঘর বেশি প্রাচীন। সেই কাবাকে ঘিরে গড়ে ওঠা মক্কার অলিগলিতে এখন শুধু ইহরাম পরিহিত মানুষের ভিড়, আর তালবিয়ার আওয়াজ- লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...। এভাবেই লাখো কণ্ঠের তালবিয়ার আওয়াজ মক্কার পাহাড়ে ভাজে ভাজে ধাক্কা খেয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে ইথারে।
কাবাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর হজের সময় ৩০ লক্ষাধিক মুসলমানের সমাগম ঘটে। এ ছাড়া সারাবছর ওমরা পালনের জন্য ছুটে যান আরও কোটি মানুষ। এই ছুটে যাওয়ার পেছনে এক অনাবিল ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি ও আধ্যাত্মিক আবেশ কাজ করে থাকে। যার দৃশ্যমান হয় হজযাত্রীদের চেহারায়। ভিড় ঠেলে, পায়ে হেঁটে ও গরম বাতাস উপেক্ষা করে কাবা পানে ছুটে যায় লাখো মানুষের ঢল। কিন্তু কারও মুখে নেই বিরক্তি। উল্টো বিনয়ের চূড়ান্ত প্রকাশকে বেশি দেখানোর প্রতিযোগিতা চলে। সাম্য আর ভ্রাতৃত্ববোধ এই মহাসম্মিলনের দেখা মেলে শুধু হজেই। মক্কায় উপস্থিত হজযাত্রীরা এখন সেই হজের অপেক্ষায়।
গত জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত মদিনার মসজিদে নববিতে এক কোটি মানুষ নামাজ আদায়ের পাশাপাশি রাসুলের রওজা জিয়ারত করে সালাম পেশ করেছেন।
হারামাইন প্রশাসন জানিয়েছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা জিয়ারতকারী পুরুষের সংখ্যা ৫৮ লাখ ৮৩ হাজার ৩৮৫ জন। আর নারী পুণ্যার্থীর সংখ্যা ৪৭ লাখ ২৬ হাজার ২৪৭ জন।
রিয়াজুল জান্নাতে নামাজ আদায়কারীর সংখ্যা দৈনিক ৪৮ হাজারে পৌঁছেছে। রিয়াজুল জান্নাতের আয়তন ৩৩০ বর্গমিটার, ধারণক্ষমতা ঘণ্টায় ৮০০ জন। এখানে একজন নামাজি গড়ে দশ মিনিট সময় পায়। এখানে প্রবেশের জন্য চারটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। নুসুক ও তাওয়াক্কালনা অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন নিশ্চিত করা, ই-ডিভাইস থেকে কিউআর কোড স্ক্যান করা, তারপর কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর রিয়াজুল জান্নাতে প্রবশে করা।
প্রশাসন আরও জানিয়েছে, ‘মসজিদে নববি, রিয়াজুল জান্নাত ও রওজায়ে আতহারে আগতদের উন্নত পরিষেবা দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে আগতদের সুবিধার প্রতি লক্ষ্য রেখে রিয়াজুল জান্নাতে প্রবেশের অপেক্ষার সময় এক ঘন্টা কমানো হয়েছে। দর্শনার্থীদের ১১টি ভিন্ন ভাষায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি জমজমের পানি বিতরণ এবং প্রতিবন্ধী ও বৃদ্ধরা বিশেষ সেবা পাচ্ছেন।’
গত বছর মদিনায় দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪১ লাখ। সেখানে চলতি বছরের ১০ মাসেই দর্শনার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়েছে।
মদিনা মোনাওয়ার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সৌদি সরকার মদিনার পর্যটনের প্রসারে ব্যাপক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। ঐতিহাসিক স্থানগুলো সংস্কার করে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে, দর্শনার্থী বৃদ্ধির মূল কারণ এটাও।
পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর মদিনায় আসা পর্যটকরা খরচ করেছেন ৪৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন রিয়াল।
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, মদিনায় পরিদর্শনকারীদের থাকার সময়ও বেড়েছে আগের তুলনায় বেশি। এখন জিয়ারতকারীরা গড়ে ১০ দিন করে মদিনায় অবস্থান করেছন। এ কারণে হোটেল এবং অ্যাপার্টমেন্টের বুকিং উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
মসজিদে নববিতে আগত মুসল্লি ও দর্শনার্থীদের স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে নামাজ ও অন্যান্য ইবাদত নিশ্চিত করতে এর তত্ত্বাবধানকারী প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ প্রয়োজনীয় সব সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
পবিত্র হজ ও উমরাপালনের আগে বা পরে মুসল্লিরা মসজিদে নববিতে যান। ইসলামের দ্বিতীয় এই সম্মানিত স্থানে এসে তারা নামাজ আদায়ের পাশাপাশি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র রওজা জিয়ারত করেন এবং ঐতিহাসিক স্থানগুলো পরিদর্শন করেন।
চলছে পবিত্র হজের নিবন্ধন। আগামী বছরের হজযাত্রীদের ব্যস্ততা ধীরে ধীরে বাড়ছে। হজ একটি ফরজ ইবাদত, বান্দার সঙ্গে রবের সেতুবন্ধন তৈরি হয় হজের মাধ্যমে। বিধানমতে, পরিবারের আবশ্যকীয় খরচ বাদে যে ব্যক্তির কাছে মক্কা শরিফ থেকে হজ করে ফিরে আসা পর্যন্ত যাতায়াতের মোটামুটি খরচ পরিমাণ অর্থ থাকে তার ওপর হজ ফরজ।
এই ফরজ কাজে যাওয়ার আগে দরকার প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা। সক্ষম প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য একবার হলেও হজ সম্পাদন করা আবশ্যক। হজযাত্রীদের প্রস্তুতি আগেভাগে সেরে নেওয়া উচিত।
হজের অনেক বিধি-নিষেধ আছে। সাধারণত এসব বিষয় আলোচিত হয় না। তাই সফরের আগেই হজবিষয়ক সব বিষয় জানা থাকা উচিত। হজের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। বিদায় হজের সময় নবী কারিম (সা.) সাহাবিদের হজ বিষয়ে সব কিছু জানতে বলেছেন।
হজরত জাবির বিন আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি রাসুল (সা.)-কে কোরবানির দিন তার বাহনে চড়ে প্রস্তর নিক্ষেপ করতে দেখেছি। তখন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলছিলেন, ‘তোমরা হজের বিধান সম্পর্কে জেনে নাও। কেননা আমি জানি না, এই হজের পর আমি আর হজ করতে পারব কি না।’ -সহিহ মুসলিম : ১২৯৭
তাই হজের বিষয়গুলো অভিজ্ঞ আলেমদের থেকে জানা প্রয়োজন। বিশেষত যেসব কারণে হজের বিধান ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জরিমানা দিতে হয় সেসব বিষয়ে বিস্তারিত জানা উচিত। পাশাপাশি নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হজের জন্য প্রস্তুত রাখা। যেন সুস্থভাবে হজের পুরো কার্যক্রম পালন করা যায়। তা ছাড়া হজভ্রমণের আগে অসিয়ত লিখে যাওয়া ও সঙ্গী নির্বাচনে সচেতন হওয়া উচিত।
বিজ্ঞ আলেমরা বলেন, সব ধরনের খরচ ও হজ প্যাকেজ সম্পর্কে ধারণা রাখা। হজে যাওয়ার আগে স্পষ্টভাবে জেনে যাবেন, কোন প্যাকেজে যাবেন। হজ এজেন্সি আপনাকে কোন কোন সুবিধা ও সেবা দেবে। হোটেল কোন মানের হবে, খাবার কেমন হবে, আগেভাগে যাবেন, আগেভাগে ফিরে আসবেন; নাকি হজের আগ-মুহূর্তে গিয়ে শেষে আসবেন? এসব বিষয়ে অভিজ্ঞদের পরামর্শ নেবেন।
মনে রাখতে হবে, অর্থবহ হজের জন্য হজ এজেন্সি ও প্যাকেজ নির্বাচন জরুরি। নাহলে, মক্কা-মদিনায় নানারকম বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। সম্পর্ক নষ্টের পাশাপাশি ইবাদত-বন্দেগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুতরাং যারা এ বছর হজে যাবেন, বিষয়গুলো আগেই খোলাসা করে নেবেন।
হজযাত্রার আগেই অন্তরে এই সৌভাগ্য লাভের উপলব্ধি থাকা উচিত। আর এ কথা মনে রাখতে হবে, এটি সাধারণ কোনো ভ্রমণ নয়; বরং তা মহান রবের প্রেমে ভরপুর অন্তরের মিলনমেলা। তাই এই ভ্রমণের সব দুঃখ ও কষ্টকে সৌভাগ্যের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করা উচিত।
হজযাত্রায় নানা এলাকার, নানা শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়। মুখের ভাষা, সামাজিক অবস্থান ও গায়ের রং ভিন্ন হলেও সবার পরনে শুভ্র সেলাইহীন কাপড়। অনেক মতপার্থক্য থাকলেও সবাই এখন আল্লাহর ঘরের অতিথি। তাই সবার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করা হজযাত্রীদের প্রধান কর্তব্য। অনেক হজযাত্রী ও এজেন্সি এটা মনে রাখেন না। এমন মনোভাব কোনোভাবেই কাম্য নয়।
কারণ, হজ কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় পালন করা। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রাসুল (সা.)-এর সুন্নত অনুসরণ করে সব আমল করা। পার্থিব খ্যাতি, সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্য হজপালন নয়।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আনাস বিন মালেক (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবী কারিম (সা.) (উটের) পুরনো জিনে বসে হজ করেছেন। আর এর ওপরে ছিল চার দিরহাম বা তারও কম দামের একটি কাপড়। অতঃপর রাসুল (সা.) বলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি এই হজ কবুল করুন। এতে লৌকিকতা ও প্রচারণার কিছু নেই।’ -ইবনে মাজাহ : ২৮৯০
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কর্ণফুলী নদী হয়ে সাগরপথে সৌদি আরবের জেদ্দা বন্দর ছুঁয়ে পবিত্র নগরী মক্কা-মদিনা। একটা সময় এভাবেই জাহাজপথে হজপালন করতে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেশে যেতেন এই অঞ্চলের মানুষ।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাংলাদেশ থেকে সেই জাহাজযাত্রা থেমে যায় বহু দশক আগেই। একেবারেই ভাটা পড়ে যাওয়া জাহাজ পথে হজ করতে যাওয়ার আলোচনায় ফের জোয়ার আসে এক বছর আগে।
তবে দেশের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর ওই আলোচনাও প্রায় মুছেই গিয়েছিল। সম্প্রতি বালাদেশ থেকে সমুদ্রপথে হাজযাত্রী পাঠানোর প্রস্তাবে সৌদি সরকার সম্মতি দেওয়ার পর নতুন করে আশা জাগাচ্ছে জাহাজে চড়ে হজে যাওয়ার স্বপ্ন।
৬ অক্টোবর সৌদি আরবের জেদ্দায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন এবং সৌদি হজ ও উমরাবিষয়ক মন্ত্রী ড. তাওফিক ফাউজান আল রাবিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে সৌদি মন্ত্রী এই সম্মতির কথা জানানোর পর আলোচনা হচ্ছে কবে থেকে শুরু হবে এই জাহাজপথে হজযাত্রা। আবার প্রশ্ন উঠছে আদৌ কি এটি সফল হবে এই পরিকল্পনা? কেননা জাহাজপথে হজযাত্রায় যেমন আছে সুবিধা, তেমনি যে আছে চ্যালেঞ্জও।
বাংলাদেশের হজযাত্রীদের জন্য সমুদ্রপথে জাহাজ নামার প্রাথমিক আলোচনা চলছিল বহুদিন ধরে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান জাহাজে হজযাত্রীদের নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কোম্পানি লিমিটেডকে (আইআইএফসি) দিয়ে সমীক্ষাও চালায়। আইআইএফসি জাহাজ চলাচলকে কার্যকর বলেছে। এরপর প্রতিষ্ঠানটি একটা প্রস্তাবনাও তৈরি করেছিল। সেই প্রস্তাবনা অনুযায়ী জাহাজপথে যাওয়া-আসাসহ হজের পুরো কার্যক্রম সম্পন্ন করতে ২৭ দিন সময় লাগবে। জাহাজে গেলে উড়োজাহাজের চেয়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ কমবে।
সৌদি হজ ও উমরাবিষয়ক মন্ত্রী ড. তাওফিক ফাউজান আল রাবিয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর জাহাজে হজযাত্রীদের পাঠানোর বিষয়ে নিজের ফেসবুকে তুলে ধরেছিলেন ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। তিনি লেখেন, ‘সৌদি হজ ও উমরাবিষয়ক মন্ত্রী সমুদ্রপথে বাংলাদেশ থেকে হাজি প্রেরণে সৌদি সরকারের কোনো বাঁধা নেই বলে জানিয়েছেন। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে নেবেন। বাংলাদেশকেও জাহাজ কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। পানির জাহাজযোগে ২/৩ হাজার হাজীকে পরীক্ষামূলকভাবে হজব্রত পালনের উদ্দেশে সৌদি আরবে প্রেরণের ব্যাপারে বাংলাদেশ চিন্তাভাবনা করছে।’
এখন নতুন করে আলোচনা শুরুর পর সমুদ্রপথে হজযাত্রী নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত আসে। কেউ কেউ জাহাজে করে হজ করতে যাওয়াকে ইতিবাচক বলেছেন। নানামুখী চ্যালেঞ্জের কথাও তুলে ধরেছেন অনেকে। আশির দশক পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে জাহাজে করে সৌদি আরবে যেতেন হজযাত্রীরা। তখন জাহাজে করে যেতে-আসতে সময় লাগত তিন মাস। দীর্ঘ সময় লাগায় এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায় সেই যাত্রা। তবে এবার সেই সময় অনেকটাই কমে আসছে। সময় কমলেও উড়োজাহাজযাত্রার তুলনায় জাহাজে খরচ কত কমবে- সেটিও আলোচনায় আসছে।
ভাড়া কমবে ৪০ শতাংশ সমুদ্রপথে জাহাজে হজযাত্রীদের পাঠানো গেলে উড়োজাহাজ থেকে ভাড়া ৪০ শতাংশ খরচ কম পড়বে বলে জানিয়েছেন ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন। তিনি সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন , ‘জাহাজে হাজিদের পাঠানো হলে চার্টার শিপ ভাড়া করতে হবে। এটা করতে গেলে আমাদের দুই হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি আমাদের কর্জ দেয়, তাহলে আমরা এটা করতে পারব।’
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুদান নয়, ঋণ নেওয়া হবে উল্লেখ করে ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, ‘সৌদি সরকার থেকে অনুমোদন পেলে সরকারের অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আলাপ করে দুই হাজার কোটি টাকা যদি তারা ঋণ দেন, তাহলে হাজিদের নেওয়া হবে। একটা শিপিং কোম্পানি জানিয়েছে, তারা লাভের আশায় নয়, সওয়াবের আশায় এটা করবে। এটা করা হলে উড়োজাহাজের তুলনায় ৪০ শতাংশ ভাড়া কম লাগবে জাহাজে। আমাদের বন্দর কর্তৃপক্ষ ও শিপিং কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।’
কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, তাদের ব্যবস্থাপনায় হজে যেতে খরচ ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৯৭ টাকা। অবশ্য সেই প্রস্তাবনা দেওয়ার পর প্রতিজনের হজ প্যাকেজ খরচ ৪ লাখের মধ্যে রাখার পরামর্শ এসেছিল মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের হজ প্যাকেজে সরকারিভাবে হজে যেতে সাধারণ প্যাকেজের মূল্য ধরা হয়েছিল ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৮৪০ টাকা। আর নতুন করে চালু করা বিশেষ হজ প্যাকেজের মূল্য ধরা হয়েছিল ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৩২০ টাকা। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ প্যাকেজে উড়োজাহাজ ভাড়া ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮০০ টাকা নির্ধারণ করেছিল হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)। প্রস্তাবনা অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে জাহাজপথে হজে গেলে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত সাধারণ হজ যাত্রীদের সাশ্রয় হতে পারে, যদিওবা জাহাজে দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি সইতে হবে।
এখন এই বিষয়ে আগেই সমীক্ষা চালানো ও প্রস্তাবনা তৈরি করা কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের সঙ্গে অন্তবর্তীকালীন সরকারের আলোচনা হয়েছে কিনা তা অবশ্য জানা যায়নি। কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জাহাজে হজ করতে সময় লাগবে ২৯ দিন! কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের প্রস্তাবনা অনুযায়ী হজের জন্য মোট সময় লাগবে ২৯ দিন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম-জেদ্দা যেতে ৬ দিন, জেদ্দা-চট্টগ্রাম আসতে ৬ দিন এবং হজপালনের জন্য ১৭ দিন সময় লাগবে। যদিওবা হজযাত্রীরা অন্তত ৪০ দিন পর্যন্ত সৌদি আরবে অবস্থান করে বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা ঘুরে ঘুরে দেখেন।
কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল হজযাত্রীরা যতদিন জাহাজে থাকবেন তত দিন পর্যন্ত জাহাজ কর্তৃপক্ষ তাদের সবকিছু দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করবে। বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, চট্টগ্রাম সংলগ্ন কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের নিজস্ব জেটি/টার্মিনাল রয়েছে যেখানে হজযাত্রীরা ওঠা-নামা করতে পারবেন। প্রস্তাবিত ক্রুজ শিপে বিশুদ্ধ খাবার পানি হিসেবে সমুদ্রের পানি মিনারেল ওয়াটারে রূপান্তরের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকবে। হাজিদের সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুরোনো জাহাজ কেনার কথা প্রাথমিকভাবে বলা হলেও, পরে প্রতিষ্ঠানটি জানায় পুরোনো জাহাজ কেনাটা বাস্তবসম্মত হবে না। তার চেয়ে ব্যবহৃত উপযুক্ত জাহাজ বিদেশ থেকে ভাড়া করে এনে হজযাত্রীদের পরিবহনের ব্যবস্থা করল যুক্তিসঙ্গত হবে।
যত চ্যালেঞ্জ সমুদ্রপথে হাজযাত্রী পাঠানোর প্রস্তাবে সৌদি সরকার সম্মতি দেওয়া এই পদক্ষেপকে অনেকদূর এগিয়ে দিলেও রয়েছে বহু চ্যালেঞ্জও। বহু বছর ধরে জাহাজ নিয়ে এই বন্দর থেকে ওই বন্দরে যাওয়া বেশ কয়েকজন নাবিকের সঙ্গে কথা বলে সেই চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে ধারণাও পাওয়া গেছে।
জাহাজপথে স্বাভাবিকভাবে মধ্যবিত্তদের সাড়াই মিলতে পারে বেশি। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা যায় মধ্যবিত্তদের বেশিরভাগই সারাজীবন টাকা জমিয়ে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে হজ করতে যান। প্রবীণদের শরীর এই দীর্ঘ জাহাজ-জার্নির ধকল কতটা সইতে পারে সেটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
জাহাজে হজযাত্রী পরিবহন করতে হলে সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তি সংশোধন করার বিষয়ও আছে। কেননা সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিবছর যে চুক্তি হয়, তাতে উড়োজাহাজের কথা উল্লেখ থাকে, জাহাজের কথা বলা থাকে না। আবার সেই চুক্তি সংশোধন হলেও জলপথে যাওয়া হজযাত্রীদের ইমিগ্রেশন কোথায় হবে, সেটাও আলোচনার বিষয়।
সমুদ্রপথে সময় লাগবে বেশি। এই সময়ে কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেলে তার দায়িত্ব কে নেবে, মাঝ সমুদ্রে কীভাবে হবে তার চিকিৎসা সেটাও ভাবনার বিষয়। যাত্রীদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগেরও একটা বিষয় আছে। সেক্ষেত্রে নেটওয়ার্কবিহীন গভীর সমুদ্রে তারা কীভাবে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন সেটি নিয়েও ভাবতে হবে।
মূলত এসব জটিলতা এড়াতে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ জাহাজপথে যাত্রা থেকে সরে এসেছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী এখন একমাত্র সুদানের মানুষ ২০১৮ সাল থেকে সমুদ্রপথে হজযাত্রা করছেন।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘প্রয়োজনীয় জ্বালানি থাকলে মাঝপথে কোনো বন্দরে না থেমে সরাসরি চট্টগ্রাম থেকে জেদ্দা বন্দরে যাওয়া সম্ভব। তবে জাহাজপথে হজে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্যই হলো খরচ কমানো। এটা একটা সময় নিয়মিত হতো। এখন যদি খরচটা একটা বাস্তবসম্মতভাবে কমানো যায় তাহলে এই পদক্ষেপ ভালো হবে, সাড়া পাবে।’
অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের কথা মনে করিয়ে দিয়ে সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, ‘একটা সময় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকায় হজ প্যাকেজ ছিল। এখন সেটা অনেকটাই বেড়ে গেছে। সেই খরচটা আগে কমানো দরকার। তারপর উড়োজাহাজে যাওয়ার প্যাকেজের সঙ্গে জাহাজে যাওয়ার প্যাকেজের তুলনা করা যাবে। খরচ তুলনামূলক কমলে চ্যালেঞ্জ থাকলেও যাত্রীদের আগ্রহ বাড়বে।’
'তৌহিদ ও রেসালতের আহ্বানে মানুষকে আকৃষ্ট করে এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই চিরায়ত ইসলামী জ্ঞান, মানবতা ও কল্যাণের পথে মানুষকে আলোকিত করতে হবে' বলে আহ্বান জানিয়েছেন ইসলামী চিন্তাবিদ ও শিক্ষাবিদগণ। তাঁরা বলেন, 'সুফি সাধকগণ এদেশের ভাষা, সংস্কৃতি ও মানুষকে আপন করে নিয়ে সমাজের গভীরে ইসলামের বীজ রোপণ করেছিলেন। যার ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ইসলামী দেশের মর্যাদা লাভ করেছে।'
শনিবার (১২ অক্টোবর) সন্ধ্যায় গাউসুল অলি আলি রজা কানু শাহ র ৫ম তম বংশধর হযরত খাজা শাহ্ নূর দরবেশ মাওলা (রাহ.)-এর পবিত্র ১৩তম উরস শরিফ উপলক্ষে খাজা দরবেশ মাওলা রাহ এর গবেষণামূলক জীবনী গ্রন্থ 'নক্ষত্র রাজির অস্তাচল' (মাওয়াকিয়ুন নজুম)-এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান বক্তারা আরও বলেন, 'ইসলামের আধ্যাত্মিক শক্তি আপামর মানুষের মধ্যে জাগ্রত করার মাধ্যমে তাঁদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনকে পরিশুদ্ধ করার বিকল্প নেই। দুর্নীতি, অন্যায় ও অপরাধ প্রতিরোধের যে নৈতিক শিক্ষা ইসলাম দিয়েছে, তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে।'
নাসিরাবাদ নুরীয়া বিষু দরবার শরীফের এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন দরবারের সাজ্জাদানশীন মওলানা মঈনউদ্দীন নূরী সিদ্দিকী আল কোরাইশী।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বার্তা২৪.কম'র অ্যাসোসিয়েট এডিটর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ।
অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড.মুফতি নুর হোসাই, ড. ওসমান মেহেদী ও ড.শেখ সাদী, সুফি গবেষক ড.সেলিম জাহাঙ্গীর, সুফি মেডিটেশন স্কলার খাজা ওসমান ফারুকী, ড.আব্দুল আজিম শাহ, ড.খলিলুর রহমান, প্রফেসর শফিউল গনি চৌধুরী, সুরাইয়া মমতাজ, হাসান মোহাম্মদ কপিল উদ্দীন।