চব্বিশের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে নতুন দল গঠনের কথা শোনা গিয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের অব্যবহিত পরেই। ধীরে ধীরে এই ‘পরিকল্পনা’ পরিণতির দিকে এগুচ্ছে বলেই আভাস দিচ্ছে গণমাধ্যমগুলো। তবে যতোই পরিণতির দিকে গড়াচ্ছে তরুণদের এই নতুন দল গঠন, ঠিক ততোই একে ঘিরে রাজনীতির মাঠে বাগযুদ্ধ বাড়ছে। বিশেষ করে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ছত্রছায়ায় অভ্যুত্থানের তরুণদের দল গঠনের প্রচেষ্টাকে কিংস পার্টি আখ্যা দিয়ে এর সমালোচনায় সরব হয়েছে।
অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক কমিটির ব্যানারে নতুন দল গঠনের দিকে এগুলো তরুণদের প্রতিনিধিরা উল্টো বিএনপিকেই সরকারি ছত্রছায়ায় দেশের প্রথম কিংস পার্টি বলে পাল্টা সুর চড়াচ্ছেন। সর্বোপরি, আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর দেশের রাজনীতির অঙ্গনে নতুন দল গঠন ঘিরে জোরাল বাগযুদ্ধ শুরু হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
নতুন দল গঠন নিয়ে মঙ্গলবার পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর থেকে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
‘খবরের কাগজ’ এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী শক্তিকে নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের লক্ষ্যে কাজ চলছে। ফেব্রুয়ারি মাসকে ডেডলাইন হিসাবে ধরা হয়েছে। ইতোমধ্যে দলের আদর্শিক অবস্থান স্পষ্ট করে গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র তৈরির খসড়ার কাজ গতি পেয়েছে। সেখানে প্রধান্য দেওয়া হচ্ছে প্রচলিত ধারার রাজনীতির বাইরের কিছু বিষয়কে। কোনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, দলের নেতৃত্বে বা পরিচালনায় থাকবে সামষ্টিক চিন্তার প্রয়াস বা ভাবনা।
সম্ভাব্য নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির বরাত দিয়ে দৈনিকটি জানাচ্ছে, অভ্যুত্থানের শক্তিকে সংহত করে গঠন করা জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যরা একটি তারুণ্যনির্ভর রাজনৈতিক দল গঠন করার জন্য এখন কাজ করছেন।
নাগরিক কমিটির নির্বাহী সদস্য আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, ‘অভ্যুত্থানের শক্তি শহিদ ও আহতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করছি। দেশের বিভিন্ন থানা ও উপজেলায় বসবাসকারী এই শক্তিকে আমরা সংগঠিত করার কাজ করছি। গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে অনেক প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে। প্রতিটি প্ল্যাটফর্মের মুখপাত্ররা নাগরিক কমিটির সঙ্গে যুক্ত আছেন।’
তিন ধাপে কাজ করছে নাগরিক কমিটি। প্রথমত, সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে থানা ও উপজেলা পর্যায়ে সারা দেশে কমিটি গঠন করা হচ্ছে। এরপর দেওয়া হবে ওয়ার্ড কমিটি। তারপর তৈরি হবে জেলা কমিটি। দ্বিতীয়ত, একটি গ্রুপ গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরির কাজ করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নাগরিক কমিটির এক নেতা বলেন, ‘খসড়া তৈরির জন্য একটি ছোট আকারের কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। তারা কাজ করছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মতামত এবং দেশের অতীত রাজনীতির পর্যালোচনা, বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শগত পার্থক্যসহ নানা বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’
তৃতীয়ত, দলের শীর্ষ নেতৃত্বে পরিপক্ব কাউকে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ জন্য যোগ্য লোকদের তালিকা করা হচ্ছে। সাধারণ সম্পাদক বা সদস্যসচিব পদে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া কোনো ছাত্রনেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অভ্যুত্থানের শক্তি হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি- দুই প্ল্যাটফর্মই বহাল থাকবে। তারা প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করবে। নতুন দল গঠনের লক্ষ্যে এসব প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন ‘ঘরানার’ লোককে এক মঞ্চে আনার কাজ চলছে। তবে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তরুণদের। অন্যদিকে ভয়েস ফর রিফর্ম, জাস্টিস ফর জুলাই, ইনকিলাব মঞ্চসহ একাধিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি হচ্ছে অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে। নাগরিক কমিটি এসব প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সংযুক্তদের এক ছাতার নিচে আনতে চায়।
কিংস পার্টি আখ্যা দিয়ে বাগযুদ্ধ
‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ এদিন এক প্রতিবেদনে নতুন দল গঠন ঘিরে চলমান বাগযুদ্ধ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক নেতারা বলেছেন, ক্ষমতায় থেকে কিংস পার্টি গঠন করলে ভালো ফল পাওয়া যায় না। রাজনৈতিক দলকে কিংস পার্টি নয়, পাবলিকের পার্টি হতে হবে।
‘ক্ষমতায় থেকে কিংস পার্টি করলে পরিণতি ভালো হয় না’ মন্তব্য করে বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘আমরা প্রত্যাশা করি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে দেশ ভালো দিকে যাবে। যে বিষয়গুলো মানুষ ইতিবাচকভাবে নেবে সেগুলো সরকার বিবেচনায় আনবে। বিতর্কিত কোনো বিষয় নিয়ে কাজ করা হলে বিতর্ক বাড়বে। তাই দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য যেগুলো অপরিহার্য সেগুলো নিয়ে কাজ করা উচিত।’
রিজভী আহমেদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দেশবাসীর অনেক প্রত্যাশা। আমরা আশা করি এ সরকার আওয়ামী সরকারের পুনরাবৃত্তি করবে না। এ সরকার মানুষের কাছে আরও বেশি প্রসারিত হতো যদি দ্রুত একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করত।’
তবে বিএনপিকে দেশের প্রথম কিংস পার্টি উল্লেখ করে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেছেন, ‘লুটতরাজ করতে পারবে না তাই জুজুর ভয় দেখাচ্ছে বিএনপি।’
সুর চড়িয়ে বিএনপিকে নিয়ে তিনি বলেন, ‘বিএনপির দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা আমাদের কিংস পার্টি বলছেন। আসলে তারা জনগণকে একটা জুজুর ভয় দেখাচ্ছেন। এটা তাদের নিজেদের ভয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত কি না খুঁজে দেখা প্রয়োজন। আমরা বলেছি সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে, এ ইস্যুতে তারা একমত হতে পারেননি। তারা হয়তো মনে করেন, সংবিধান পরিবর্তন হলে দেশের নীতিনির্ধারণী জায়গাগুলোতে যদি বড় পরিসরে পরিবর্তন বা সংস্কার হয় তাহলে তাদের দলের বিভিন্ন অংশে যে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, লুটতরাজ ও সন্ত্রাস হয় এগুলো তারা করতে পারবে না। এগুলোর ইতিহাস তো আছে তাদের।’
সামান্তা শারমিন বলেন, ‘বিএনপি এ মুহূর্তে যে নতুন সংসারের স্বপ্ন দেখছে, সেই সাজানো সংসার হয়তো আর হবে না- এ কারণে তারা হয়তো আমাদের কিংস পার্টির অপবাদ দিচ্ছে। আমরা প্রত্যাশা করি, তারা এ দেশের তরুণ সমাজের প্রাণের আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পারবে এবং এ ধরনের জুজুর ভয় দেখানো থেকে বিরত থাকবে।’
‘অন্যরা জাতীয় নির্বাচন দ্রুত চাচ্ছে আর আমরা দেরিতে চাচ্ছি বিষয়টি এমন নয়। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, সংস্কার প্রস্তাবনা কমিশনগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে’-বলেন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি ও গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষনেতা মাহমুদুর রহমান মান্না নাগরিক কমিটি ও বিএনপি’র চলমান বাকযুদ্ধ নিয়ে বলেন, ‘বিএনপি জনগণের দল। ৩০-৪০ বছর আগে গঠিত এই দল পুরোমাত্রায় জনগণনির্ভর একটি রাজনৈতিক দল। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে- জিয়াউর রহমান সাহেব ক্ষমতায় থাকাকালে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। কিন্তু এটাকে প্রথম কিংস পার্টি বলা যায় কি না- সেটা ভেবে দেখতে হবে।’
‘তারা গণহত্যার বিচার চাইতেই পারে। বিচার প্রক্রিয়া শুরু হোক এটা সবাই চায়। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর জাতীয় নির্বাচন- এটা যৌক্তিক কোনো কথা হতে পারে না। কারণ গণহত্যার বিচার শেষ করতে যদি পাঁচ-দশ বছর সময় লেগে যায়- তাহলে কি পাঁচ-দশ বছর ভোট হবে না? এটা কোনো কথা না’-যোগ করেন মান্না।