চিকিৎসার টাকা যোগাড়ে ট্রেনে ট্রেনে ঘুরছে ‘জন্মকুজো’ শিশু আশরাফ

ঢাকা, জাতীয়

নাছরিন আক্তার,গ্রাফিক্স ডিজাইনার,বার্তা২৪.কম | 2023-08-18 22:39:50

১০ বছর বয়সী আশরাফুল ইসলাম। ডাক নাম আশরাফ। বুকে-পিঠে দু’দিকে উঁচু হাড়। দেখলেই প্রথম দৃষ্টিতে মনে হবে- এই বুঝি চামড়া ছিঁড়ে বেরিয়ে এলো হাড়টি! উচ্চতা টেনেটুনে আড়াই ফিট হবে।

রোববার (২৬ জানুয়ারি) দুপুরে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে রাজশাহীগামী বিরতিহীন বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনের বগিতে বগিতে যাত্রীদের কাছে ঘুরে ফিরছে সে।

সাহায্য তোলা বা ভিক্ষা করার জন্য ট্রেনের বগিতে ঘুরছে আরও অনেক প্রতিবন্ধী শিশুই। তবে সবার দৃষ্টি যেন আশরাফের দিকেই!

কণ্ঠে তার ভিন্ন কাকুতি-মিনতি। জড়ানো কণ্ঠে জপে চলেছে, ‘জন্মকুজো আশরাফ আমি ভাই। ১০/২০টা টাকা দ্যান আমায়! পিঠ-বুকটা অপারেশন করাবো।’

নিজের চিকিৎসায় নিজেই ঘুরে ফিরছে আশরাফ/ ছবি: বার্তা২৪.কম

থেমে থেমে সে বলছে, ‘জন্মের পর থেকে চিৎ-কাত হয়ে শুইতে পারি নাই! সারাডা রাইত জ্বালা-যন্ত্রণায় ঘুমাইতে পারি না। আমি একবার একটু শান্তিতে ঘুমাতে চাই!’

ছবি তুলতে গেলেই আশরাফ বলতে শুরু করে, ‘আপনি কি সাংবাদিক আপা? ছবিডা তুলে একটু বড়লোক মানুষগো দেহান। মানুষগো বলেন- আমার অপারেশনের জন্য কিছু ট্যাকা দিতে।’

তোমার বাবা-মা নেই -প্রশ্নে শিশু আশরাফ বলে, ‘আব্বা মরে গেছে। মায়ের লগে জয়দেবপুর থাকি। মা আমারে নিয়ে ট্যাকা তুলতো। এহন মায়ের অসুখ। মা সামনের বগিতে দাড়ায় আছে!’

একটু এগিয়ে গিয়ে দেখা মিললো আশরাফের মা হাসিনা বেগমের। পায়ে বড় টিউমার। জানালেন এক চোখে দেখতে পান না তিনি। একমাত্র ছেলের চিকিৎসা এবং রুটি-রুজির তাগিদে বাস-ট্রেনে সাহায্য তোলেন হাসিনা।

মায়ের সঙ্গে শিশু আশরাফ/ ছবি: বার্তা২৪.কম 

ছেলে আশরাফের ব্যাপারে হাসিনা বেগম বলেন, ‘জন্মের পর পিঠ একটু উঁচু দেখে সবাই বলেছিল- তেল মালিশ করলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বয়স যত বাড়ছে, ওর বুকে-পিঠের হাড়ও তত বড় হচ্ছে। ডাক্তার বলেছে- এক বছরের মধ্যে অপারেশন করাতে। এক লাখ টাকা লাগবো। কিন্তু এতো ট্যাকা পাবো কই?’

হাসিনা বলতে থাকেন, ‘ওর বাপ-ই ছেলের অপারেশন করাতে টাকা জমাচ্ছিল। ১৮/১৯ হাজার ট্যাকা হয়ছিলও। ফুটপাতে সবজির ব্যবসা করতো। দুই বছর আগে একদিন বাড়ি থেকে মাথায় করে বেগুনের ঝুড়ি নিয়ে স্টেশন দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় ট্রেন এক্সিডেন্টে মারা গেল। এখনো আছে সেই ট্যাকাও। সাহায্য তুলে আরও ২২ হাজারের মতো জমাইছি। আরও ৬০/৬৫ হাজার ট্যাকা হলে ছেলেটার অপারেশন করাবো।’

আশরাফকে কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন হাসিনা। অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন, ‘আমার দুনিয়ায় আপন বলতে আর কেউ নেই, শুধু আমার আশরাফ। নিজেও হাজারটা রোগে ভুগছি। ওকে সুস্থ করে তোলার আগে যেন আল্লাহ আমাকে না নেয়, সেই দোয়া করবেন।’

চিকিৎসার টাকা যোগাড়ে ট্রেনে ট্রেনে ঘুরছে ‘জন্মকুজো’ শিশু আশরাফ/ ছবি: বার্তা২৪.কম

আকুতি জানিয়ে তিনি বললেন, যদি পারেন পরিচিতদের কিছু সহযোগিতা দিতে অনুরোধ করবেন। দিলেন নিজের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরও (০১৩১১ ৬৫২৯২৬)।

হাজারো যাত্রী নিয়ে ঝকঝক শব্দ তুলে গন্তব্যে ছুটে চলেছে ট্রেন। আর ‘ঝ’ বগি থেকে সাহায্য চাইতে চাইতে সামনের বগির দিকে এগিয়ে চলেছে আশরাফ।

বনলতা এক্সপ্রেস বিরতিহীন হলেও থামবে নিশ্চয়ই কোনো এক স্টেশনে। কিন্তু ‘জন্মকুজো’ আশরাফকে নিয়ে অজানা গন্তব্যে ছুটছেন হাসিনা বেগম! যে ছুটে চলা আর সংগ্রামের সমাপ্তি জানেন না তিনি নিজেই!

এ সম্পর্কিত আরও খবর