ফিলিস্তিনের ইতিহাসজুড়ে রয়েছে আল্লাহর নবী হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের অসংখ্য স্মৃতি। ফিলিস্তিনের একটি শহর নবী হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর উদারতা এবং অতিথিদের খাওয়ানোর উত্তরাধিকারের রীতি এখনও বয়ে চলেছে।
ফিলিস্তিনের ছোট শহর ‘মদিনাতু খলিল বা খলিল শহর’ নামে বিখ্যাত। যা হেবরনের পুরাতন এলাকায় অবস্থিত। এই শহরে ‘মসজিদে ইবারহিম’ নামে অতি পরিচিত একটি মসজিদ রয়েছে। মসজিদটি আর অন্য দশটি মসজিদের মতো নয়। এখানে শুধু নামাজ হয় না। এখান থেকে বিতরণ করা হয় খাবার।
মসজিদ সংলগ্ন একটি রেষ্ট হাউস রয়েছে। যেটাকে বলা হয় মুসাফিরখানা। এই মুসাফিরখানায় প্রতিদিন তৈরি করা হয় ফিলিস্তিনের ঐতিহ্যবাহী খাবার। যা বিতরণ করা হয় আগতদের মাঝে। শুধু যে অভাবীরা এখানে অঅসেন খাবার নিতে তা নয়, এখানে অনেকে পর্যটক ও ধনাঢ্যরাও আসেন এই খাবারকে বরকতময় মনে করে খেতে।
খুব বিখ্যাত খাবার নয়, গমগুঁড়া ও গোশত মিশিয়ে ওদেশের জাতীয় খাবার তৈরি করা হয় এখানে। মাঝে-মধ্যে ভেড়ার গোশত, রুটি কিংবা অন্য খাবারও তৈরি হয়। সেই খাবার প্রতিদিন দুপুরে ৫০০ থেকে ৩ হাজার মানুষ পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে থাকেন।
এই খানা তৈরি ও পরিবেশনের জন্য একটি দাতব্য সংস্থা যুগ যুগ ধরে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। শহরের বিত্তবানদের সহায়তায় বছরের প্রতিদিনই এই কর্মসূচি চালু আছে।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী পরবর্তী সময়ে সুলতান কালুন সালেহি ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দে এই মুসাফিরখানা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, খাবার বিতরণের এই ধারা চালু আছে আল্লাহর নবী হজরত ইবরাহিম খলিল আলাইহিস সালামের জামানা থেকে। কারণ তিনি মেহমান ছাড়া খাবার খেতে বসতেন না।
‘তাকিয়ায়ে ইবরাহিমি’ নামে পরিচিত এই খাবার খাওয়ার জন্য দূর থেকে মানুষ সমবেত হন। তাদের থাকার জন্য অত্যাধুনিক রেষ্টহাউস রয়েছে। মসজিদে ইবরাহিমির সম্প্রসারণ ও সংস্কারের জন্য মুসাফিরখানা একটু দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং আধুনিকায়ন করা হয়েছে।
এখানে শুধু একজনকে খাবার দেওয়া হয় এমন নয়, প্রয়োজনে পুরো পরিবারের জন্য খাবার দেওয়া হয়। শর্ত একটাই, খাবার পরিবেশন সহজিকরণ ও ভিড় এড়াতে আগ্রহী পরিবারগুলোকে পাঁচজন লোকের খাবার নেওয়ার মতো বড় পাত্র নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে বলা হয়।
এভাবেই হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামেরর মেহমানদারির ধারা পাঁচ হাজার বছর ধরে বংশানুক্রমে চলে আসছে। খলিল শহরের দানশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এখানে কেউ ক্ষুধার্ত থাকলে আমরা লজ্জিত হবার ভয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করি তার মেহমানদারি করতে, আল্লাহর রহমতে কখনও কোনো অসুবিধা হয় না।
তাকিয়াকে তাবলানিয়াও বলা হয়। আরবি এই শব্দের অর্থ ড্রামের ঘর। কারণ সেখানে কর্মীরা সকাল ও সন্ধ্যায় খাবার তৈরি করার সময় ড্রাম বাজিয়ে আওয়াজ দিতেন। যাতে ইবরাহিমি মসজিদের আশেপাশে আগত অতিথি, ভ্রমণকারী এবং প্রতিবেশীরা শুনতে পায় এবং খাবারে অংশ নেয়।
যুগে যুগে মুসলিম শাসকরা তাকিয়ার জন্য জমিসহ বিভিন্ন কিছু বরাদ্দ করেছেন। বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা ৭২৪ হিজরিতে হেবরন সফর করেন এবং এই তাকিয়ায় খাবার গ্রহণ করেন।
স্থানীয় গমের তৈরি এই খাবারের স্বতন্ত্র একটি স্বাদ রয়েছে, যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। জনশ্রুতি আছে, এখানকার বাবুর্চিরা নিজ নিজ বাড়িতে একই উপকরণ দিয়ে রান্না করলেও এখানকার মতো সুস্বাদু হয় না।
তাকিয়া থেকে রমজান মাসে, মুরগির গোশত, শাকসবজি, মটরশুটি এবং ভাতসহ চর্বিযুক্ত খাবার দেওয়া হয়। রমজানে খাবার গ্রহণকারীদের সংখ্যা বেড়ে যায়। তখন অনেকে এখানে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে থাকেন। কারণ, তাকিয়া হেবরনের পুরাতন শহরের বাসিন্দাদের গর্বের বিষয়।