ভারতের মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’তে ভূষিত হলেন স্বশিক্ষিত মুসলিম আইকন আলি মানিকফান। ২০২১ সালে পদ্মশ্রী প্রাপ্তদের মধ্যে তিনি সবার চেয়ে ভিন্ন। তার নিজস্ব ক্ষেত্রটিই নির্দিষ্ট নয়। সমুদ্রবিজ্ঞান থেকে শুরু করে জ্যোতির্বিদ্যা কিংবা প্রযুক্তিবিদ্যা, সব কিছুতেই সমান পারদর্শী আলি মানিকফান। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, কোনোকিছুতেই প্রথাগত কোনো শিক্ষা নেই তার। তিনি শুধু সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় নয় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সকল যুব সম্প্রদায়ের আইকন হিসেবে পরিচিত।
১৯৩৮ সালে ১৬ মার্চ লাক্ষাদ্বীপের মিনিকয় দ্বীপে জন্ম মানিকফানের। তার পরিবার অভিজাত হলেও পড়াশোনার রেওয়াজ তেমন ছিলো না। অবশ্য তাকে পড়াশোনার জন্য পাশের রাজ্য কেরালা পাঠানো হয়। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর আর কেরালায় থাকতে পারেননি তিনি। ফিরে গেলেন মিনিকয়ে।
তবে ততদিনে নানা বিষয়ে জন্ম নিয়েছে তার আগ্রহ। বাড়ি ফিরে প্রথমেই নিজে নিজে শিখতে শুরু করলেন- দেশ-বিদেশের নানা ভাষা। ইংরেজি, হিন্দি, মালায়ালম তো আছেই; তার সঙ্গে শিখলেন আরবি, ল্যাটিন, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, রুশ, সিংহলিজ, পার্সি, সংস্কৃত, তামিল, উর্দু। তবে শুধু ভাষা শিক্ষার মধ্যেই থেমে থাকল না তার পরিধি।
সমুদ্রের বুকে জন্ম মানিকফানের। তাই অথৈ সমুদ্র আর পানি-প্রকৃতি আকর্ষণ করল সবার আগে। সেই শিক্ষাও নিজের উদ্যোগেই। তবে তার গভীরতা অনেক বিশেষজ্ঞকেও হার মানাবে।
ভারতের সেন্ট্রাল মেরিন ফিশারিজ এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে গবেষণার সময় তিনি প্রায় ২০০ সামুদ্রিক প্রাণী চিহ্নিত করেন। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির মাছও রয়েছে। তার পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করে জীববিজ্ঞানী ডক্টর শান্তপন জোনস আবিষ্কার করে ফেললেন নতুন একটি মাছের প্রজাতি। আর তার নামও রাখা হয় মানিকফানের নামেই- আবুদেফডাফ মানিকফান।
শুধুই কি জীববিজ্ঞান? কারিগরি বিষয়েও তার জুড়ি মেলা ভার। আইরিস অভিযাত্রী দল টিম সার্ভিন তখন পরিকল্পনা নিয়েছিলেন ওমানের সোহার শহরের একটি প্রাচীন জাহাজে চড়ে অভিযানে নামবেন। কিন্তু সেই ভগ্নপ্রায় জাহাজের মেরামতি দরকার। সমস্ত কারিগররাই যখন হাত গুটিয়ে নিলেন, তখন এগিয়ে এলেন মানিকফান। একাই নতুন করে গড়ে তুললেন সেই জাহাজ। আর অভিযানও সফল হলো।
নিজের জীবন দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন প্রকৃতির কোনো ক্ষতি না করেও মানুষের সভ্যতা কীভাবে টিকে থাকতে পারে। তামিলনাড়ুতে তার বর্তমান বাসভবনের আশেপাশের ১৫ একর জায়গা নিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি বায়ুকল। তাও সম্পূর্ণ নিজের হাতে। বাড়ির বিদ্যুতের জন্য পরিবেশ ধ্বংসকারী তাপবিদ্যুৎ ব্যবহার করেন না তিনি। নিজের হাতেই তৈরি করে ফেলেছেন নিজস্ব রেফ্রিজারেটর মেশিন। তার থেকে বাতাসে সিএফসি মেশার কোনো সম্ভাবনা নেই।
লাক্ষাদ্বীপের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মানিকফান। শিক্ষকতা ও সরকারি অফিসের করনিকসহ বিভিন্ন পেশায় যুক্ত ছিলেন।
৮৩ বছর বয়সী এই মানুষটি সাধারণ একটি সাইকেলকে মোপেডে পরিণত করেন, মোপেড নিয়ে তিনি দিল্লি ঘুরে আসেন। মোপেড ঘন্টায় ৬০-৭০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারে। পরে তিনি মোপেডের পেটেন্টও লাভ করেন।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগম আয়োজিত মিলন উৎসব ২০২১ এ আমন্ত্রণ জানানো হয় মানিকফানকে। এই লিভিং লিজেন্ডকে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে সংবর্ধিত করা হয়। উৎসবে তিনি তার বক্তব্যে বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা আমাদের বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের কাজ করে যেতে হবে। তাহলে আমাদের অন্ন সংস্থানের কোনোদিন কোনো সমস্যা হবে না। নিষ্ঠা, ঈমান ও মেহনত দরকার। প্রবল আত্মবিশ্বাস, নিজের প্রতি ভরসা ও মন দিয়ে কাজ করলেই আমরা অসাধ্য সাধন করতে পারি।’
ঠিক কোন বিষয়ে তাকে বিশেষজ্ঞ বলা যায়, তা সত্যিই জানা নেই। অথচ এই বহুমূখী মানুষটির প্রথাগত শিক্ষা মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। প্রতিভাবানরা বোধহয় এমনই হন।
উল্লেখ্য, ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার পদ্ম সম্মান- পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ ও পদ্মশ্রী এই তিন বিভাগে দেওয়া হয়ে থাকে। শিল্প, সামাজিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজ, জন-প্রশাসন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ব্যবসা ও বাণিজ্য, চিকিৎসাশাস্ত্র, সাহিত্য ও শিক্ষা, ক্রীড়া, সিভিল সার্ভিস ইত্যাদি বিভাগে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য এই সম্মান দেওয়া হয়।
ব্যতিক্রমী ও নজরকাড়া পরিষেবা যারা দিয়ে থাকেন তাদের পদ্মবিভূষণে সম্মানিত করা হয়।
নজরকাড়া পরিষেবা যাদের থেকে পাওয়া যায় তাদের পদ্মভূষণ এবং যে কোনো ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য পদ্মশ্রী পুরস্কার দেওয়া হয়।