প্রজন্ম
দীপ্তি সাধারণ না। অসাধারণও না। অতিশয় লীলাবতী। তার আদিখ্যেতার সীমা নেই। আহ্লাদী ঢঙে কথা শুনলেই বলা যায় এ মেয়ে অনেক ঘেড়েল। কথা বাণে কাবু করতে আপনাকে এক মিনিটও সময় দেবে না। আর দেবে কেন? ও কি কারো ধার ধারে? চটাং কথা এমন মধুর করে বলবে যেন এই মাত্র চাঁদের দেশ থেকে ফিরেছে। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। একটু পরে নভোযানে চড়ে ফিরে যেতে হবে। আপনিও বিশ্বাস করে সায় দিয়ে সব কিছু মেনে নেবেন। ঠিক তখন দীপ্তি বলবে, ‘প্রশান্ত দা, নিজেরা তো ভদ্রলোক না। পাড়ায় এক মহিলা এসেছেন, আর অমনি কাঙালের মতো হামলিয়ে পড়েছেন। সবে এসেছে, আপনাদের চেনাজানার সুযোগ হলো না। এরমধ্যে এত কিছু? মহল্লার বড় ভাই সেজে বসে আছেন!’ প্রশান্ত বাবু মাথা নিচু করে বলবে, ‘আমার ভুল হয়েছে, দীপ্তি। বুঝতে পারিনি।’ দীপ্তির এথেলেট হিসেবে খ্যাতি আছে। ইন্টার কলেজ সাইকেলিংয়ে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। বর্শানিক্ষেপে সেরা স্কোরার। প্রতিদিন ব্যায়ামের ট্রাউজার পরে জিমনেশিয়ামের দিকে সাইকেল চালিয়ে যায়। জুনিয়ররা চিৎকার করে ডাকে, ‘দীপ্তি দি। দীপ্তি দি।’
সিটি দিয়েছিল জসিম কাকার বড় ছেলে তাপস। দীপ্তি সাইকেল থামিয়ে বলল, ‘তাপস, আমার খারাপ লাগছে। তুই চালিয়ে নিয়ে ক্লাবে পৌঁছে দে।’ তাপস অতি উৎসাহী হয়ে দীপ্তিকে রডে বসিয়ে ঘোরের মধ্যে নিজ বাড়িতে চলে যায়। বারান্দায় দাঁড়ানো জসিম কাকা। সরাসরি তাঁর সামনে। দীপ্তি বলে, ‘চাচা, তাপস আমাকে সিটি দিয়েছে। আমি ইচ্ছা করলে থাপ্পর মারতে পারতাম। ভাবলাম আপনি তার পূজনীয় পিতা। আপনিই মারুন। একজন কন্যার অপমান তো সহজ কথা না।’ জসিম কাকা অনেকটা বাকরুদ্ধ। তেড়ে মারত গেল তাপসকে। তার আগেই দীপ্তি বাধসেজে সব কিছু ম্যানেজ করে বলল, ‘আজ কাকা মারতে চায়। কাল কিন্তু আমি মারব।’ ব্যাস্। তাপস এক্কেবারে সোজা। সারাক্ষণ ‘দিদি দিদি’ বলে ঘুরঘুর করে।
এই শহরে দীপ্তিকে সবাই চেনে। মায়াময় মুখ। ঢেউ খেলানো বাহারি চুলের ভক্ত অনেক তরুণ। মাঝারি হাইট। উজ্জল চোখে অন্যরকম দ্যুতি আছে। দীপ্তির বয়সী মেয়েদের কেউ তুই বলে না। আপনিও বলে না। দীপ্তিকে বলে। প্রচুর ফ্যান ওর। ঠিক এ সময়ই আত্মহত্যা করে দীপ্তি। শহরে সহস্র মমতা ছড়িয়ে যায়। কী দুঃখ তার? আত্মহননের মতো এরকম সিদ্ধান্ত তার সঠিক হয় নি। ট্রেনার মজিদ ভুঁইয়ার সঙ্গে ওর ছিনালি স্বভাব ছিল। না না না, লাভ রোডের ফাস্ট বোলার রফিক ভাইয়ের সঙ্গে কী যেন শুনেছিলাম! সব গুজব। আসল কথা হলো, দীপ্তির চোখ শেষ দিকে পাংশুটে হয়েছিল! আত্মহত্যার আগে দীপ্তি কিছুই লিখে যায় নি। দীপ্তি দরকার মনে করেনি। যেখানে বসবাস করবে না সেখানে জানিয়ে লাভ কী? এ জীবনের প্রতি ওর তেমন দায় নেই। নেবে কেন? সংসার তো ও রকম না। অনেক দায় এখানে। অযাচিত করুণা কিলবিল করে কান্নার জোরে ভাসতে ভাসতে বলল, এত ব্যাকুল কেন? ছোট্ট এ সময় ফাঁকি দেবে কেন? নিশ্চয়ই দীপ্তির কষ্ট আছে। যা তাকে আত্মহননে প্ররোচিত করেছে।
শহরে দীপ্তির আত্মহত্যা নিয়ে গসিপ ছড়াতে থাকে। স্থানীয় কাগজগুলোয় বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে বিস্তর লেখালেখি হয়। কেন দীপ্তির মতো সম্ভাবনাময় প্রাণ অকালে ঝরে যাওয়া! অনুতাপের বহরে শহর তোলপাড় করা মানববন্ধনসহ শোকসভায় আলোচিত দীপ্তির খুঁটিনাটি জীবন কথা উঠে আসে। পরিতাপের শেষ নেই। শোককাতর শহরের মানুষ মেয়েটিকে মনে রাখতে চায়। যারা একসময় ওর স্পষ্ট কথা নিয়ে নানা কথা বলেছে, তারা আজ বলছে, ‘দীপ্তি সঠিক, আমরাই বেঠিক।’
না দীপ্তি সঠিক না। ও ভীরু। মেরুদণ্ডহীন। এতদিন ওর যা আস্ফালন তা ভড়ং। ওর কোনো শক্তি ছিল না। মনোজগতের পলাতক আসামি। নইলে এত অল্প বয়সে পৃথিবীর প্রতি এত বিতৃষ্ণা কেন? ও তো জীবনে কিছুই দেখেনি। জীবন কত বৈচিত্র আর বেদনার লীলাভূমি! বিচরণ করার সাহস থাকতে হয়। কাউকে বলতে হয়, জগত সংসার তোমার জন্য। দীপ্তি সে কথা বলে নি। বললে হনন ওর ধারেকাছে ঘেষতে পারত না। ক্ষুধায় কাতর জননীর ভূমিকায় ক্লান্ত হতে হয় নি। উজ্জল মুখ চোখের ভ্রু-ভঙ্গি জগৎ দোল খায়। তার জন্য আর্তনাদ, বুকজুড়ে কুটকুট করে কামড়ে দেয়। দীপ্তি হননের আগে কী ভেবেছিলে তুমি! কোনো গভীর ক্রোধ? কোনো প্রেমান্ধ যন্ত্রণা! শূন্যতার নভোমণ্ডলে একখণ্ড ধোঁয়াশা চাঁদ। তাহলে তুমি বাঁচতে চাইতে। এ রকম চাওয়া-পাওয়া মানুষকে বাঁচতে শেখায়। বয়স এতটুক! নীতি কথার বহরে সমাজ বদলে দেবে। তোর মতো পরাজিতরা কিছুই পরিবর্তন করে না। পেছন থেকে কাট মারে। অথর্ব। দীপ্তির পুরুষ্ঠ হাতে লোমশ উপস্থিতি প্রমাণ করে ওর কিউবিক হেয়ার যৌনগন্ধ কাম লুকিয়ে আছে। জাপটে ধরে কোনো তরুণকে বলেনি, ‘আমি ভেনাস।’ বোকা মেয়ে। এই আনন্দের জন্য মনুষ্য জন্ম। এত আয়োজন রেখে চলে যায় কেউ! ধ্যাত। ফজিল মেয়ে। থাপ্পর দিয়ে দাঁতের হালি ফেলে দেওয়া উচিত। লুনাটিক। মৃত্যুর হলোসেশন দেয়াল তৈরি করে দিয়েছে, অতিক্রম করতে পারেনি। মুরত বোঝা গেছে। অযথা এত হাউকাউ।
দীপ্তি হাউকাউ করতে বলেনি। ও তো পৃথিবীর কেউ না। মমতাহীন। মরবিড রাজকন্যে। উদাস চোখ দিয়ে প্রাচীরঘেরা বাড়ির অলিন্দে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে। অনুতাপে দগ্ধ হৃদয় নিয়ে মুক্ত বিহঙ্গকূলের উড়াউড়ি দেখে। আহা! দুঃখি মেয়েটিকে ক্ষমা করে দাও। করুণাই ওর প্রাপ্য। আজ থেকে নয় মাস সতের দিন আগে দীপ্তি বলে, ‘মনিশংকর দা, আপনার তৃপ্তিকে বিয়ে করা ঠিক হয় নি। ও আপনার অবহেলার শিকার।’ তারপর থেকে তৃপ্তির প্রতি সীমাহীন আকর্ষণ জেগে উঠেছে মনি শংকর বাবুর। তৃপ্তি অনুগত নারীর মতো পেছনে ঘুরঘুর করতে থাকে। দীপ্তি, আমরা কৃতজ্ঞ। অসংলগ্ন পদচারণা মানুষকে স্বপ্নহীন করে দেয়। তোমার কোনো স্বপ্ন ছিল না! থাকতেও পারে। মানব জীবন কত পদের? ঘৃণা ধরে যায়! আনন্দের সাম্পানে পাল উঠিয়ে কেউ কি দীর্ঘলয়ে ডাকে নি? ইশারা দিলেই পারতে। কেমন হুমড়ি খেয়ে পড়ত। কুমারী বিনুনির প্যাঁচে পড়ে কত কাহিনী তৈরি হতো। বলত, ওরে বাবা! দীপ্তি! মাফ চাই। ওর বিশল্যকরণী দাওয়াই দরকার নেই। এমনেই ভালো আছি। তুমি বলতে পারো, দরকার নেই। ঠিক আছে। ধরে নিলাম ও খেলোয়াড় হিসেবে দুর্বল। ছলনার পাশা খেলার কুশলী কারিগর হতে পারলে ভালো হতো। জীবনের প্রতি মায়া জন্মাত। ব্যর্থ নায়িকা। প্রেমান্ধ নায়ক পাওনি। হইহই রইরই। দীপ্তি মনি, এই যে তোমাকে নিয়ে কথা! দরকার কী? তুমি কি আমাদের কেউ? এই শহরের মানুষ জানে, পলাতকা কুমারী দীপ্তি রানি শ্মশানের নিভন্ত আগুনের নিচে ছাই হয়ে আছে। ধূসর রঙ ছাই। ভূমিতে ছড়িয়ে দিলে ফসল ভালো হতো। তাও কেউ করেনি। পোস্টমর্টেমের পর পরিতোষ দা বলল, ‘ওকে ঘরে নিয়ে কি হবে?’ শব যাত্রার আগে ওকে স্নানও করানো হলো না। তোমরা এমন কেন দীপ্তি মনি? আমার কিন্তু ঘুষি মেরে পরিতোষ দা’র নাক ভেঙে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল। বলে কী কুলাঙ্গার? জন্ম সহোদর। বোনটির প্রতি এমন মমতাহীন আচরণ কি ঠিক হয়েছে? তুমি বলতে পারো, ‘ঠিক হয়েছে। আমি তো নরকের বাসিন্দা। আমার দায় ওরা নেবে কেন?’ চিতায় তোলার আগে জুবলি রোডের জসিম কাকা একগুচ্ছ রজনীগন্ধা হাতে নিয়ে তার শুভ্র গোঁফ-দাড়ির অন্তরালে শোককাতরোক্তি নিয়ে বলল, ‘মা জননী, সুখে থাক।’ সৌম্যকান্ত বৃদ্ধের সঙ্গে কেউ শরিক হয় নি। না পরিতোষ দা’ না সুখেন কাকা। দীপ্তি আত্মহত্যা করেছে এটাই যেন তার অপরাধ। কারণ খোঁজার আগেই আমাদের দীপ্তি মনি ছাই হয়ে গেছে। চিতার দগ্ধ অনলের পাশে সহজিয়া গাইছে যারা, তারা তোমার ভাই-বন্ধু, পাড়া-প্রতিবেশী। খোল-করতালের দ্রিমিকি শব্দ ভেসে আসছে, ‘সুন্দর দুনিয়া থেকে একদিন চলে যেতে হবে, হায় সুন্দর দুনিয়া...’
শবের নিকট দুনিয়াদারির আখ্যান শুনিয়ে লাভ কী? দীপ্তি কি ফিরে আসবে? কেউ কি কোনোদিন ফিরে আসে? হায়! দুনিয়ার এত রূপ-রস-গন্ধ চিতার অনলে ছাই হওয়া দীপ্তি মনির নিকট প্রয়োজনহীন।
আত্মহত্যার আগের সন্ধ্যেবেলায় দীপ্তির সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি শুনে চমকে উঠে বকুল তলায় দাঁড়িয়েছিলাম। দীপ্তি কি কিছু বলতে এসেছে? ওর তো কোনো সময় লাগে না। সাইকেলের এক প্যাডেলে পা রেখে খুব অবাক তাকিয়ে থাকল কতক্ষণ। কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই সাইকেল চালিয়ে মঠের ওইদিকটায় হারিয়ে গেল। কিছুই বলল না। ওই সময় কিছু কথা মাথায় এসেছিল আমার। বলার সুযোগ ছিল না। দীপ্তির জন্য কিছু মমতা আমার হৃদয়ে জমা আছে। দীপ্তি কি বিশ্বাস করবে? ওর মতো দুরন্ত অকপট নারীর কাছে কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। আমার কথা বলা হয় নি দীপ্তিকে। দীপ্তিও কিছু বলেনি। শুধু ভোর বেলায় সারা শহর চাউর হয়, ‘দীপ্তি গলায় ফাঁস নিয়েছে।’
দীপ্তিকে আমার দেখতে ইচ্ছে হয় নি। চিতার আগুনে ছাই হওয়ার আগ পর্যন্ত ওর চেহারা মনে করতে চাইনি। বকুল তলায় সাইকেলের প্যাডেলে এক পা দেওয়া বাঁকাচোখে তাকানো আবছায়ায় যে ঝিলিক ছিল তা মনে রেখেছি। আর এ শহরের তাবত মনুষ্যকূল দীপ্তি মনি নামক একজন অভিমানি নারীর কোনো কিছুই মনে রাখতে চায় নি। কত বিচিত্র শাখা-প্রশাখা দীপ্তির উপস্থিতি অদৃশ্য হতে হতে এখন বিলীয়মান পাখির ঝাপটা শুনতে পায়। দীপ্তি এখন উপকথা, আতঙ্কিত এক নারীর নামাঙ্কিত সিলমোহর।
পাদটীকা
এতবছর পর দীপ্তি মনিকে নিয়ে একটি কবিতা লিখতে ইচ্ছে হলো। শত চেষ্টা করেও একটা পঙ্ক্তি খুঁজে পেলাম না। দীপ্তি আবারও অনাবিষ্কৃত থেকে যায়।
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ