সবে মিলি করি কাজ

  • তানিয়া চক্রবর্তী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সবে মিলি করি কাজ/ হারি-জিতি নাহি লাজ—এ কথা তো সত্যি যে একার ওপরে আনন্দ, দুঃখ, অপমানের যে ভার জন্মায় একত্রিত হলে তা ভাগ হয়। এসবের নীতিগত গল্প, তথ্য আমরা জানি। কিন্তু এই আলো চকচকে ডবল ইনকাম নো কিডস বাঙালিগণ তথা বং চরিত্র কি ততোধিক সুখী না ভারগ্রস্ত। আসলে আমরা এখন এক একটি বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র একক যা দিয়ে বড় রাশি তৈরি করা যেত বা যায় কিন্তু পুরোটাই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে এক প্রভাবিত ভ্রমে। আর সেটা ক্ষুদ্র থেকে ব্যাপকে ব্যাপৃত। এই বিচ্ছিন্নকরণ ব্যবস্থায় সমাজ থেকে ধর্মে, জাতিতে, চামড়ায় গিয়ে দূরত্বকে বৈষম্যতে রূপান্তরিত করেছে। ফলে যেমন ক্ষুদ্র এককে ডিভোর্স বড় এককে সাম্প্রদায়িকতা।  আমাদের যৌথ হওয়ার কথা ছিল আমরা মৌন হয়ে গেলাম।

সমাজ উদ্ভূত হয়েছিল পরিবার থেকে। জৈবিক ভিত্তি, বন্ধন, নির্ভরতার প্রয়োগ, দর্শনের উত্তরণ, তারপর সূত্রমাফিক চলন—এই ধারাবাহিকতাকে মেনে পরিবার তার সক্ষম চিহ্ন বানিয়েছিল। যেহেতু যুগের প্রারম্ভিকতায় যৌথতা এত নিবিড় আবার এত বিচ্ছিন্ন ছিল যে তার কোনো ধারাবাহিক স্থায়িত্ব আসে না। ফলে যৌনতা, শিল্প, বুদ্ধি, অনুভব—এসব দিয়ে ইউনিট বা একক দল গঠন করার মনোভাব আসে। মধ্যযুগীয় ইউরোপ কোর্টলি লাভের মাধ্যমে ভালোবাসার ফল্গুধারা দিয়ে দুর্গের মধ্যে সনাতন প্রেমপ্রথার প্রচলন করেছিল।

বিজ্ঞাপন

আমার এই কথাগুলো সংঘবদ্ধ শক্তির ক্রিয়াশীলতা অনুভব করে তীব্র, একীভূত পরিবার গঠনের ভাবনা থেকে আসা। এখন আমরা আরো শক্তিশালী, চূড়ান্ত আধুনিক অথচ সহায়তাহীন—সব বুঝেও আমরা ঘনীভূত হতে পারলাম না, তো বং এক্সপ্রেসে এই অংশ তুলে ধরার অর্থ বাঙালি একাকী থাকার জাতি ছিল না। আগেকার দিনের খাওয়ার থালা, উপাচার আর প্রসাদের ব্যপ্তিতে বোঝা যেত বাঙালির হৃদয় তত অসহায় নয়। তারা খেতে পারে খাওয়াতে পারে, বেঁধে রাখতে জানে। আমাদের সেই দড়িবাঁধা কোথায়, কেন এমন হতাশায় ভরে গেছে ১৮/১৯ বাংলার ছেলে-মেয়ে। বাংলায় তো মজা রস ছিল, তার এত হারামি আদুরে তেজ যে সে নিজের দেহ থেকে পড়ে নিজের পা পঁচিয়ে দিত আরে মশাই খেজুর... বুঝলেন না—এখন তো সব আমাদের খেজুরে আলাপ—আর ফেসবুক, ফেসলস গোলাপ।

বাড়িতে একটা মেয়ে কিম্বা ছেলে, দাদু-দিদা বৃদ্ধাশ্রম কিম্বা আলাদা বাড়ি। বাড়ন্ত ছেলেটি দরজা বা জানলা ধরে আকাশ দেখে, কেউ নেই কথা বলার। ছেলে বা মেয়েটি প্রথম প্রেম করে—প্রেমিক বা প্রেমিকা উথলে উঠে সব বলে দেয়—জমে থাকা শব্দের সে কী অবাঞ্ছিত বৃষ্টি—প্রেমিক বা প্রেমিকা সৎ বা অসৎ—বাতাসে উড়ে যায় ধরে রাখার নেশা—বাতাসে ভেসে আসে হারানোর ভয়—প্রেম ভাঙে—একক পরিবারের শিশু আত্মহত্যা করে। এখন ঠাকুমার ঝুলি, রামায়ণ, মহাভারত কেউ পড়ে শোনায় না ওদের। জুড়ে থাকা ভালোরা ত্রিফলা আলোর হয়ে পাখিদের ঘুম ভাঙালো, ওরা উড়ে গেল মধ্যরাতে। বাঙালির দাওয়া ছিল, চণ্ডীমণ্ডপ ছিল, ছিল সারি দিয়ে বসে মাছের মুড়ো চুষে খাওয়া, এ ওর পাতে জুলজুল তাকানো—জন্মেছি ১৯৯০, এসব দেখেনি, তবে প্রাচীনের গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারি কী দুর্বল হয়ে গেছে ভালোবাসা। আমরা যে দুই মাসতুতো ভাইবোন এক তারের দুদিকে দুটো ফোন নিয়ে হ্যালো হ্যালো করতাম—তার সমস্ত তার আজ কাটা—মিসডকল হয়ে পড়ে থাকে দূরের কোনো ডাক—তাদের ফিরে আসা শব্দের অভাবে।

বিজ্ঞাপন

বাঙালির সর্ষের ঝাঁঝ ছিল, ইলিশের নাম ছিল আজও আছে। কেবল বর্ষায় মাদুরের নামে না, ছোট এক চেয়ারে বসে বাঙালির নাতনি এবিসিডি ভিডিও গেম খেলে। আজ কেউ মরে পড়ে গেল, ভয় থেকে দূরে ঘরে এসে বসি। বাসে মেয়েটাকে কেউ কুনজর দিলে চুপ করে নেমে যাই। বাড়িতে দড়ি নেই, ছাদের লম্বা কাপড়ে সারি বেঁধে শাড়িরা ওড়ে না। ওদেরও ছোট ঘর, শুকিয়ে বেরিয়ে আসে—ওয়াশিংমেশিন জানে আধুনিকীকরণে কী সুখ! আমিও বাড়ি ফিরে আসি—সুখে থাকা, নিরাপদে থাকা, বাড়িতে তিনটি প্রাণী, আমাদের যৌথ শক্তি নেই—আমরা পরিবার ভাঙনের উত্তরসূরী তো...