ছাতা মাথার লোকটি

  • ফাহ্‌মিদা বারী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

হাহা হা হা...এখনো আমি হাসি থামাতে পারছি না। মনে হচ্ছে এইরকম দারুণ মজা অনেকদিন পাইনি। কী, আগ্রহ হচ্ছে না গল্পটা শোনার? বলছি শুনুন...
সেদিন হয়েছে কী, স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরলাম। দাঁতের ব্যথায় আমি সারাদিন ক্লাসে অস্থির হয়ে ছিলাম। মোটেও মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। আমার ক্লাস টিচার একবার আমাকে বলেও বসলেন, ‘বাসায় চলে যাও রুনু। আমি তোমার অর্ধেক দিনের ছুটির এপ্লিকেশনটা লিখে দিচ্ছি। তুমি বাসায় গিয়ে একটু আরাম করো।’
টিচারের প্রস্তাবটা খুবই লোভনীয়। ফেলে দিতে মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু মায়ের মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। এমনিতেই তার ধারণা, আমি নাকি সুযোগ পেলেই স্কুল কামাই দিই। থাক বাবা, দরকার নেই!

কষ্টেশিষ্টে পুরো ক্লাসটা শেষ করেই বাসায় যাই।
আমাকে কাঁদতে দেখেই মা ধারণা করে বসল, নিশ্চয়ই ক্লাসে পড়াটড়া পারিনি। টিচার খুব করে মার দিয়েছে। দাঁত ব্যথা করছে বলতেই অর্ধেক বিশ্বাস আর অর্ধেক অবিশ্বাস নিয়ে মা আমার মুখটাকে টেনে হাঁ করালো। তারপরে বেশ চিন্তিত গলাতেই বলল, ‘এত বড় একটা ফুটো হয়ে বসে আছে দাঁতের মধ্যে, আর তোর কোনো খবরই নাই!’

বিজ্ঞাপন

তারপরে স্কুল ড্রেসটাকে কোনোমতে শুধু পাল্টানোর সময় পেলাম।
সেই অবস্থাতেই মা আমাকে নিয়ে রওয়ানা হলো ডেন্টিস্টের কাছে। চকোলেট খেয়ে যতগুলো দাঁত নষ্ট করেছি আমি, মা নাকি আজ ডেন্টিস্টকে বলে সেগুলো সব তুলে ফেলার ব্যবস্থা করবে।  আমার কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেল এমন কথা শুনে। কী সাঙ্ঘাতিক কথা! মা’র ওপরে ভরসা নেই। যা বলছে তা করে ফেলাটা তার জন্য অসম্ভব কিছু নয়।
কিন্তু সবাই কি আর আমার মায়ের মতো এত কড়া হয়?

ডেন্টিস্ট আঙ্কেল আমার সাথে অনেক গল্প করলেন। মজার জোকস শোনালেন। তারপরে আমাকে একটুও কষ্ট না দিয়ে আমার দাঁতের গর্তটাকে সুন্দর করে ভরে দিলেন। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি। আসার সময়ে আমাকে একটা ক্যাডবেরির প্যাকেট দিতেও ভুললেন না। আর সুন্দর করে হেসে বললেন, ‘খাওয়ার পরে দাঁতটা ব্রাশ করে নিও, কেমন?’

বিজ্ঞাপন

আমি চকোলেট হাতে নিয়ে দিদ্বিজয়ী ভঙ্গিতে মায়ের দিকে চাইলাম। মনে মনে ভাবলাম, ‘কেমন এখন?’

ডেন্টিস্ট আঙ্কেলের চেম্বার থেকে বের হতেই দেখি, স্ট্রবেরি মিল্কশেকের একটা দারুণ দোকান। কাচের দেয়ালের এপাশ থেকে দেখা যাচ্ছে, লম্বা লম্বা গ্লাসে সবাই স্ট্রবেরি মিল্কশেক খাচ্ছে। দেখেই আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল।

সবে দাঁতের ফুটো বন্ধ করে আসলাম। মা কি আর এখন আমাকে মিল্কশেক খেতে দেবে?

দুঃখিত চোখে দেয়ালের এপাশে দাঁড়িয়ে অন্যদের খাওয়া দেখছি, এমন সময় আমাকে অবাক করে দিয়ে মা সেই দোকানে আমাকে নিয়ে চলল। মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, হাসি হাসি মুখ। আমার খুশি তখন দেখে কে? আজ কোনদিকে সূর্য উঠেছে কে জানে!

আমি আয়েশ করে সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে মিল্ক শেক খেতে লাগলাম। এদিকে বেলা পড়ে যাচ্ছে। সেই সাথে আকাশে ঘন কালো মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মা’র মুখে আবার সেই চিরাচরিত শক্ত ভাব ফুটে উঠল। আমাকে তাড়া দিয়ে বলল, ‘কী হচ্ছে রুনু? একটু তাড়াতাড়ি করো না! দেখতে পাচ্ছিস না, আকাশে কেমন মেঘ করেছে? এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে!’
‘এই তো, আর একটু!’ আমি আয়েশের রেশটাকে যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত করে মিল্ক শেক শেষ করলাম।

বাইরে বেরিয়ে দেখি কঠিন বিপদ। মা’র দুশ্চিন্তা একেবারে ঠিক আছে। আকাশে ঘন মেঘ। বলতে বলতেই দু’চার ফোঁটা নামতেও শুরু করেছে।

রাস্তা প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে। আর তার চেয়েও ভয়ানক কথা হচ্ছে, রাস্তাতে বলতে গেলে গাড়ি ঘোড়া কিছুই নেই। সব যেন এই কিছুক্ষণের মধ্যে ভোজবাজির মতোই হাওয়া হয়ে গেছে। যে দু’চারটি চোখে পড়ছে, সেগুলো ইতোমধ্যেই যাত্রী পেয়ে গেছে।

আমরা দু’জন অসহায়ের মতো ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভিজছি। সাথে কোনো ছাতাও নেই আমাদের!
আমি বললাম, ‘মা, চল আবার সেই দোকানটায় ফিরে যাই। এখানে থাকলে তো একেবারে ভিজে যাবো!’ আমার মাথায় তখন ঘুরছে আরেক গ্লাস মিল্কশেক! মা যেন শুনতেই পেল না আমার কথা। ব্যগ্রভাবে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। অশান্ত গলায় বলেই ফেলল, ‘ইস! যদি একটা গাড়ি থাকত আমাদের! আর একজন ড্রাইভার!’

এই দুঃখটা মা প্রায়ই করে।
আমাদের অনেক কিছুই থাকতে পারত! আমার বাবা আমাদের সাথে থাকতে পারত! তাহলে হয়তো সবকিছুই আমাদের সাথে থাকত। কিন্তু বাবা তো সেই কবেই আমাদের দুজনকে ছেড়ে...

‘একটু শুনবে মা?’—ডাক শুনে আমি আর মা দুজনেই চমকে পেছনে তাকালাম।
প্রায় সত্তর বাহাত্তর বছর বয়সের একজন অতিশয় বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসে দাঁড়িয়েছেন আমাদের পেছনে। বৃদ্ধ ভদ্রলোকের পরনে পরিপাটি বেশবাস, পায়ে চমৎকার একজোড়া জুতো।
মোচ আর কপালের ভ্রু দুটোই পেকে একেবারে সাদা হয়ে গেছে। ভদ্রলোক মাথার ওপরে খুব সুন্দর একটা ছাতা ধরে রেখেছেন।

মা ভ্রু কুঞ্চিত করে তার দিকে তাকাল, ‘জ্বি, বলুন।’ মা’র কণ্ঠস্বরে আশ্চর্য শীতলতা আর কেমন যেন দূরত্ব বজায় রেখে চলা একটা প্রচ্ছন্ন ভাব। মা’র এরকম রুক্ষতায় খুব খারাপ লাগে আমার। কেন যে মা মানুষের সাথে একটু নরম মোলায়েম হতে পারে না কে জানে! তার মতো সন্দেহবাতিক মানুষ খুব কম দেখেছি আমি। বিশেষ করে দুটি জিনিসের প্রতি তার সীমাহীন সন্দেহ, একটি হচ্ছে সিদ্ধ ডিম আর অপরটি অচেনা মানুষ।

সিদ্ধ ডিমের মাথাটা চামচ দিয়ে ভেঙে নিয়ে এমনভাবে মা উঁকি দেয় যে, মনে হয় ভেতর থেকে বুঝি ইঁদুর বেরিয়ে আসবে। আর অচেনা মানুষের ব্যাপারে মায়ের থিওরি ভারি অদ্ভুত। ‘যাকে যত বেশি মধুর হতে দেখবি, বুঝবি যে তার প্রতি তোর সন্দেহের তত বেশি কারণ আছে।’

এই বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি খুবই বেশি মধুর।

কাজেই মা’র কথানুযায়ী তার প্রতি সন্দেহটা বেশ জোরালো হওয়া উচিত। তবে তিনি যে ভদ্রলোক এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ মা’র আরেকটি বিখ্যাত বচন হচ্ছে, ‘সবসময় একজন মানুষের জুতার দিকে তাকাবি। জুতাটি যদি ভালো হয়, বুঝতে হবে তিনি একজন ভদ্রলোক।’ এই বৃদ্ধ লোকটির জুতোজোড়া দেখে আমার মনে অন্তত তার ভদ্রলোক হওয়ার ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ রইল না।

ভদ্রলোক খুবই কাতর আর নরম গলায় বললেন, ‘মা, আমাকে ছোট্ট একটা সাহায্য করতে পারো? খুব সামান্য একটা সাহায্য। চিন্তা করো না...তুমি আমাকে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পারো। একটা কথাও বানিয়ে বলছি না আমি। আর তাছাড়া রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে... কাউকে থামিয়ে এভাবে কথা বলতে কার ভালো লাগে বলো?

আসলে এই বয়সে মানুষের ভুলে যাওয়ার রোগ হয় তো! আমারও একই দশা! ভুলে আমার মানিব্যাগটা বাসায় ফেলে এসেছি। মনে হয়, সেটা আমার অন্য কোটটার পকেটে ছিল। এখন কী বিপদ দেখ! বাসায় যে ফিরবো সেই টাকাটাও আমার সাথে নেই!’

এবার মা তার সেই বিখ্যাত চুলচেরা দৃষ্টিপাতটা করল ভদ্রলোকের দিকে।

এই দৃষ্টিপাতের সামনে স্বাভাবিক থাকতে পারা যথেষ্ট হিম্মতের ব্যাপার। আমার স্কুলের হেডমিস্ট্রেসকে পর্যন্ত মা’র এই দৃষ্টির সামনে একেবারে তোতলা হয়ে যেতে দেখেছি। তবে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম বৃদ্ধ লোকটির কোনো ভাবান্তর হলো না। তিনি একইরকম স্মিত মুখে মোলায়েম গলায় বলে যেতে লাগলেন, ‘আমি কখনো মানিব্যাগ ফেলে আসি না বুঝলে? আজই প্রথম এই দশা হলো! প্রতিদিনই আমি হাঁটতে বের হই...’
মা’র কণ্ঠস্বর এবারে আরো রুক্ষ্ণ শোনালো।
‘আপনি কি আমার কাছে টাকা চাইছেন?’
‘না না একদম নয়...ছিঃ ছিঃ! তা আমি কেন চাইব?’
‘তাহলে কী চাইছেন তাড়াতাড়ি বলুন। দেখছেন না আমরা ভিজে একসা হয়ে গেছি!’
‘সেই ব্যাপারে সাহায্য করতেই তো আমি এসেছি। আমি দেখলাম তোমাদের সাথে ছাতা নেই। তোমরা বরং এক কাজ করো। আমার এই ছাতাটি নাও...আর বিনিময়ে...আমাকে ট্যাক্সি ভাড়া হিসেবে একশোটা টাকা যদি দিতে...। দেখ, আমার এই ছাতাটি কিন্তু এখনো একেবারে নতুন আর এটা সিল্কের। আমি এটা প্রায় পাঁচশো টাকা দিয়ে কিনেছিলাম।’

আমার মা’র সন্দেহ কিছুতেই দূর হচ্ছে না।

মা আবার প্রশ্ন করল, ‘আপনার কাছে যদি ফেরার জন্য কিছুই না থেকে থাকে তাহলে আপনি আসার পরে কিভাবে ভাড়া মিটিয়েছিলেন?’
‘ওহ্‌, আমি আসলে প্রতিদিন অনেকখানি হেঁটে এসে যাওয়ার পথে একটি ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরে যাই।’
‘বেশ তো! আজ না হয় ট্যাক্সির বদলে হেঁটেই বাড়ি ফিরুন!’
বৃদ্ধ ভদ্রলোক করুণ হাসি হাসলেন। বললেন, ‘তাই যদি পারতাম, তাহলে কি আর আমি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকি? এতদূর হেঁটে আসার পরে আমার পা জোড়ায় আর কোনো শক্তিই অবশিষ্ট থাকে না। এখন আমার পক্ষে আর কিছুদূর হাঁটাও সম্ভব নয়।’

বৃদ্ধ লোকটির কথা শুনে আমার বুকটা ফেটে যেতে লাগল। মা’র প্রশ্ন তবু শেষ হয় না।

‘কিন্তু আপনার ছাতাটা এত দামী! আমি কিভাবে এটাকে মাত্র একশো টাকা দিয়ে কিনি?’ মা’র গলার স্বর অনেকটা নরম হয়ে এসেছে। বুঝতে পারলাম, বরফ গলতে শুরু করেছে।
‘মা গো! আমি যদি এখন বাড়ি ফিরতে না পারি তাহলে আমার এই ছাতা কোন কাজে আসবে?’

মা একটু লোভী চোখে ছাতাটার দিকে তাকিয়ে পার্স খোলার চেষ্টা করতে যেতেই আমার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। আমি চোখ দিয়ে অনুনয় করলাম, ‘প্লিজ মা, এমন করো না। এত দামী ছাতাটার বিনিময়ে মাত্র একশো টাকা দিও না!’

মা’র হাত পার্স থেকে আবার সরে এলো। আবার লোকটির দিকে ফিরে বলল, ‘এক কাজ করি। আমি আপনাকে ট্যাক্সি ভাড়াটা দিয়ে দিই। আপনি বাড়ি চলে যান। আপনার ছাতার আমার দরকার নেই।’

বৃদ্ধ লোকটি একেবারে হা হা করে উঠল এই প্রস্তাবে।
‘না না মা, তা কিছুতেই হতে পারে না। আমি কিছুতেই তোমার কাছ থেকে ভিক্ষা নিতে পারি না। তুমি এই ছাতাটা নিয়ে আমাকে দয়া করে একশো টাকা দাও। আমি আর দাঁড়িয়েও থাকতে পারছি না।’
অগত্যা ‘কী আর করা’ এমন একটা ভাব নিয়ে মা হাত বাড়িয়ে ছাতাটাকে নিলো। আর লোকটিকে একশোটা টাকা দিয়ে দিলো। তাকিয়ে বুঝলাম, মা’র চোখজোড়া খুশিতে চিকচিক করে উঠেছে।
‘কী বলে যে তোমাকে ধন্যবাদ দিব মা! তুমি যে আমার কত বড় উপকার করলে!’—বলতে বলতেই লোকটি বিদায় নিয়ে চলে গেল।

লোকটি চলে যেতেই আমি কিছুটা দুঃখিত মন নিয়েই মাকে বললাম, ‘মা, তুমি লোকটার সাথে প্রথম থেকেই এত সন্দেহ নিয়ে কথা বলছিলে কেন? এত চমৎকার একজন ভদ্রলোক!’
‘হুম, চমৎকার তো বটেই! কিন্তু আমি তাকে ভালোমত যাচাই করে নিতে চাচ্ছিলাম। শোন একটা জিনিস শিখতে হবে তোকে। কোন কাজে তাড়াহুড়া করবি না, বুঝলি? আর বিশেষ করে নতুন কোনো মানুষের ব্যাপারে চট করে সিদ্ধান্ত নিবি না। সময় নিয়ে আস্তে ধীরে বিচার করবি সবসময়, বুঝতে পেরেছিস?’
‘হুম, বুঝলাম!’
মা খুশি খুশি গলায় বলল, ‘লোকটা আসলেই খুব ভালোমানুষ। কী সুন্দর একটা ছাতা মাত্র একশো টাকার বদলে দিয়ে গেল! আজ সত্যিই খুব ভালো দিন। কতদিন ধরে এমন একটা ছাতা কেনার ইচ্ছে ছিল আমার! এই যে...তুই বৃষ্টিতে ভিজছিস কেন এখন? ছাতার নিচে আয়!’

ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি। এখনো আমরা কোন ফাঁকা গাড়ির সন্ধান পাইনি। হঠাৎ সেই বৃদ্ধ লোকটিকে চোখে পড়ল আমার। আশ্চর্য! লোকটা কী দ্রুতগতিতে রাস্তা পার হচ্ছে! মাকে সঙ্গে সঙ্গে দেখালাম, ‘মা মা... দেখো দেখো! সেই লোকটা! কিন্তু লোকটাকে তো এখন একটুও ক্লান্ত বলে মনে হচ্ছে না মা!’
আমার মাও তখন এক দৃষ্টিতে লোকটিকেই দেখছিল। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, দ্রুত গতিতে রাস্তা পার হয়ে সে সুড়ুৎ করে ডান দিকের গলিতে ঢুকে পড়ল। আমি আবার বললাম, ‘সে কোনো ট্যাক্সি ধরবে বলেও তো মনে হচ্ছে না!’
মা’র চোখের দৃষ্টি সুচারু হয়ে এসেছে। চোয়াল শক্ত। গম্ভীর মুখে বলল, ‘সে কিছু একটা ধরার জন্য যাচ্ছে। কী সেটা? জানতে হবে আমাকে। চল!’
এই বলে মা আমার কনুই খামচি মেরে ধরে তার সাথে নিয়ে চলল। আমি ভয়ার্ত মুখে বললাম, ‘মা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
‘ঐ লোকটা কোথায় যাচ্ছে সেটা জানতে। জানতে আমাকে হবেই। সে আমাকে মিথ্যে বলেছে!’

লোকটা আমাদের থেকে মাত্র বিশ গজের মতো সামনে। পেছনে ফিরলেই আমাদের দেখতে পাবে। বৃষ্টির বেগ আরো বেড়েছে। লোকটার কোট ভিজে গেছে বৃষ্টিতে। টুপি থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। সে একেবারে নির্বিকার। আর আমরা তার সিল্কের ছাতার নিচে একেবারে শুকনো হয়ে পথ চলছি।

লোকটি ঠিক যেন খরগোশের গতিতে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে। তার গতির সাথে তাল রেখে চলতে রীতিমত বেগ পেতে হচ্ছে আমাদের। একবার ডানে একবার বাঁয়ে... এঁকেবেঁকে চলতে লাগল সে।

আমি আবারো ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘মা, যদি আমাদের দেখে ফেলে?’
‘ফেললে ফেলুক! আমি ছাড়ব না ব্যাটাকে। আমার সাথে মামদোবাজি! দেখ তো, কোথায় গেল?’
‘ওই যে ওই রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকেছে।’
‘রেস্টুরেন্ট না, পাব!’ মা বিড়বিড় করে বলল।
আমি আবার বললাম, ‘আমরা কি ভেতরে ঢুকবো মা?’
‘নাহ্‌, আমরা কাচের জানালা দিয়ে দেখব ব্যাটা কী করে!’

আমরা দেখতে লাগলাম। ভেতরে একটু ধোঁয়াশা থাকলেও সবকিছু পরিষ্কারই বোঝা যাচ্ছিল। লোকটা তার কোট আর হ্যাট খুলে এসে বসেছে। তারপরে বেয়ারাকে ডেকে কিছু একটার অর্ডার দিলো সে। কিছুক্ষণ পরেই বড় এক গ্লাস পানীয় নিয়ে বেয়ারা এসে দাঁড়াল। বিশাল এক গ্লাস ভর্তি সোনালী পানীয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘গ্লাসে কী মা?’
‘মনে হচ্ছে হুইস্কি!’

মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যে লোকটা ঢকঢক করে পুরো হুইস্কি তার পেটে চালান করে দিলো।
তারপরে তৃপ্তির একটা ঢেঁকুর তুলে তার সাদা মোচের এককোণে জিহবা ঠেকিয়ে চেটে নিলো হুইস্কির শেষ বিন্দুটুকু। কেমন একটা সুখী সুখী ভাব ফুটে উঠেছে লোকটার চোখে মুখে।

বেয়ারা ফিরে আসতেই পকেট থেকে একশো টাকার নোটটা বের করে সামনে রাখল। সেই একশো টাকা!

মা অবাক হয়ে বলল, ‘লোকটা কি পাগল? এই এক গ্লাস হুইস্কির জন্য পাঁচশো টাকার একটা সিল্কের ছাতাকে এত সস্তায় দিয়ে দিলো! তাও আবার এক চুমুকেই শেষ হয়ে গেল!’
আমিও বললাম, ‘লোকটা নির্ঘাৎ পাগল!’

বৃদ্ধ লোকটি উঠে দাঁড়ালো। দরজার পাশে ঝুলিয়ে রাখা হ্যাঙ্গার থেকে তার টুপি আর কোটটাকে তুলে নিলো। তারপরে...খুবই সহজ আর ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে ঝুলে থাকা বেশ কয়েকটি ভেজা ছাতার মধ্য থেকে একটাকে তুলে নিলো। এমনভাবে... যেন সেটা তার নিজেরই!
মা সাথে সাথে বলে উঠলো, ‘দেখলি? দেখলি? কী করল লোকটা?’
আমি হাঁ করে সেটাই দেখছিলাম। লোকটা পাব থেকে বের হয়ে আসতেই আমরা ছাতাটাকে নিচু করে আমাদের মাথাদুটোকে লুকিয়ে ফেললাম, যাতে লোকটার নজরে না পড়ে।

লোকটা ছাতা হাতে বেরিয়ে গেল, ঠিক যেদিক থেকে সে এসেছিল।
মা হাঁ হয়ে থাকা মুখ বন্ধ করে বলল, ‘ওহ্‌! এই তাহলে খেলা!’
আমি এবার অন্য ভয় পেলাম। বললাম, ‘মা, এই ছাতাটার মালিক যদি দেখে ফেলে যে, আমরা তার ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছি... তাহলে কী হবে?’
মা’র মুখ সাথে সাথে পাংশু হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘চল চল...চল এখান থেকে। তাড়াতাড়ি বাসায় যাই...’

(রোল্ড দালের ‘দ্য আমব্রেলা ম্যান’ গল্পের ছায়া অবলম্বনে)

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ