শিমুল সালাহ্‌উদ্দিনের একগুচ্ছ কবিতা

  • শিমুল সালাহ্‌উদ্দিন
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

দৃশ্যের ভেতরে

এটাই সেইখানটা। এবং আমরা সেখানে। এরই ভেতরে। হাঁটছি। কথা বলছি। ধরে আছি হাতে হাত।

বিজ্ঞাপন

এখানেই সেখানটা, যেখানে সবসময় আসতে চেয়েছো তুমি। এই সোনারঙছটা প্রলেপমাখানো গাছের পাতারা যেনে প্রেমপোস্টকার্ড, উড়ছে তোমার দিকে...

জলপ্রপাত ঝরে চলেছে তার পাশে, সন্দেহ বুকে নেই এমন বিরল আশ্চর্য হরিণেরা চড়ে বেড়াচ্ছে ইতস্তত, জানলা থেকে দেখা দৃশ্যের মতো, শ্লথগতিতে চলা অনেক জানলাওয়ালা যানের একটা জানালা থেকে, ভালো রেজ্যুলেশনের একটা ক্যামেরার পিনহোল থেকে দেখা দৃশ্যের মধ্যেই হাঁটছি আমরা, বলছি নিজেদেরকে, শান্তধীর উচ্চারে, 'এই হচ্ছি আমরা, এখানেই অস্তিত্বমান, এবং আমাদের গলার আওয়াজ এমন, যেন আমরা জানালার অনেক অনেক পেছনে অথবা জানালার ভেতরে...

আমরা জড়িয়ে ধরছি নিজেদের গভীর ভালোবাসায় আর দেখছি অসন্দিগ্ধ হরিণ ছুটে যাচ্ছে তার মায়াবী চোখজোড়া নিয়ে সেই মুহূর্তে। ক্যামেরার নিকষ পিনহোলের ভেতর দিয়ে, বাইনোকুলারের যুগল অন্ধসুড়ঙ্গ পার হওয়া মানবিক চক্ষুযুগল দিয়ে দেখছি যে আমরা পুরোপুরি বন্য, আর উদ্বিগ্ন সেইসব দৃশ্য ও চকচকে নিয়তিনির্ভরতা নিয়ে নীরবতা এলো—প্রকৃতি আর তাদের নিঃশঙ্ক অবয়বের অস্তিত্বের কাছে, দেখছি না হয়তো, আবার যেন দেখছি পেছন ফিরে, যেন মনে হচ্ছে, দূর আমাদের কাছ থেকে অনিমেষনেত্র আন্তরিকতা চেয়ে ফিরে যাচ্ছে সবুজে, সবুজ এবং নির্বিবাদী সোনালী দেহের গাছে...

একটি দৃশ্য এভাবে অন্ধ করে দিতে পারে!

অবাঙমানসগোচর

যে লেখে সে আমি না। যে লেখে সে অন্য কেউ।
অথর্ব কি আর ভাঙতে পেরেছে ভাষার সীমানাদেয়াল
আর তার কাঁটাতার?
কিংবা কলজে ছিঁড়ে আনা নতুনের সংসার?

যে লেখে সে আমি না।

সংসারের গোপন ফাটল দেখতে দেখতে
নদীর কিনারে কেটে যাওয়া ছেলেবেলা দেখেছি।
লড়াই জেতা ষাড়ের পৃষ্ঠকুণ্ডির মতো
মাংসল জলের স্রোত-ঢেউ গুনেছি।
খুঁজেছি আমার আমাকেই দেখবার মতো
কোনো আয়না জলের ভেতর।
খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়েছি,
ভেঙে ফেলেছি।

ভাঙন ভাঙন শব্দে নদীর নিজের শুকিয়েছে জল,
একজন মানুষ নদীর উচ্ছিষ্ট জলে পা ধুয়ে
নদী পার হয়ে গেল

আমি নদীর শুকনো বুকের ভেতরের হাহাকার
আর তার চোখের জল দেখতে পেলাম...

বাবা বসে আছে দাওয়ায়। মা বন্ধ চুলোর সামনে।
আমরা ঘরের মেঝেতে দাগ কেটে খেলছি ষোলগুটি।
রান্না হচ্ছে জল।

লাল ঝুটি বেঁধে খুঁপড়ি গাড়িতে স্কুলে যাচ্ছে বোন,
কাঁদতে কাঁদতে, দেয়া যায়নি টিফিন।

এইভাবে ধীরে ধীরে অযুত নিযুত চষাক্ষেত মুহূর্তের ভীড়ে
লাঙল হাতলে বন্দি হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে আমার অনুভব।
শৈশব।

হাঁটাপথে স্কুলে গেছি।
প্রকাশ্য রাস্তায় বিদ্বানের বেশে
বই পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছি সবুজের পাশে।
চয়নিকার ভেতর থেকে আসা প্রজাপতি রঙ ধরে,
ধরে বখতিয়ার খিলজির লাগাম
শূন্যতার অধিক কল্পলোকে রূপান্তরিত হয়েছি
অজেয় অসীম ক্ষমতার ঘোড়সওয়ারে।

কোথায় যাইনি বলো?
অথচ তোমরা আমাকে ভুল গুনেছো।

আমি স্বীকার করি—যে লেখে সে আমি না।
আমার এসব হতাশ্বাস নাবিকের গান আকণ্ঠ গাইবার কথা নয়।

যে লেখে সে আমি না।
সে প্রেমার কোলে বুভুক্ষ হৃদয় ঠোঁট নিয়ে শুয়ে আছে।
যে লেখে সে কার্জন পার্কের রাস্তায় হেঁটে যাওয়া
বেশ্যার দিকে তাকিয়ে আছে।
নিষ্পলক।
যে লেখে সে গোধূলির সংশ্রবে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়চূড়ায়,
সাগরের ডুবে যাওয়া মধ্যিখানে জলের ওপর
ভেসে থাকা সূর্যচিহ্ন দিগন্তে,

যে লেখে সে আমি না।
সে তো চৌকশ বাক্যের তিরে হাওয়াকেও বিদ্ধ করে,
সে তো উষ্ণতায় হাড়সেদ্ধ করে দেয় সব পঙ্কিলতার।

সে তো কপালের ঘাম মুছে
মানুষের
কাঁধে রাখে হাত।

যে লেখে সে আমি না। যে লেখে সে আমি না।
যে লেখে সে অবাঙমানসগোচর।
রিলকের রাস্তায় দাঁড়ানো প্রেমিক পার্থকে প্রতিদিন দেশলাই দেয়।
নদী-বিচ্ছেদের কাহিনী শোনায়।
পার্থর দিকে তাকিয়ে কালপুরুষের দিকে ধোঁয়া ওড়ায়।
বুক ভরে কুয়াশায় জল চুঁইয়ে পড়া দেখে।

যে লেখে সে আমি না।
সে তো মুখ গুঁজে পড়ে থাকে মিছিলের নীলে,
তোমাদের হাসি গানে।
উৎসবের অরুণাভ নির্জনতায়।

সে তো কাৎরায় কেবল টেবিলে উরুতে ভেজাচোখমুখ গুঁজে।

যে লেখে সে—আমি না। আমি না। যে লেখে তাকে—দেখিনি। দেখিনি।

একায়ন

হাসপাতালের জানালা থেকেও দূর-অন্ধকার আকাশে জ্বলজ্বলে লুব্ধক দেখা যায়—দেখা যায়—ভুলশহরের কবরখানার ভাঙাবেতবেড়া ও গলে পড়া সমাধির সারি—চেহারা ম্লান হয়ে গেছে এমন মানুষের গলিত মুখ, থির তাকিয়ে থাকা চোখ দেখে ফেলবার সম্ভাবনা—দেখা যায় ছত্রাকরঞ্জিত এপিটাফ, জীবনখোদিত দেয়ালে হেলান দেয়া বিস্মৃত সঙ্গমস্মৃতিটিলা... 

নিজের ঘুমন্ত লাশ বহন করতে করতে, নিজেরই অনামা-শরীর থেকে বেরিয়ে আসা পঁচামাংস-গন্ধবুঁদবন্ধনাক ঘষে ঘষে লাল কোরে ফেলে মেশিন-মানুষ যেইভাবে ভাবে, সেইভাব বুঝে নেবার ভানে মনে পড়ে যায় অবেলায়, আমারই মতো পৃথিবীতে আসা সোক্রাতেসকে, মনে হয় হেমলক বরং ছিল ভালো ব্যাজস্তুতিময় এই হাজারো মত ও পথের পৃথিবীর চেয়ে...

সেই মুহূর্তেই ইচ্ছেপূরণের পুরাণমন্ত্র মনে করে দিয়ে একটি তারা খসে যায় দূরের আকাশে—তুমি সাথে সাথে নিজেকে মেরে ফেলার ভাবনার ভেতরেও বলে ওঠো, ‘হে অনন্ত রহস্যের অমর পিতা, সৃজনেরও আদিম জনক ‘ভুলে গেছি যাকে, ভালো রেখো তাকে!’

অথচ তখনও উড়ে চলেছে বাতাসে তোমার একার নিঃসঙ্গ তৃতীয় ডানা, ঈশ্বরের বিপরীতে—ঈশ্বরের মতো শরীকহীন; স্বয়ম্ভূ ও একা...

সংকেত কারখানা

কৃষ্ণতিলে লেখা থাকে যে অপূর্ব মাধুরীসংকেত তা কেবল
প্রেমিকপাঠ্য বলে গোধূলিতে মেশে এসে দিন আর রাত
যেমন শ্মশানে, ছাইভস্মে পড়ে থাকা মৃগনাভী মাড়িয়ে শেকল
জীবনের, মাটির মদিরা মেখে নেয় অনন্তের হাতে রেখে হাত—

সেইভাবে বুকের কিনারে সাড়ে চব্বিশ হরফ লুকিয়েছো ঢেউ
এমন গভীরে যেন কেউ শ্রুতিইতিহাস ঢুঁড়ে পায় না হদিস
অথচ জাগরকাঠি হাতে ছিল, ছিল আত্মবিষধর কেউ
তোমাকে দেখাতে পথ, মানোনি ঈশ্বর তুমি নিজেকে নবিশ!

ছুটেছো দূরের কাছে, বসোনি কাছের ঘাসে মাতাল ঋত্বিক
অন্ধস্কুলের দুয়ারে গিয়ে শেখোনি তো বর্ণান্ধের সংকেত
নিজেকে পুড়িয়ে আমি বীজ আর অনিকেত পাখির খোঁজে
উড়ে উড়ে দেখেছি জীবন ঈশ্বরের অপারগতার ক্লেদ!

জীবনের সুমেধ হিশাব সোজাবাঁকা হৃদয়ের অনেক ভাঙচুর
বুঝেসুঝে আমি পলাতক এক সমুদ্রসাক্ষী বেলাভূমিতে একা
আদিগন্ততক ফাঁকা রেলপথে দাঁড়িয়ে পতপত উড়াচ্ছি পতাকা
আমার এ একক মহড়া গুড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর শেষ জাদুঘর

রূপকথা, কিংবদন্তি
(রূপকথা রূপ ধরে টারজান ডাকে—মনে রেখে)

কোথাও কেউ নেই, কেউ ছিল না কোনোদিন
কেবল একটি পাহাড় আছে,
সোনার পাহাড়...

সোনার পাহাড়ে আমাদের বহুদিন কাটল,
রূপা নেই কাঁসা নেই তামা নেই, মাটি নেই,
শুধুই ঝলমলে সোনা

নারীদের বুক ছিল সোনার গম্বুজ আর
পুরুষের শিশ্ন ছিল সোনার মিনার

সোনায় মোড়ানো সেই ফুলের দল
পদ্ম গোলাপ জুঁই চম্পা চামেলি
টগর শেফালী

তখন
আমাদের গ্রাম ছিল
জানালায় দেখা পাহাড়ের রূপকথা,

আমরা সারারাত স্বপ্ন দেখতাম দিনের,
আর দিনে
রূপকথাগুলো সত্য হয়ে যেত।

ক্ষিদে পেট, ঘুম নাই, তবু সত্যি হতো রূপকথা...

আমাদের সারা গ্রামে দানব ছিল বটে,
তবে দানবেরা ও আদরে কাছে টানত,

আর ছিল অথর্ব রাজা,
রাজকন্যা ছিল, রাজপুত্র ছিল, লড়াই ছিল,
রক্তমাখা বিভৎস কান্না ছিল

তবুও মানুষ জানত কিভাবে হাসতে হয়,
কুশল শুধাতে হয়

একদিন রূপকথাগুলো বড় হলো। আমাদের গ্রামে
কোমল চেহারা স্যুট টাই পরা দানবেরা এলো
তারা ঠেসে দিল মাথার ভেতরে সময়জ্ঞানের বোঝা

আর স্বপ্ন দেখালো সোনার বদলে...

আরো বেড়ে গেল রক্তনদীর স্রোত-ঢেউ-গ্রাস
দৈর্ঘ্য আর প্রস্থে চিড়ে চ্যাপ্টা রূপকথাগুলো
আধুনিক কাব্য হয়ে উঠল...

আর আমাদের ছেড়ে প্রিয় গ্রামখানি
ধীরে ধীরে চলে গেল রোমন্থনের শৈশবে

ওহ!
সোনার পাহাড়টা।

ভয়ার্ততা আর রক্তপ্রেতচ্ছায়া লালমুখে
প্রতিভোরের জানালায় শুভসকাল জানায় আমাদের

ফুরফুরা বাতাস
(ফুরফুরা বাতাসে শুধু চনমনে আনন্দ মাখা থাকে)

তোমার ব্যস্তসমস্ত ব্লাডি, বিরক্তি-আঁকা,
সেইম বোরিং টয়-মার্কা, পুনারাবৃত্তিময়

অফিস, বাসা, ঘুম ও হাসা
নাগরিক দিনযাপনের ভিতর
হঠাৎ হঠাৎ আসে একলালাগার প্রহর

যখন আসে, তখন

জীবন-ফাঁক-ফোকড়ের উদাস জানলা দিয়ে ঢোকা
একটা ফুরফুরা বাতাসের মতো
তোমার জীবনে থাকতে চাই আমি
 
আলতো আলতো করে
ধরি মাছ না ছুঁই পানি করে
না করে শেয়ার
সেইম স্নানাগার
আলনা ও খাট
ড্রয়িং ডাইনিং টেবিল, ভাত
তরকারি বিষয়ক তর্ক,
যৌনবিষয়ক ঝগড়া,
না করে শেয়ার রাত,
না করে শেয়ার ঝঞ্ঝাট

দুইজনের কাছে দুই ফুরফুরা বাতাসের মতো
ওগো ভোমরা, থাকতে চাই কি আমরা?

আহা! একটা ফুরফুরা বাতাসের মতো থাকাথাকি
মনে করায়া দেয় একটা
                               হুড়মুড়ায়া ঢোকা ফুরফুরা বাতাস!

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ