ধ্বনি-প্রতিধ্বনি : র‌্যাঁবো, ভায়্যেহো, শঙ্খ

  • ওমর শামস
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

“কিন্তু এ কম্ম যেহেতু এখন সমাপ্ত, তুমি এবং তোমার হিসাব, তুমি এবং তোমার অসহিষ্ণুতাই হচ্ছে তোমার নৃত্য, তোমার কণ্ঠ...”

এই উদ্ধৃতিটুকু র‌্যাঁবোর Illuminations-এর একটি কবিতা, Youth, II. Sonnet-এর একটি বাক্যাংশের অনুবাদ—বাংলায় যতোটুকু সম্ভব। ইংরেজি হচ্ছে : But now that this work is done, you and your calculations, you and your impatience, are only your dance and your voice......। আমি এই বাক্যাংশের এবং ধ্বনির দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। “তুমি এবং তোমার হিসাব, তুমি এবং তোমার অসহিষ্ণুতা”, একদম মৌখিক গদ্য কিন্তু ধ্বনি-অনুপ্রাস-স্বরাঘাত-প্রক্ষেপণ এগুলোই এমন একটি বেগ তৈরি করে যে তার মাধ্যমেই একটি ইঙ্গিতের আভাস পাই—সম্যক অর্থোপলব্ধির আগেই। এক ধরনের স্বার্থান্বেষণের ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে এই শব্দগুলোর বিন্যাসে মধ্যে যদিও তার স্পষ্ট চরিত্র আমরা জানতে পারি না।

বিজ্ঞাপন

একটি অন্য প্রবন্ধে ( জীবনানন্দ’র শ্রুতকিল্প ) আমি চিত্রকল্পের মতো এবং তার সহযোগী অন্য একটি ধারণা, শ্রুতিকল্প, সম্বন্ধে সংজ্ঞা এবং ব্যাখ্যা করেছি—যার উদ্দেশ্যে মূর্ত এবং সামগ্রিকভাবে চরিত্রায়িত করা। র্যাঁবো ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছ, তার একটি শ্রুতিকল্প। এখন আমি দুটো কবিতার উল্লেখ করতে চাই যেখানে প্রায় অনুরূপ শব্দগুচ্ছ দিয়ে সমানুপাতিক শ্রুতিকল্প তৈরি হয়েছে। এবং এর ব্যাপকতর ব্যবহারে ধ্বনি-অনুপ্রাস-বেগ পুরো কবিতার স্থাপত্যকে সংবদ্ধ করে তুলেছে।

প্রথম কবিতাটি পেরুর কবি, সেজার ভায়্যেহো’র (১৮৯২-১৯৩৮) “চশমার মধ্যে বিশ্বাস, চোখে নয়...”। এটি তাঁর শেষ জীবনের কবিতা, জীবদ্দশায় অপ্রকাশিত। ১৯৩৭-৩৮-এ Sermon de la Barbaric (বর্বরতা প্রসঙ্গে বক্তৃতা), এই গ্রন্থ নামের একটি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করছিলেন। এই কবিতাটি তার অন্তর্গত; বাংলা অনুবাদ নিচে প্রকাশিত হলো :

চশমার মধ্যে বিশ্বাস, চোখে নয়...
সেজার ভায়্যেহো

বিশ্বাস চশমার মধ্যে, চোখে নয়;
সিঁড়ির মধ্যে, কোনো ধাপে নয়;
পাখার মধ্যে, পাখির মধ্যে নয়;
এবং শুধু তোমার নিজের মধ্যে, নিজের মধ্যে, নিজের মধ্যে।

বিশ্বাস বদমায়েশীতে, বদমায়েশের মধ্যে নয়;
পানপাত্রের মধ্যে, কিন্তু কোনো পানীয়তে নয়;
মরদেহের মধ্যে, মানুষে নয়;
এবং শুধু তোমার নিজের মধ্যে, নিজের মধ্যে, নিজের মধ্যে।

বিশ্বাস অনেকের মধ্যে, কিন্তু একার মধ্যে নয়;
নদীর তলদেশে, কিন্তু স্রোতে নয়;
তোমার পাজামার পায়ে নয়;
এবং শুধু তোমার নিজের মধ্যে, নিজের মধ্যে, নিজের মধ্যে।

বিশ্বাস জানালার মধ্যে, দরোজায় নয়;
মায়ের মধ্যে, কিন্তু দশ মাসের মধ্যে নয়;
নিয়তির মধ্যে, কোনো সোনার ছক্কায় নয়;
এবং শুধু তোমার নিজের মধ্যে, নিজের মধ্যে, নিজের মধ্যে।

আমি শ্রুতিকল্পের দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। র‌্যাঁবোর বাক্যে যেখানে ‘তুমি এবং তোমার....’ স্বর-প্রক্ষেপ, ডায়্যেহোর কবিতার নির্মাণ ‘শুধু তোমার নিজের মধ্যে, নিজের মধ্যে, নিজের মধ্যে’ এই শ্রুতিকল্পের ব্যবহারে। কবিতাটি ৪ স্তবকের; প্রত্যেক স্তবকের শেষ লাইনের এই একই ধূপ। শুধু তাই নয়, যে কোনো স্তবকের প্রথম তিন লাইনের প্রত্যেকটিতেই ‘...মধ্যে...’, ‘...নয়’ এই নির্মাণের মাধ্যমে। ‘বিশ্বাস.....-র মধ্যে’ কিন্তু ‘....-তে নয়’—এই বৈপরীত্যের পেছনেই নিহিত থাকে চিত্রকল্প এবং বোধ-আবেগের উদ্গীরণ। কবিতায় কোনো মতো-র ব্যবহার নেই, কিন্তু প্রতিটি স্তবকের প্রথম তিন পংক্তিই চিত্রকল্পে ঠাসা। এত পরিমিত এবং সুসংবদ্ধভাবে যা যে কোনো কবির ঈর্ষার বস্তু এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্যঞ্জনা প্রকাশের আধুনিকতার উৎকর্ষের এটি একটি চরম শীর্ষ। চিত্রকল্পের কথা বলতেই হলো, কিন্তু আমার মূল উদ্দেশ্য এবং যুক্তি শ্রুতিকল্প বিষয়ে।

শঙ্খ ঘোষের ‘তক্ষক’; বাবরের প্রার্থনা কবিতাগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত করি :

তক্ষক
শঙ্খ ঘোষ

তোমার কোনো বন্ধু নেই তোমার কোনো বৃত্তি নেই
কেবল বন্ধন
তোমার কোনো ভিত্তি নেই তোমার কোনো শীর্ষ নেই
কেবল তক্ষক
তোমার কোনো নৌকো নেই তোমার কোনো বৈঠা নেই
কেবল ব্যাপ্তি
তোমার কোনো উৎস নেই তোমার কোনো ক্ষান্তি নেই
কেবল ছন্দ

তোমার শুধু জাগরণ শুধু উত্থাপন কেবল উদ্ভিদ
তোমার শুধু পান্না আর শুধু বিচ্ছুরণ কেবল শক্তি

তোমার কোনো মিথ্যা নেই তোমার কোনো সত্য নেই
কেবল দংশন

তোমার কোনো ভিত্তি নেই তোমার কোনো শীর্ষ নেই
কেবল তক্ষক
তোমার কোনো বন্ধু নেই তোমার কোনো বৃত্তি নেই
কেবল বন্ধন
তোমার কোনো দৃষ্টি নেই তোমার কোনো শ্রুতি নেই
কেবল সত্তা।

এই কবিতাটির স্থাপত্য ঠিক ডায়্যেহোর কবিতাটির মতো—

বিশ্বাস (....) মধ্যে, (....) নয়
শুধু তোমার নিজের মধ্যে, নিজের মধ্যে, নিজের মধ্যে।

এই কাঠামোটিকে নিচেরটিতে রূপান্তরিত করুন—
তোমার কোনো (....) নেই তোমার কোনো (....) নেই
কেবল (....)

কবিতার স্থাপত্য দাঁড়িয়ে যাবে। লক্ষ্যণীয় যে, ‘শুধু’ এবং ‘কেবল’ শব্দ দুটিও সমার্থক। শঙ্খ ঘোষ ডায়্যেহো নিয়োজিত Syntax এবং শ্রুতি ব্যবহার করেছেন। তবে ভায়্যেহোর কবিতাটির উদ্দেশ্য সমাজের এক শ্রেণির শোষক-প্রতারকদের প্রতি ব্যঙ্গ। এই আয়রনিই উদ্ধৃত শব্দ, ধ্বনি, পুনরাবৃত্তি প্রয়োগে। চিত্রকল্পের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গায় ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে। ভায়্যেহোর ইঙ্গিতটি প্রত্যক্ষ এবং তীক্ষ্ন। শঙ্খ ঘোষের ‘কেবল বন্ধন’, ‘কেবল তক্ষক’, ‘কেবল ব্যাপ্তি’, ‘কেবল ছন্দ’, ‘কেবল দংশন’, ‘কেবল সত্তা’ এবং ‘শুধু জাগরণ শুধু উত্থাপন কেবল উদ্ভিদ’, ‘শুধু পান্না আর শুধু বিচ্ছুরণ কেবল শক্তি’—এই ধ্বনি-চিত্রের লক্ষ্য কে সেটা খুব স্পষ্ট নয়। সে কি কবিতা বা শিল্প নিজেই? হয়তো!