শ্যামলতার মৃত্যুশিথান

  • ইমতিয়ার শামীম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

ফুলঝোর এইখানে এসে বাঁক নিয়েছে ইছামতির দিকে; না কি এ নদীকে অন্য কিছু বলে? এ নদীতে কি রিঠা মাছ পাওয়া যায়? প্রশ্ন করে না রিপন, আর চোখেও এমন কোনো চিহ্ন থাকে না। তবে মাথার মধ্যে প্রশ্নটা বারবার ঘুরপাক খেতে থাকে তার।

অনীল তখনও বলে চলেছে, ‘আমি তহন কী করি, বলেন? হাড়িভর্তি মাছ, শালার ডাকাইতগুলা পা দিয়া এমন লাত্থি দিল, সব তো চলতি ট্রেনের দরজা দিয়া বাইরে গিয়া পইড়ল। ট্রেন যাইতেছে, তা ধরেন হান্ড্রেড মাইল বেগে—’ বলে সে একটু থামে, মনে হয় তার মাথার মধ্যে তিন রাস্তার মোড়ে তিনদিক থেকে তিনটা ট্রাক এসে নিজেদের ইজ্জত সামলাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। আর তাই কথাবার্তার গতিও একটু ঢিলেঢালা হয়—‘তা হান্ড্রেড মাইল বেগে গেলিই কী, আর ষাট মাইল বেগে গেলেই কী? প্যাসেজের মইধ্যে মাথার উপরে টিমটিম কইরা একটা বাত্তি জ্বলতেছে আর বাইরে ধরেন জিগার আঠার মতো—চেনেন তো জিগার আঠা?’—বলে সে রিপনের দিকে অনিশ্চিত চোখে তাকালে জবাব পায়, ‘চিনব না কেন? জিগা গাছের গা ফেটে বের হয়, না?’

বিজ্ঞাপন

‘হ—হ—’ সোৎসাহে সায় দিয়েও বিব্রত কণ্ঠে অনীল বলে, ‘না, মানে ভদ্রলোক হইলে মানুষ তো আবার এইসব চিনতে পারে না।’

ভদ্রলোক শব্দটার ওপর খানিকটা ভর দিয়ে ফের হালকা স্বরে বলতে থাকে, ‘তাই জিগাইলাম আরকি! ... তে শোনেন, বাইরে তহন জিগার আঠার মতো আঠাইলা আন্ধার, হান্ড্রেডা মাইল বেগে সেই আন্ধারও দৌড় মাইরতেছে। ভালো কইরা কিছুই আর দেহার উপায় নাই। শালার এক হারামী কি কইরল, জানেন? বুকের কাছে এই যে এইখানটায় ছুড়ি ঠ্যাকায়া কয়, বাইর কর—বাইর কর কইতেছি। আমি আর কই কী, ভয়ে তো আত্মা উইড়া গ্যাছে, কোন কামে আইলাম রে বাপ, ক্যান আমার শখ হইল মাছ নিয়া গঞ্জে যাওয়ার! আর ধরেন, লোভে তো মরে জোলা—তা আমি তো জোলাও না! তাইলে আমার ক্যান লোভ হইল বেশি দামে মাছ বিক্রি করার? কাঁপতে কাঁপতে কইলাম, ট্যাকা তো নাই—গঞ্জে যাইতেছি, বিয়ানে মাছ বেচমু। হে শালায় ‘হারামজাদা’ কইয়াই আমার মাছভর্তি পাতিলে দিল লাত্থি। আর গড়াইতে গড়াইতে ট্রেনের দরোজা দিয়া আন্ধারের মধ্যে নুক্কি দিল। মাগুর-জিয়াল ভর্তি মাছের পাতিল, কোনডা যে কোনখানে গিয়া পইড়ল! সঠাৎ কইরা কী হইল জানেন? শালার ডাকাইত ‘ওরে মারে’ কইরা আমার বুকের পার থাইকা ছুরি সরায়া নিচের দিকে তাকাইল। চায়্যা দেহি, শিং মাছের কাটায় ব্যাটার পায়ের নিচ থাইকা রক্ত বারাইতেছে।’

বিজ্ঞাপন

রহস্যময় হাসিতে অনীলের মুখ ভরে ওঠে। একটা মাঝারি ঢেউ এসে নৌকার তলায় ধাক্কা মারে। নৌকাটা দুলে দুলে ওঠে। আকাশ আজ ভীষণ পরিষ্কার, পুতুল আর হাতির বাচ্চা থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ কিংবা কার্ল মার্কস সবাই শাদা শাদা মেঘ হয়ে ভাসছে সেখানটাতে। হাসতে হাসতে অনীল বোধহয় তার গল্পের ইতি টানে, ‘আল্লায়ই বিচার করে।’

কথাটা খট করে কানে লাগে, তা হলে হিন্দু জেলে নয়!? কিন্তু নৌকা ছাড়ার আগে যেভাবে ভগবান বন্দনা করল, তাতে তো এরকমই ভেবেছিল সে। তবে এইসব তো জিজ্ঞেস করা যায় না। আর জিজ্ঞেস করার দরকারও নেই তার। ঠাঁ ঠাঁ দুপুরে একটা নৌকা পেয়েছে, এই তার সাত জন্মের ভাগ্য। দূরে রেলব্রিজটা ক্রমশই ছোট হয়ে আসছে। আর তার ওপর দিয়ে আবারও একটা ধাবমান ট্রেন আরো ছোট হয়ে যাচ্ছে।

এ তো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এই এলাকায় যাতায়াতের পথ একটাই—রেলপথ; আর ট্রেন থেকে নামার পর সম্বল পা দুইখানা। ফাঁকফোকড়ে নৌকা, না হয় সাইকেল কিংবা গরুর গাড়ি—এর চেয়ে দ্রুতগামী কিছু আর নেই। স্টেশন থেকে নামার পর তাই তাকে হাঁটতেই হয়েছে। স্টেশনের বাইরে কয়েকটা গরুর গাড়ি ছিল। তবে কাপড়ের গাইট নিয়ে সেগুলো যাবে সেই এনায়েতপুরের দিকে। আর কাপড়বাহী মালগাড়ি কখন আসবে কেউ জানে না। তা ছাড়া ঠিক সময়ে এলেও তার ভাত ছিল না; একেকটা গরুর গাড়িতে গাড়োয়ান আর ছোট গাড়োয়ান ছাড়াও আছে কাপড়ের পার্টির একজন। এরা চড়ার পর তার আর বসার জায়গা কোথায়। তাও না হয় কথা বলে দেখা যেত; কিন্তু রিপনের মনে হচ্ছিল, অন্তহীন রোদের প্রেক্ষাপটে কয়েকটা গাছের নিচে রাখা গরুর গাড়িগুলো যেন একেকটা নিঃসঙ্গ কফিন, গরুগুলো তার আশপাশে দাঁড়িয়ে-বসে কোথায় কতটুকু সবুজ ঘাস আছে তা সাবাড় করার। সে হনহনিয়ে হাঁটতে শুরু করেছিল মেঠো সড়ক দিয়ে।

‘কই যাইবেন ভাই?’—কারো এই প্রশ্ন শুনে সে চমকে উঠেছিল। কোনো ভরাট কণ্ঠ নয়, কণ্ঠে কোনো সন্দেহ নেই, খুব বেশি আগ্রহ যে আছে, সেরকমও নয়। কিন্তু কিছু একটা তো নিশ্চয়ই ছিল। না হলে সে চমকে উঠবে কেন? আর চমকে উঠে সে মাথার ছাতিটা নামিয়ে ফেলবে কেন?

‘না—মানে আপনেক এ এলাকার মনে হয় না তো! তাই কইলাম।’

এতক্ষণে লোকটার অবস্থান ঠিকমতো বুঝতে পারে রিপন। আমগাছটার একটা ডাল বেশ নিচের দিকে; তার ওপরেই শুয়ে আছে লোকটা। আরো একজন আছে, তবে আরো একটু ওপরে। তা ছাড়া শোয়ার মতো দীর্ঘ ডাল পায়নি সে। গাছের কাণ্ডে হেলান দিয়ে ডালে পাছা ঠেকিয়ে পা মেলে বসে আছে সে।

‘জ্বি, ভাই। আমি নতুন মানুষ। সোনতলা যাব।’

‘সে আপনেক দেখলিই বোঝা যায়। প্যান্টপরা মানুষ, লম্বা হাতার জামা। আবার হাতে ছোটখাটো ব্যাগও আছে একখান—’

লোকটা তার ব্যাগটাকে বারবার লোভী চোখে তাকাচ্ছিল। রিপন বুঝতে পারছিল না এর পর কী বলা যায়। বোকার মতো বলেছিল, ‘শুনছি, স্টেশন থেকে নেমে একটাই রাস্তা—সেই রাস্তা ধরে যেতে হবে, স্কুলটাও নাকি রাস্তার ধারে; তাই আর কাউকে জিজ্ঞেস করি নি।’

‘স্কুলে যাইবেন? মাস্টার হইবেন? বেতন পাইবেন না কইল।’

অদ্ভুত ব্যাপার! মনে হচ্ছে, স্কুলে পৌঁছানোর আগেই তার ইন্টারভিউ শুরু হয়ে গেছে। অথবা এমনও হতে পারে, স্কুলটার উদ্যোক্তাদের শত্রু অনেক—বাগড়া বসানোর মানুষজন সবখানে বসে আছে। সে মুখটা নিচু করে আবারও ছাতা খোলার প্রস্তুতি নিয়েছিল। আর তখন চোখটা স্টেশনঘরে আটকে গিয়েছিল। বিবর্ণ লাল রঙের ঘর, ছোট জানালায় কবে যে হালকা বার্নিশ করা হয়েছিল, কেউ জানে না। মোটা মোটা গোল শিকগুলোর ফাঁক দিয়ে স্টেশন মাস্টারকে দেখা যাচ্ছে বিরাট একটা খাতায় চোখ বুলাতে।

ছাতাটা খুলে মাথার ওপর নিয়ে রিপন হাসবার চেষ্টা করেছিল, ‘দেখি, যাই তো আগে—তার পর দেখি, কথা বলি...’

‘কথা কওয়ার কিছু নাই—’ ওপরের ডালের লোকটা বলেছিল— ‘আমরা সবই জানি। লজিং—লজিং থাকা লাইগব। বাগচী বাড়িত থাইকতে পারেন। খাইবেন দাইবেন, স্কুলে পড়াইবেন—বাগচী বাড়িত আইসা আবারও পড়াইবেন, বিধবা একটা মেয়ে আছে বাগচীর, একটা কচিও আছে। কচি, তবে বড়ই সরেস। বাগচী বাড়িত উঠলি আপনের প্যাট-চ্যাটের কুনু অভাব থাইকপো না—’

রিপনের কান গরম হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এই অজানা, অচেনা জনহীন প্রান্তরে সে কী আর করতে পারে! এইসব বলার পর লোকগুলোর হো হো করে হাসার কথা—কিন্তু সে কোনো হাসির শব্দ শোনা দূরে থাক, হাসির আভাস ফুটে উঠতেও দেখেনি লোকগুলোর ঠোঁটের কোণে। তবে কী যেন ছিল; এখন এই নদীর জলের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারে করুণ শুষ্ক জলের মতো কোনো কিছু।

নিচের ডালে শুয়ে থাকা লোকটা ফের চোখ বোজার আগে বলেছিল তাকে—‘মাঝখানে কইল নদী আছে একটা। নৌকা কইরা যাইয়েন। কষ্ট কম হইব।’
‘নৌকায় যাওয়া যায়?’
‘যায় তো। নৌকায় ঘাট পার হইয়া হাঁইটাও যাইতে পারেন—তাতে কষ্ট হইব আরকি। নৌকায় যাইবেন, সময় একটু বেশি লাইগব। আরামে যাইবেন, বাতাস খাইবেন—এই আরকি।’

আরো খানিকক্ষণ পরে রিপন এই নদী পেয়েছিল। তার শুকনো বুকে যেটুকু পানি আছে, তাও এখন সাঁতরে পেরুনো কঠিন। তবে ঘাটে কোনো নৌকা নেই; আর ইজারা নিশ্চয়ই এইবার ঘাটের ওই পাড়ের লোকজন পেয়েছে—ইজারাদারের টংঘরটা দেখা যাচ্ছে নদীর ওই পাড়ে। সে এইসব ভাবছে আর আশপাশ দেখছে; ঠিক তখনই ঝাঁপি ফেলা ঘরটার সামনে থেকে একটা কুকুর প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে উঠে দৌড়াতে শুরু করেছিল দূরের বাড়িঘরগুলোর দিকে। রিপন শিউরে উঠেছিল। খরখরে এই দিনে, এই প্রান্তরে তার যে একেবারে খারাপ লাগছে, সেরকম না। হ্যাঁ, গরম পড়েছে বটে; কিন্তু গ্রীষ্মে তো গরমই থাকে। আর গরমকালে সে গরমই চায়, চায় প্রকৃতির শরীরের আস্বাদ নিতে। সে যদি সিনেমা বানাতে জানত, এই আদিগন্ত বিস্তৃত ল্যান্ডস্কেপটাকে নিশ্চয়ই ধরত; এই দুপুর, এই রোদ, নিঃসঙ্গ আর মরমরে গাছ-ঘাসগুলোর সালোক সংশ্লেষণ, দূরে ক্ষেতের মধ্যে মাথালপরা কৃষক, নদীর ওপারের বটগাছ আর এ পারের এই কয়েকটা জেলে নৌকা...

তরতরিয়ে গড়ান বেয়ে নিচের দিকে নেমে এসেছিল রিপন। তার কালো, পুরানো স্যান্ডেল স্যুটা হয়তো আর একটু এদিকসেদিক হলেই ছিঁড়ে যেত। কিন্তু সেদিকে নজর না দিয়ে সে সোজা জেলে নৌকাগুলোর দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। আর এইভাবে অনীলকে সে খুঁজে পেয়েছিল।

কিন্তু অনীল বড় বেশি কথা বলে। স্কুলের নামের অর্ধেক শুনেই সে হড়বড়িয়ে বলে উঠেছিল, ‘চিনি তো—আমার বাড়ির পাশেই তো। যাইবেন সেহানে? এই বিনয়, আমার জালটারে দেহিস তো। আমি ওনারে নামায়া দিয়া আসি।’
‘ভাড়া কত নেবেন?’—নৌকায় চড়ার আগেই রিপন জানতে চেয়েছিল। অনেকবার ঠেকে এইটা শিখেছে, ভাড়া-মজুরি ঠিক করে নিতে হয় কাজ শুরু করার আগেই। কিন্তু অনীল অবাক হয়ে বলেছিল, ‘ভাড়া? ভাড়া কিসের? আমাগারে গাঁয়ের স্কুলে যাইবেন, তার জইন্যে ভাড়া নিব আমি?’

নদীর জল স্থির ও স্থবির হয়ে আছে। এই সময়ে কেউ মাছ ধরে না। কিন্তু অভ্যাসবশে জেলেরা জাল ফেলে রেখেছে। মন্থর ঢিলে তালে দুই জেলে জাল তুলতে শুরু করলে অবাক চোখে রিপন দেখেছিল, অসংখ্য খুলি জালের মধ্যে খলবল করছে। ভয় আর বিস্ময়ে তার চোখমুখ নীল হতে হতেও লালচে-ফর্সা হয়ে গিয়েছিল। অনীল খুশিভরা গলায় বলেছিল, ‘এবার এই ম্যান্দামারা সময়েও কত মাছ ধরা পড়ছে, দেখেন—। বিনয় রে, মাস্টার সাবের জইন্যে এক খালই মাছ দে দেহি।’

খালইভর্তি মাছ নিয়ে অনীল তাকে নিয়ে চলেছে স্কুলের দিকে। কিন্তু কোনখানে স্কুল! সামনে অনন্ত জলপ্রান্তর, দিগন্তরেখার সঙ্গে মিশে আছে গাছপালা-বাড়িঘর। থির হয়ে আছে জল। এ সময় নদীর পানিতে কোনো স্রোতও থাকে না। ঠিক তার জীবনের মতো; এই তুলনাটা আসতে না আসতেই কেমন যেন কেঁপে ওঠে একেবারে ভেতর থেকে। স্রোতহীন নদীতে তবু কত রুপালি ছোট ছোট ঢেউ এত দ্রুত চলাচল করছে যে সহজেই চোখে আটকায় না। অনীল চলেছে অনেকটা কিনার ঘেঁষে, সেখানে মাঝেমধ্যে দলছুট কচুরিপাণা সবুজ জীবনের আভা ছড়াচ্ছে।

‘আপনে মাছ খান তো? কোন মাছ আপনের বেশি পছন্দের?’

কী সব আবোলতাবোল প্যাঁচাল জুড়েছে! এবার আর কথার উত্তর দিতে রিপনের ভালো লাগে না। কিন্তু একটা লোক ফাও ফাও তাকে নিয়ে যাচ্ছে এত পরিশ্রম করে, বিরক্তই বা সে হয় কেমন করে। কিন্তু উত্তর দেয়ার দরকার হয় না তার, আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে অনীল আবারও বলতে থাকে, ‘মাছের রাজা ইলিশ, এইটা কিন্তু ভুয়া কথা, বুইঝলেন? ইলিশ মাছ হইল ধরেন ওই ফিরনির মতো, খাইতে খুবই স্বাদের, কিন্তু আত্মা জুড়ায় না। কত মাছ যে আছে নদীর জলে! এক্কেরে ধরেন দিল্লীর মতো। দিল্লী টাউনে যেব্যা হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি, সাঁওতাল, জোলা, জাইলা, নমঃশুদ্র সব কিছিমের মানুষ ঘোরাফেরা করে, নদী হইল তাই। নদী হইল মাছগারে দিল্লী টাউন—’
‘আপনি দিল্লী গেছেন?’—আচমকা কী ভেবে বলে বসে রিপন।
‘আমি?...দিল্লী?...হেহ্, আমার কি আর হেই কপাল আছে? আমার দাদার পোলা ভীষণ ট্যাটন। কয় যে—’বলেই কী এক সংশয় নিয়ে হালের ওপর হাতটা স্থির করে ধরে অনীল তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলেই ফেলে, ‘কয় যে, কাকা, এই দ্যাশে থাকা যাইব না, ও তোমরা মুজিবেক যতই ভালোবাসো না ক্যান, তোমাগারে নৌকার লোকজন নৌকায় কইর্যা ভাসায়া দিব। আমার নাওয়ে ভাসার হাউস নাই, আমি দিল্লী গ্যালাম। হে চইল্যা গেছে। জাইলার পোলা ড্রাইভার হইছে। এই জন্যেই তো কই, দিল্লী হইল দুনিয়ার ব্যাবাক মানুষের জায়গা।’

‘কথাটা ঠিক না। লন্ডন—লন্ডন হলো সব রকম মানুষের জায়গা।’

অনীল বেকুবের মতো তাকিয়ে থাকে। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘হইতে পারে। কথা তো ওইখানে না—কথা হইল, নদী হইল ব্যাবাক মাছগারে জায়গা। একটা মাছ আছে বুইঝলেন, নাম খসুল বাটা মাছ। খাইছেন কুনুদিন?’

নাহ্, এরকম কোনো মাছ খায়নি রিপন। শুধু খাওয়া কেন, এরকম কোনো মাছের নামও জানে না সে। তার জ্ঞানের ভাণ্ডার প্রায় শূন্য, আর মৎস্যের ভাণ্ডার নেই বললেই চলে। তাই মাথা নেড়ে না করতে না করতেই বলে ওঠে অনীল, ‘তাইলে দাদা, আজই চলেন, মাস্টার সাবের সাথে কাজকাম সাইরা আইজক্যাই চলেন রওনা হই করতোয়া, নয় তো বড়াল ব্রিজের দিকে।’

এবার একটু দুলুনি লাগে আর রিপন তার ব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরে। অনীল এবার হাল ছেড়ে লগি হাতে নিল। অগভীর নদীর বুকে লগিটা বারবার গেঁথে যাচ্ছে। তীরের এখানটায় এত বেশি গাছ যে মনে হয় বন। কিন্তু পায়ের চলার পরিষ্কার রাস্তা চলে গেছে গাছের ভেতর দিয়ে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় রিপন। কিন্তু অনীলের মুখ এখন বন্ধ আছে। ভীষণ ব্যস্ত সে শেষ মুহূর্তে নৌকাটাকে বাগে রাখতে। এখন দুলছেও বেশ। নৌকা ঘাটে ভেড়ার আগে এরকম হয়। তাই রিপন শান্ত থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে বেশ দমে যায় সে। এরকম একটা অজ পাড়াগাঁয়ে চাকরি করবে সে!

‘আসেন।’—বলে এবার অনীল তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে নৌকার গলুইয়ে দাঁড়ায়। নদীর তীরঘেঁষা অল্প পানির মধ্যে লগিটাকে গাঁথে ভালো করে। তারপর সেটার সঙ্গে নৌকাকে বেঁধে এদিকসেদিক দেখে নিয়ে হাতটা এগিয়ে দেয়, ‘ধরেন, লাফ দ্যান ইট্টু। কিনারে পা রাইখেন না, পিছলা যাইবেন।’

রিপন অনীলের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে লাফ দিয়ে যতদূর সম্ভব দূরে নামে। ডান হাত দিয়ে ব্যাগটাকে তখনও সে বুকে ধরে রেখেছে। আবারও জিজ্ঞাসু চোখে সে অনীলের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনীল কেমন রহস্যময় হাসি দেয়, ‘আসেন আসেন’, ঢালু বেয়ে সে ওপরে ওঠে, রাস্তাটা দেখাতে দেখাতে বলে, ‘এই যে রাস্তা দেখতেছেন, এই রাস্তা ধইরা সোজা চইলা যান। খানিক আগাইলেই দেইখবেন, কুনু বাড়িঘর নাই, খালি একখান স্কুল। দেইখলেই চিনবেন।’
‘এখন মাস্টাররা সবাই আছে?’
সূর্যের দিকে তাকিয়ে অনীল একটু বোঝার চেষ্টা করে, বলে, ‘এহন মনে কয় নাই। সমস্যা নাই, স্কুলের পিছনেই মাস্টার সাবের বাসা। ডাক দিলিই হব্যো।’
‘আপনি মাছ দিতে যাবেন না?’
‘মাছ?’—অনীল যেন বুঝতেই পারে না রিপন কী বলছে। কী বলবে কী বলতে করতে করতে রিপন বলেই ফেলে, ‘ওই যে খালই বোঝাই করে নিয়ে এলেন?’
‘ও,—ওই মাছ? কী যে কন না, এত অল্প মাছ! খসুল বাটা মাছের গল্প করতেছি, আর ছারেক দিমু এইসব এইটুক মাছ? যান, আপনে তাড়াতাড়ি ঘুইরা আসেন, আমি খানিক জিড়ায়া নেই। আপনেক নিয়া কইল করতোয়ায় যামু, খসুল বাটা ধরমু, রাতে রান্ধনবান্ধন করমু।’

বলে অনীল বসে পড়ে গলুইয়ের ওপরে।

রিপনের গা ছমছম করে। কী ভীষণ নির্জন পথ! আর সত্যিই, ধারে কাছে কোনো বাড়িঘর নেই। জঙ্গলের ধার দিয়ে দু’তিনজন পাশাপাশি চলাফেরা করার মতো চাপা রাস্তা। আর ফসলের মাঠেও কোনো কিছু নেই। জঙ্গলে একটা বড় হলদে পাখি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পাখির ডাক এখনো শুনতে পায়নি সে। হঠাৎ সামনে বিশাল দুই ডানার ছায়া পড়লে সে সভয়ে তাকায় আকাশের দিকে। একটা বিরাট শকুন উড়ে যাচ্ছে। হয়তো কোথাও গরু মারা গেছে। মরা গরুর ঘ্রাণের দিকে উড়ে চলেছে শকুন।

রাস্তা মনে হয় ফুরাতেই চায় না। রিপন যাচ্ছে তো, যাচ্ছেই। তা হলে অনীল যে বলল, খুব বেশি দূরে নয়! তা হলে সে কি ভুল রাস্তায় চলে এসেছে! নিশ্চয়ই না। সেরকম হতেই পারে না। তাকে এইভাবে গায়ের শক্তি খরচ করে জঙ্গলের কাছে এনে ফেলে দেবে—কী এত দায় পড়েছে ওই লোকটার।! তবে এখন শরীর ভার ভার লাগছে তার। কিছুই খাওয়া হয়নি সকাল থেকে, কথাটা মনে পড়ে এতক্ষণে। আর আরো মনে হয়, অজস্র লোকজন খচমচ করছে পুরো জঙ্গলজুড়ে। যদিও দুই চোখে তেমন কোনো আলামত খুঁজে পায় না সে।

তখনই মোড়টা একটু ঘুরতে না ঘুরতেই তার চোখে পড়ে, থরথরে প্রায় ভাঙাচোরা একটি বড় টিনের ঘর দাঁড়িয়ে আছে হয়তো-বা পোয়া মাইল দূরে। একটা বড় কড়িগাছ ছায়া দিচ্ছে সেটাকে। তার পায়ের গতি বেড়ে যায়, হৃদপিণ্ড ধুকপুক ধুকপুক করতে থাকে। টিনের ঘরটার সামনে গিয়ে সে উত্তেজনায় কোনো কথাই বলতে পারে না। তবে তার চোখ দুটো সেটাকে তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকে। না, কোনোখানে স্কুলের সাইনবোর্ড নেই। তবে টিনের ঘরের বেড়ার সঙ্গে ভূমি অফিসের আলকাতরায় লেখা ঘরবাড়ি নম্বর থেকে বোঝা যাচ্ছে, স্কুলই আসলে সেটা। যেন রূপকথার রাজ্যে এসে হাজির হয়েছে সে, তার ব্যাগের মধ্যে জিয়নকাঠি। সেটা বের করে স্পর্শ করলেই জেগে উঠবে পুরো বিদ্যালয়, শিশু-কিশোরদের কলতানে মুখরিত হয়ে উঠবে পুরো প্রাঙ্গণ।

টিনের ঘরের বারান্দায় উঠবে রিপন, তখনই ঘরের পেছনের শোলার বেড়ার আড়াল থেকে দীর্ঘদেহী এক মানুষ বেরিয়ে আসে। তার গায়ে কোনো জামা নেই, লুঙ্গি খাটো করে পরা, তবে মাথায় নারকেলের ছোবড়া দিয়ে বানানো একটা টুপি। চোখে কোনো মায়া-মমতা নেই, বরং এখনই জেগে উঠতে পারে ভয়ঙ্কর সহিংসতা। তবে সুন্দর করে হাসতে হাসতে সালাম দেয় সে। তারপর বলে, ‘চিনলাম না তো আপনেক। কইত্থেকে আসছেন?’
‘জ্বি, আমি—এই ঢাকা থেকে। আপনাদের স্কুলে একটা চাকরির বিজ্ঞাপন দেখলাম।’
লোকটার চোখেমুখে হিংস্রতা জেগে উঠতে গিয়েও মিলিয়ে যায়, ‘বুইঝলাম না।’
‘আপনাদের স্কুলে শুনলাম মাস্টার নেয়া হবে—’
‘আমাগারে ইসকুল? আমাগারে এহানে তো কুনু ইসকুল-টিসকুল নাই—’
‘এইটা স্কুল না? রামকান্দিপুর উচ্চ বিদ্যালয়? কমলকান্তি বাগচী হেডমাস্টার?’
‘কী কন না কন, কিছুই বুঝি না। রামকান্দিপুর উচ্চ বিদ্যালয়? হোনেন, এইডো রসুলপুর গ্রাম। অ্যার ৫০ মাইলের মইধ্যে ওই নামে কুনু গাঁও নাই, স্কুলও নাই। বাগচী-মাগচীও নাই। দুই-এক ঘর যা আছিল, ভাইগা গ্যাছে। জুয়ান মিয়াগারে বিয়া দিবার পারে না, মিয়াগুলা ভাইগছে অ্যার-অর সাতে, হেরপর ভাইগছে বাপ-মায়েরা।’
একটু চুপ করে লোকটা আবারও বলে, ‘তে যান আপনে। আমার ঘরেও ঝি-বউ আছে, তারা পর্দা-ইজ্জত করে, আপনেগারে টাউনের মতো না। তারা এহন বাইর হব্যো, কাজকর্ম কইরব। এইখানে দাঁড়ায়া থাইকেন না। তাড়াতাড়ি যান—’

বলে লোকটা হাত উঁচালে এতক্ষণে রিপনের চোখে পড়ে, বড় একটা রামদাও রয়েছে তার হাতে। আতঙ্কে তার শরীর নীল হয়ে আছে। সে পিছু হটে শরীর ঘুরিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে হাঁটতে থাকে। জঙ্গলের পাশ দিয়ে, গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে আর কতক্ষণে যে অনীলের নৌকার কাছে পৌঁছতে পারবে, কে জানে! নিশ্চয়ই অনীল তাকে নদী পার করে দেবে। কিন্তু কী আশ্চর্য, এবার সে দেখতে পায়, ঝোপজঙ্গল, গাছগাছালি, কোনো কিছু নেই—কোনো নদীও নেই কোনোখানে। সামনে বিস্তীর্ণ চরাচর, কোনো কোনো ক্ষেতে সামান্য ফসলের আভাস; কিন্তু মানুষজন, ঘরবাড়ি নেই। কোনো শ্যামলতা নেই, নির্জনতা নেই। তা হলে সে কি ভুল স্টেশনে নেমেছে? কিন্তু তা তো হওয়ার কথা নয়। আর কত লোকজনকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়েই না সে এখানে এলো। তারা সবাইও তা হলে ভুল বলল? এই যে অনীল তাকে নৌকায় করে নিয়ে এলো—সেই নদী নৌকাই বা কোথায় গেল?

রিপনের দম বন্ধ হয়ে আসে। ধুলো উড়ছে। হঠাৎ করেই রোদের আঁচ বাড়ছে যেন। কিন্তু সে হাঁটতে থাকে। স্কুলটা কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই আছে। সেখানে হয়তো নদী-নৌকা-অনীলও আছে। আর নিশ্চয়ই একটা চাকরিও আছে সহকারী শিক্ষক পদে। সে কোনো দিকে না তাকিয়ে, না থেমে হাঁটতেই থাকে একনাগাড়ে...