আলো আসে ওখানেও
আতরের কড়া গন্ধটা ঘরময় ছড়ানো। কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠছে ববিতার। মোচড় দিচ্ছে নাভির কাছাকাছি। চোকির ওপর টানটান হয়ে শুয়েছিলো ও। নাভির কাছে মোচড় দিতেই ডানহাতে তলপেটটা চেপে ধরে কুঁকড়ে ফেললো শরীরটা। মাথার কাছের ছোট্ট জানালাটা খোলাই তো আছে, তবু একটুও বাতাস আসছে না কেন? ঘাম চুঁয়ে পড়ছে কানের পাশ দিয়ে বালিশে। উঠে গিয়ে পানি খাবে, না হয় ফ্যানটা চালাবে একটু তার শক্তিও যেন নেই শরীরে।
খুটখুট করে হাসছে বুড়োটা। হামানদিস্তায় পান ছেঁচার মতো একটা শব্দ সেই হাসির। অসহ্য লাগে ববিতার। তাকে নিয়ে মস্করা! এই যে আতরের গন্ধে মোচড় উঠছে তার নাভিতে, তাই নিয়েও মস্করা! শান্তিতে থাকতে দিলো না বুড়োটা তাকে কোনোদিনই। দূর হ, দূর হ! দূর হয় না সহজে। দিনে কিংবা রাতে হানা দেয় যখন তখন ববিতার ঘুপচি ঘরটাতে। আতরের গা গুলানো কড়া গন্ধটা ছড়িয়ে দেয় ঘরময়। সুরমা দেয়া জুলজুলে চোখে শাসনের ভঙ্গিতে তাকায় ববিতার দিকে। ভয় দেখাতে চায়? পাবে না ভয় ববিতা। হাড়কিটকিটে বুড়ো কোথাকার, শাসন করার অধিকার সে পেলো কোত্থেকে!
বহুকষ্টে উঠে ফ্যানটা চালায় ববিতা। গায়ে হাওয়া লাগতেই অনেকটা হালকা লাগলো নিজেকে। ঘরের বাঁদিকে ড্রেনের ঠিক কাছাকাছি গোসলের জায়গা। টিনের বেড়া আর নীল রঙের মোটা পলিথিনে ঢাকা তার আসা যাওয়ার পথটা। সন্ধ্যে হতে দেরি নেই বেশি। গোসল করে নিলো সে। শুধু পেটিকোট আর ব্লাউজ পরেই চলে এলো ঘরে। আতরের গন্ধটা আর নেই এখন। লাল টুকটুকে একটা ফিনফিনে পাতলা শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে বসলো চারকোণার এককোণ ভাঙ্গা আয়নাটার সামনে। মনে হচ্ছে কেউ যেন বালি ঘসে দিয়েছে আয়নাটার ওপর। প্রায় ঝাপসা। তবুও কেমন মায়া ওর এটার ওপর। চাইলেই ফেলে দিয়ে নতুন আয়না কিনতে পারে। কিন্তু... ওই যে, মায়ায় আটকে আছে মন! ঘন কাজল এঁকে নিলো দু'চোখে। গাঢ় লাল লিপস্টিকে ঠোঁটদুটোকে টসটসে করে তুললো। দু'গালেও একটু ছোঁয়ালো সেই লাল। ঠোঁটের ওপরে চন্দ্রবিন্দুর ফোঁটার মতো কালো তিল বসিয়ে ভালো করে আয়নায় দেখলো নিজেকে। চোখে, ঠোঁটে, গালে কামনা উপচে পড়ছে যেন। সারা শরীরে উথাল পাথাল যৌবন। জানে সে, পুরুষের বুকের ভেতর কাঁপন ধরায় তার এই রূপ। তার ঘরের চৌকাঠ ডিঙ্গানো পুরুষের সংখ্যা দেখে ঈর্ষার আগুনে জ্বলে যায় আরতি, বাতাসি, চুমকিরা। বেশ বোঝে সে। ঘনিয়ে আসছে আঁধার। শুরু হয়ে যাবে আনাগোনা রাতের পাখিদের। ঘরের সাথে লাগোয়া একচিলতে বারান্দাটায় গিয়ে বসলো ববিতা। বসে আছে অন্যরাও নিজেদের ঘরের সামনে। খিলখিলিয়ে হাসছে উৎকট প্রসাধনে ঢাকা মুখগুলো।
লাইটপোস্টের আলোটা তেরছাভাবে এসে পড়েছে ববিতার মুখের ওপর। সেই আলোটা ঢেকে দিয়ে একটা লম্বা ছায়া এসে দাঁড়ালো একেবারে ওর পাশটিতে। বললো, যাবি?
হাতে দামি মোবাইল, ভীষণ সভ্য পোশাকের মানুষটাকে দেখে চমকে গেলো ববিতা। গলির মোড়ে দাঁড়ানো লাল টুকটুকে গাড়িটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকেই। এই বস্তিতে এমন গাড়ির মালিক! স্বপ্ন দেখছে না তো! গায়ে চিমটি কেটে দেখবে নাকি? তখনই আবার শুনতে পেলো,
কী রে, যাবি না?
অন্ধকার ঘরটা দামি পারফিউমের সুগন্ধে ভরে গেলো। বাতি জ্বালাতে দেয়নি লোকটা। আঁধারেই অনুভবে আসে, লোকটা কাঙ্গাল। এতকিছু থেকেও নিঃস্ব একেবারে। আলোতে আসুক তার এই নিঃস্বতা হয়তো চায় না সে। তাই আঁধারে এসে আবার মিলিয়ে গেলো আঁধারেই, কে জানে! যাওয়ার আগে ফিসফিসিয়ে শুধু বলে গেলো...... শুনেছিলাম তুই জাদু জানিস। সত্যি, একদম সত্যি!
অবসন্ন শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো ববিতা। আজ রাতে আর কেউ পার হোক তার দরজার চৌকাঠ চায়নি সে। কয়েকটা কড়কড়ে হাজার টাকার নোট দিয়ে গেছে আঁধারে মিলিয়ে যাওয়া লোকটা। তাছাড়া শরীরটাও ঝিমিয়ে আছে সেই বিকেল থেকেই। চোখের পাতা ভারি হতে হতে যেন তলিয়ে গেলো কোনো এক অতল গহ্বরে। তলিয়ে যেতে যেতে হাজার প্রজাপতির ভীড়ে খুঁজে পেলো নিজেকে। যেন বকুল বিছানো একটা পথ, যেন জলে ধোয়া ঝকঝকে প্রকৃতি চারপাশে। নাম না জানা কত ফুল, আর অসংখ্য প্রজাপতি। মিলিয়ে যাবো যাবো করেও সূর্যটা রয়েই যাচ্ছে যেন। হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওকে, ফুলি...........
আতরের গন্ধটা নাকে ধাক্কা দিতেই ফিরে এলো সেই গহ্বর থেকে। বুড়োটা তাকিয়ে আছে সোজা ওর চোখের দিকে। এমন চাবুকের মতো সেই চাহনি, ভেতরটা কাঠ কাঠ হয়ে গেলো ববিতার। তবুও বুঝতে দিলো না বুড়োকে। বুড়োর ওই চাহনিকে তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে এলো। ঘরের পশ্চিমে, যেদিকে একটা কাঠের চেয়ার টেবিল আছে, দাঁড়ালো সেদিকটায় এসে। বুড়ো তাকিয়ে তেমনই।
--- অতো দূরে গেলা ক্যান ফুলি? কাছে আসো, তুমি না বউ আমার!
--- খবরদার কইতাসি, আর একটা কতা না। এক্ষণই বাইরান আমার ঘর থাইকা! পিরিত দেখাবার আইসেন? বুড়া মাইনষের এত পিরিত ক্যান? আমার জীবনডা শ্যাষ কইরাও শান্তি হয় নাই আপনের?
--- আহা, চ্যাতো ক্যান ফুলি? তুমার তো খুশি হওনের কতা, এত বড়লোকের সাতে বিয়া হইসে। কত আরাম আয়েশ তুমার। গয়না শাড়ি ভালো খাওন! কুনুদিন কি ভাববার পারসিলা, এইসব পাইবা? পারো নাই। তবুও পাইসো। পাইয়াও দিগদাড়ি করো। পরপুরুষের লগে রাইত কাটাও? এইডা আমি কেমনে মাইনা লই, কও তুমি?
--- মানতে না পারলে চক্ষু মুইদা থাকেন। কে কইছে আপনেরে দেখতে?
--- বেগানা পুরুষের লগে মেলামেশা ঠিক না ফুলি, আল্লাহ্ নারাজ হয়। দোজখের আগুনে ভাজা ভাজা হইবার চাও? এখনও সময় আছে, শুনো আমার কতা। বিয়ার পর কত হাউস কইরা তুমারে বোরখা বানাইয়া দিলাম, পর্দায় চলাফেরা করবা বইলা। বড় ঘরের বউ ঝি রা সারাক্ষণ পর্দা মাইনা চলে। বাইরের পুরুষের সামনে মুখ দেখানোও তাগো পাপ। আর তুমি কিনা......! যাউগ্গা, কই ফালাইসো সেই বোরখা খান। আবার বানায় লও। এহন তো আমি বানায় দিতে পারবো না। পারলে তোমারে এমুন বেপর্দা চলতে দিই? জোর কইরা আটকাইতাম। কিন্তু আল্লাহ্ আমারে তুইলা নিলো। বড় অসময়ে তুইলা নিলো! তুমার মতো কচি বউরে সাপখোপের মইদ্যে রাইখাই তুইলা নিলো। এই আপসোস আমার কুনুদিন ফুরাইবো না ফুলি! তাই তো ঘুইরা ফিইরা তুমার কাছে আসি। তুমি রাগ হও তাও আসি।
অতৃপ্তিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো বুড়ো। সুরমার আড়ালে একটু বোধহয় নোনাজলও উঁকি দিলো চোখে। দিক, তাতে ফুলির কী! শুধু টাকা পয়সাই সব? গলা পর্যন্ত কবরে যার সেই বুড়ো কিনা বিয়ে করলো চৌদ্দ বছরের ফুলিকে! কী? না, বউ মরেছে।
বুড়া বয়সে বউ তো মরতেই পারে। ছেলে, বৌমা,নাতি, নাতনিতে ভর্তি বাড়িঘর। তারা নাকি কেউ তার যত্ন নিতে পারবে না। বিয়ে করা লাগবেই।
পরনে একটা বেঢপ ঘটিপ্যান্ট আর কোমরের কুঁচি ছিঁড়ে ঝুলতে থাকা একটা চিটচিটে ময়লা জামা গায়ে ফুলি বেগম মায়ের আঙুল ধরে গিয়েছিলো আক্কাস মিয়ার বাড়িতে। সদ্য স্বামী হারানো তার মা কাজের আশায় গিয়েছিলো ওবাড়িতে। পানের রসে টইটুম্বুর মুখে আক্কাস মিয়ার স্ত্রী বলেছিলো, আইচ্ছা রাখলাম তুমারে, তয় মাইয়াডারে সাতে আইনো না। পোলাপান কামের সময় বড় ত্যক্ত করে।
--- বয়স কত তুমার মাইয়ার?
-- ছয়। তয় আম্মা, অরে রাখোনের কুনু জায়গা নাই। খুব ঠাণ্ডা মাইয়া, আপনেরে একটুও ত্যক্ত করবো না।
--- ঠিক আছে, আইনো তাইলে। তয় সাবধান কিন্তু।
তারপর রোজ মায়ের আঙুল ধরে ভোরবেলায় আসে ফুলি। খায় দায়, জামাকাপড়ও জোটে। একমাথা পাটের আঁশের মতো চুলগুলো তেলে চুপচুপে। সুগন্ধী সাবানে গায়ের কালো হয়ে আসা রঙ ধুয়ে মাজা মাজা শ্যামলা রঙটা হাসিমুখে বেরিয়ে পড়ে যেন। নজরে আসতে থাকে তার মায়া মায়া মুখটা। এই মায়াভরা মুখটার কারণেই হোক, আর ছুটে ছুটে এর তার ফাই ফরমাস খাটার কারণেই হোক, প্রিয় হয়ে গেলো সবার কাছে ফুলি বেগম। একে একে আটটি বছর কেটে গেলো তাদের এ বাড়িতে। সরকারের খাস জমির কুঁড়েঘর থেকে উচ্ছেদের পর এ বাড়ির রান্নাঘরের এক কোণায় জায়গা হয়েছিলো তাদের। কৃতজ্ঞতায় মা তার গদ গদ।
মালকিনের মৃত্যুর চল্লিশ দিন পার হতে যত দেরি, তারপরেই বৃদ্ধ আক্কাস মিয়া জেদ ধরে বিয়ে করার। ছেলেদের তো মাথায় হাত, বুড়ো বাপের এ কী ভীমরতি! ফুলি যে ফুলি, যে কিনা বেড়ে উঠলো চোক্ষের সামনে, তার চেয়েও বড় বয়সের নাতি নাতনি আক্কাস মিয়ার, তারে কিনা বিয়া করবার চায় সেই আক্কাস মিয়াই! তাগোরই বাপ! হায় আল্লাহ্!
নাহ্, আল্লাহ্ আক্কাস মিয়ার ছেলেমেয়েদের হাহাকারে সাড়া দেয়ার সুযোগই পায়নি। তার আগেই বাড়ির লাগোয়া দু'কাঠা ভিটে ফুলির নামে লিখে দেয়ায় হাত হয়ে গেলো ফুলির মা।
স্বপ্নেও ভুল করে কখনও চায়নি যা, পেয়ে গেলো। মালকিনের দুই একটা গয়না, সোনালী জরির ঝকমকে বেনারসি আরও কত কী! ফুলি তার রাজরাণী এখন। সুখে তার রাতের ঘুম যায় যায়।
বুড়োর সাদা জোব্বা থেকে আতরের গন্ধটা বাতাসে ভেসে ভেসে যেন ববিতার মাথার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। অসহ্য....অসহ্য! দু'হাতে মাথা চেপে ধরে ধপ করে চেয়ারটায় বসে পড়লো সে। হামানদিস্তায় পান ছেঁচা হাসিটা বেশ কায়দা করে এমন সময়েই হাসলো বুড়ো। এক ঝটকায় উঠে ঘরের বাতিটা জ্বেলে দিলো ববিতা। কেউ নেই। বুক ভরে শ্বাস নিলো ও, আহ্..... আতরের গন্ধটাও নেই! রাত বাকি আছে আরও কিছুটা। বাইরে অন্ধকার এখনও অনেক গাঢ়। নিবিড় এই আঁধারে কিছু মুহূর্ত খুব মিষ্টি পরশ বুলিয়ে দিলো যেন ববিতার চোখে। যদিও মুহূর্তগুলো পেরিয়ে এসেছে অনেকটা সময়। তবুও সেগুলো ভালোলাগার প্রলেপ দিলো ওর বেদনায়। সদ্য পাঁপড়ি মেলা গন্ধরাজের মতো বউটাকে সবসময় চোখে চোখে রাখতো বুড়ো। জড়িয়ে ধরে আদর করতে চাইতো যখন তখন। কিন্তু চাইলেই কি আর হয়? ঝিমিয়ে যাওয়া যৌবন তার কেন যেন জাগতেই চাইতো না! নিষ্ফল চেষ্টার পরিশ্রমে ঘুমে ঢলে পড়তো বুড়ো। দু'হাতের শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে রাখা ফুলি আলগা হয়ে যেতো কখন টেরই পেতো না! চুপিচুপি সেই বাঁধন আরও খানিকটা আলগা করে ফুলি তখন উঠে পড়তো। বুড়োর ঘরের সাথে লাগানো বাথরুমে গিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে ঠান্ডা পানির ধারা বইয়ে দিতো শরীরে। সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে বুড়োর ব্যবহৃত আতরের গন্ধ দূর করার চেষ্টা করতো প্রাণপণে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে গাঢ় নিঃশ্বাসের শব্দে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তো ফুলিও। একদিন কি ভেবে সিঁড়িভেঙ্গে উঠে পড়লো ছাদে। বিশাল ছাদ। আগে কত উঠেছে, কিন্তু বিয়ের পর বুড়োর কড়া বারণ। দীর্ঘ বিরতির পর হঠাৎ ছাদে যেতে কেমন যেন ভয় ভয় করছিলো ফুলির। তারওপর আবার গভীর রাত। বুড়ো টের পেলে কি হবে কে জানে! তবুও উঠে গিয়েছিলো ও। ভীষণ আঁধার চোখে সয়ে যাওয়ার পর তো ফুলি তাজ্জব! তার আগেই কে যেন এসে বসে আছে ছাদে। একটা ছায়া যেন নড়ে উঠলো তার আভাস পেয়ে। ঘুরে এক্কেবারে ফুলির দিকেই তাকালো। আতঙ্কে ছুটে সিঁড়ির দিকে চলে আসতে চাইলো ফুলি, কিন্তু পারলো না। তার আগেই জাপটে ধরলো ফুলিকে সেই ছায়া। চিৎকার করতে চাইলো ফুলি, কিন্তু শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া ফুলির গলা দিয়ে কোনো আওয়াজই বের হলো না। ছায়াটি ততক্ষণে ওকে ধরে বসিয়ে দিয়ে বললো, এত ভয় পেলে চলে? বলে হাসতে লাগলো।
বুঝলো ফুলি, আক্কাস মিয়ার মেজো নাতি। মেলা বড় পাশ দিবো বইলা যে শহরেই থাকে। ছুটি ছাটায় বাড়িতে আসে। লজ্জায় ফুলি আরও কাঠ হয়ে গেলো।
--- তুমি কি রোজ রাতেই ছাদে আসো?
ফুলি মাথা নাড়ে জোরে জোরে। এই পোরথম, বিশ্বাস করেন বিয়ার পর এই পোরথম!
--- ও আচ্ছা, এত ভয় পাচ্ছো কেন?
--- দোহাই লাগে, আপনের দাদাজানরে কিছু কইয়েন না। আর কুনুদিন আসুম না আমি!
আবার হেসে উঠলো আক্কাস মিয়ার নাতি।
--- বলবো না। কিন্তু কাল রাতে যদি আবার আসো তবে। তা না হলে বলে দিতে পারি!
ধান্দায় পড়ে গেলো ফুলি। এই পোলা তারে রাইতের কালে ছাদে ডাকে ক্যান? ভুল কইরা একদিন নাহয় আইসা পড়সে, তাই বইলা আবার! যদি ধরা পইড়া যায়! কিন্তু..... না আইলে যদি কইয়া দেয়! এই দোটানায় দুলতে দুলতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে চলে আসে। নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ে ঘাপটি মেরে। নাহ্, জাগেনি বুড়ো। কিন্তু হৃদয়ে কেমন যেন তোলপাড় হতে থাকে। বাকি রাত দুই চক্ষে আর নামে না ঘুম। বড় অস্থির... বড়ই অস্থির ফুলি আজ। অচেনা..... ভীষণ অচেনা এক ইচ্ছে জেগে উঠছে বুকের ভেতর। এক অজানা কাঁপন টের পাচ্ছে সে। প্রস্ফুটিত যৌবন তার যেন বাঁধন আলগা করে জেগে উঠতে চাইছে ভীষণভাবে। বুড়োর স্পর্শে কোনোদিন এমন হয়নি তো! কিন্তু.... ও যে বুড়ো আক্কাস মিয়ার বিয়ে করা বউ। তবে কেন অন্য কারো ছোঁয়ায় কাঁপছে তার বুক ভালোলাগায়? শরীরে তার এত আবেশ কেন জাগলো ওই ছোঁয়ায়? কী করবে ও এখন? পরপুরুষের কথা ভাবনায় আনাও যে পাপ। কিন্তু শরীর যে চাইছে! অচেনাকে জানার প্রবল ইচ্ছেটাকে কেমন করে চেপে রাখবে ফুলি? অন্ধকার ছাদ যে তাকে ডাকছে বার বার! সেই ডাক উপেক্ষা করার শক্তি আছে কি তার? না নেই। আর কেনই বা উপেক্ষা করবে ফুলি সেই ডাক? যাবে সে। কাল রাতে যাবে সে ছাদের অন্ধকারে।
পরের রাতে গিয়েছিলো ফুলি সেই অন্ধকার ছাদে। মিয়ার নাতি যেন অপেক্ষায় ছিলো ভীষণ। ফুলি যেতেই এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিলো যেন দম আটকে যাবে। যেন তার গরম নিঃশ্বাসে পুড়িয়ে দেবে ফুলিকে। সারাগায়ে গতরাতের সেই অদ্ভুত শিহরণ টের পেয়েছিলো ফুলি। আগে কখনও এমন শিহরণ অনুভবে আসেনি তার। সেই শিহরণে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ফুলি যেন নিজের ভেতর দেখতে পেলো একটা দু'কূল ছাপানো নদী। আর সেই নদীর ছলাৎছল ঢেউয়ে দুলতে দুলতে চলে গেলো সে বহুদূর... বহুদূর! যেন হারিয়ে গেলো।
তারপরে ছুটির প্রায় প্রতিটি রাত ছিলো ওদের হারিয়ে যাওয়ার রাত। হারাতে হারাতে ফুলি শুনতে পেতো সেই যুবকের প্রেমের কথা, ভালোবাসার কথা। হতবাক ফুলি তখন চৌদ্দ ছেড়ে আঠারোয়। তবুও শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা যুবকের কথাগুলো কেমন যেন দুর্বোধ্য লাগতো তার কাছে। কেমন যেন ভয়, তবুও অদ্ভুত এক আবেশ। সেই আবেশের প্রতীক্ষায় থাকতো দু'জনেই সবার অলক্ষে।
এরপরের ঘটনাগুলো ঘটে যায় খুব দ্রুত। যেন স্বপ্ন! এক জ্যোৎস্নারাতে আক্কাস মিয়া এ সংসারের মায়া ছেড়ে, তার টলোমলো যৌবনবতী বউকে ছেড়ে চলে গেলো ওপারে। মিয়াসাহেবের ছেলেরা তাদের বাপের বউটাকে আর স্বীকারই করতে চাইলো না! জোর করে সাদা কাগজে বুড়ো আঙুলের টিপ নিয়ে তাড়িয়ে দিলো ফুলিকে। ফুলির মা বুক চাপড়িয়ে অভিশাপ দিতে দিতে বেরিয়ে এসেছিলো ও বাড়ি থেকে মেয়ের আঙুল ধরে। মিয়ার সেই নাতি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখেছিলো সব। এমন ভাব যেন ফুলিকে সে চেনেই না! কেন যেন একটুও কাঁদেনি ফুলি। শক্তমুখে মায়ের আঙুল ধরে বেরিয়ে এসে হাঁটা দিয়েছিলো অজানার পথে। গাঁয়ের শেষ মাথায় শাপলা বোঝাই দীঘিটার পাড়ে যে বিরাট আমগাছটা, তার নিচে যে মাটির বাড়িটা, সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে একজন জানতে চেয়েছিলো সমাচার। কেঁদেকেটে ফুলির মা বলেছিলো সব। সেই একজনকে ভাই বলেও সম্বোধন করছিলো ফুলির মা। সেই ভাই সব শুনে বললো, শহরে কামের ছড়াছড়ি। মাইয়ারে পাঠাও আমার লগে। হাজার হাজার টাকা কামাইয়া পরে তুমার মাইয়াই লইয়া যাইবো তুমারে। ততদিন তুমি আমাগো বাড়িতেই থাকো, চিন্তার কিসু নাই। কোন দূর সম্পর্কের ভাই, যাকে ফুলি তো দূরের কথা, ফুলির মাও কোনোদিন তাদের খোঁজখবর নিতে দেখেনি। না নিক, এই অসময়ে তাদের পাশে তো দাঁড়াতে চাইছে, কম কী! একেবারে গলে গিয়ে ফুলির মা পাঠিয়ে দিলো মেয়েকে। মায়ের সেই ভাই ফুলিকে শহরে নিয়ে এসে বেঁচে দিলো এই রঙমাখা বস্তিতে। মা তার জানতেই পারলো না, ফুলি তার কখন কখন ববিতা হয়ে গেলো!
এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরেও কেন যেন ভুলতে পারে না ববিতা সেই আঁধার ছাদের শিহরণ। দুখে ভরপুর জীবনে সেটুকুই একটু সুখের স্মৃতি বলেই হয়তো! একথা মনে হতেই আর রাগ থাকে না তাকে কয়েকদিনের আদরে ভরিয়ে দেয়া সেই যুবকের ওপর। কিন্তু বুড়ো আক্কাস মিয়া! বুঝতো না বলে বিয়েটা তখন বড় প্রাপ্তি মনে হয়েছিলো ফুলি আর তার মায়ের। কিন্তু ঠকেছে তো সে বুড়োর কারণেই! দু'কাঠা মাটির লোভে ঠকানো হয়নি তাকে! অবশ্য বউ বলে একটু আধটু ভালোও কি বাসতো বুড়ো তাকে? কে জানে! সবসময় তো চোখে চোখে রেখে জীবন অতীষ্ট করে তুলেছিলো। এখন আবার তার ঘুপচি ঘরে এসে তাকে শাসন করার চেষ্টা! টিপছাপ নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিলো যখন, তখন তো কব্বর থেকে একবারও আসেনি সে! এখন আবার শাসন দেখায়! কিসের শাসন! না খেয়ে মরবে নাকি ববিতা? তাছাড়া এখন তো সে ফুলি নয়, ববিতা। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত একটু ঘনালেই কত টাকা আসে তার হাতে! সেই যে বিক্রি হয়ে গেলো ফুলি, তারপর আর যায়নি গাঁয়ে। কোন মুখে যাবে? টাকা পয়সা পাঠিয়েছে মাকে। পরে যখন একটা মোবাইলের মালিক হলো সে, কথাও হতো তখন মায়ের সাথে। তবে খুব কম। মায়ের সেই ভাই ফোন দিতে চাইতো না মাকে, নানান টালবাহানা। খুব কাহিল গলায় কথা বলতো ওর মা। টাকা পেয়েছে কিনা জানতে চাইলে কেমন আমতা আমতা করে বলতো, পেয়েছে।
হঠাৎ একদিন শুনতে পেলো, মরে গেছে ফুলির মা। সেদিন খুব কেঁদেছিলো ফুলি। আর কেউই যে রইলো না তার!
দু'চোখ জ্বালা করে উঠলো ববিতার। বাতিটা নিভিয়ে বিছানার পাশের জানালাটা খুলে দিলো। কোথাও শিউলী ফুটেছে কী? ফোটারই কথা। একটু যেন হিম হিম বাতাসে ভেসে এলো তার সুবাস! দূর্বা ঘাসে জমে কি এখনও শিশির সেই গাঁয়ে? পথের ধারের কলমিঝোপে এখনও ফোটে কি সাদা কিন্তু সাদা নয়, ঠিক বেগুনীও নয় আবার গোলাপীও নয়, এমন কলমি ফুলগুলো?
আহ্..... ধীরে ধীরে বাড়ছে শিউলীর সুবাসটা। গুমোট ঘরটা তার ভরে যাচ্ছে মিষ্টি গন্ধে। বুক ভরে স্বাস নিলো ববিতা। একবার, দুইবার, তিনবার.......
হঠাৎ আবার সেই অনুভূতি। সেই আতরের গন্ধ, সেই মোচড় নাভির চারপাশে। নাহ্, একেবারে পেয়ে বসেছে যেন তাকে গন্ধটা! গা গুলিয়ে ওঠার আগেই বেরিয়ে আসতে হবে ওখান থেকে। আর চায় না পেতে ও সেই গন্ধ, সেই হামানদিস্তায় পানছেঁচা হাসিটাও শুনতে চায় না আর। ওসব ওর অতীত। যে অতীতে ফুলি ছিলো। এখন নেই। এখন ববিতা আছে, আছে রাতের বস্তি, খিলখিল হাসি। এখানেও ভোর আসে, শিউলীর সুবাস আসে, আলো আসে জানালা দিয়ে । ওই যে, একটু একটু ফর্সা হচ্ছে আকাশের পুব দিকটা............