ছায়াশরীরের প্রাণ
৬৭ বছর বয়সে ৬৭ কদম হাঁটার সামর্থ্য নেই রইস বেগের। তবু ক্লান্ত শরীরটাকে দুলিয়ে দুলিয়ে বৈকালি ভ্রমণে বের হন। আর সে-সময়ই পোড়া বাড়ির জীর্ণসৌন্দর্য তার চোখ ভেদ করে মস্তিষ্কে গিয়ে আঘাত হানে। অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকানোর পর মাথাটা যখন ভোঁ-ভোঁ করে ঘুরতে থাকে তখন তিনি বার্ধক্যের দুরন্ত যন্ত্রণা উপভোগ করেন আর কিছু দূরে চালতে-তলার শিকড়ে আশ্রয় নেন। কিছুটা হাঁপুনি ওঠে নিঃশ্বাসের ঘরে। কপাল থেকে ঘামের বিন্দুগুলো এক আঙুলে জড়ো করে মাটিতে নিক্ষেপ করেন। পোড়াবাড়ির দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখতে পেলেন তিতু মিয়া তার দিকেই আসছে। গামছাটা কোমর থেকে খুলে ঘাসের বালি ঝেড়ে তিতু মিয়া বসে যায় রইস বেগের পায়ের সামনে। রইস বেগ তার বয়সের ভারে জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললেন, কিরে তিতু, তোর খবর কী?
ভালা না সাব।
কী হইছে?
যে টাকা আয় করি তা দিয়া সংসার চলে?
বাচ্চা-কাচ্চাও তো কম না!
সবই আল্লার দান।
তা ঠিক।
সাব, কইছিলাম কি! ঐ এগারো বছরের উবিটারে যদি আপনার বাড়িত নিতেন তইলে কিছুটা অইলেও...
তোর সংসারে যখন এতই ঠেকা কী আর করা!
ত সাব, কালক্যাই উবিরে পাঠাইয়া দিই?
দে।
পা ছুঁয়ে রইস বেগকে সালাম করে তিতু মিয়া গামছাটা কোমরে বেঁধে চলে যায়। ফের একা হয়ে পড়েন তিনি এবং সঙ্গে সঙ্গে পোড়া বাড়িটির দিকে চোখ পড়ে তার। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে জমিদার রঞ্জন রায় বাহাদুর চৌধুরীর এই বাড়িটি বৈরাগীর মতো পড়ে আছে। একাত্তরে বাড়িটিতে জমিদার বাবুর নাতি উৎসব চৌধুরীর বসতকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দখল করে নিয়ে ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করেছিল। উৎসব চৌধুরী যুদ্ধ-পরবর্তী ভারত থেকে ফিরে এসে পুড়িয়ে দেওয়া বাড়িটির কংকাল দেথে তৎক্ষণাৎ ইহলোক ত্যাগ করে পরলোকে পা বাড়ান। সেই সুযোগে রইস বেগ নামমাত্র মূল্যে তার পরিবার থেকে কিনে নেন পোড়াবাড়িসহ সমস্ত সম্পত্তি। তারপরই তিনি অত্র অঞ্চলের সবচেয়ে বিত্তশালী লোক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। চালতে গাছের শিকড় থেকে উঠতে উঠতে সামান্য কুঁজো হয়ে যাওয়া মেরুদণ্ডটিকে সোজা করে দাঁড়াতে গিয়ে ব্যর্থ হন। মনে মনে ভাবেন যৌবনে কত কী খেলেছেন সোজা শিরদাঁড়া নিয়ে। হাঁটাটা শম্মুকগতি থেকে সামান্য বাড়িয়ে ঘরের দিকে চললেন। এই তো এভাবে ৫ মিনিট ৪৪ সেকেন্ড হাঁটলে ঠিক ঘরের মেঝেটাতে গিয়ে পৌঁছবেন। উঠোনটিতে এসেই দরাজ গলায় কথা ছড়ালেন, দলিজ, কইরে?
দলিজ ঘর থেকে ব্যস্তভাবে বের হতে গিয়েই চৌকাঠে পা লাগিয়ে উহ্ করে উঠলো। তারপর ব্যথার জায়গাটিতে থুথু দিয়ে দুটো ডলা দিয়ে কাষ্টকণ্ঠে বলল, কন, কী করতাম?
বাডাইল্যার টং থ্যাইক্যা আমার নাম কইয়া পাঁচটা সিগারেট লইয়ায়। আর হুন আওনের সময় সুবেত মিয়ার বাড়ি অইয়া আইছ। কইছ আমার লগে যেন রাত্রে এট্টু দেহা করে।
আইচ্ছা।
বলেই দলিজ বের হয়ে যায়। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে রইস বেগ তার স্ত্রীকে ডাকে, ও রফিকের মা, কী করতাছো? এট্টু এদিগ আইও। রইস বেগের স্ত্রী মালেকা বেগম বসার ঘরে প্রবেশ করে, কন, কী কইবেন!
বসো বসো!
এই নেন, বসলাম। এইবার কন, কী কইবেন!
আমাগো পাড়ার অই তিতু মিয়া আছে না! তার সংসারে নাকি খুবই টানাটানি। আমারে কইল, আর আমিও রাজি হইয়া গেলাম।
কী কইল আর আপনি রাজি অইয়া গেলেন!
আরে হুন রফিকের মা, হের একটা মাইয়া উবি না টুবি আছে না! হেয় এখন থাইক্যা আমাগো বাড়িত থাকব।
কি কন আফনে! এমনেঐদো দলিজ আছে, আলোর মা আছে! আরো কাজের মানুষ দরকার আপনের?
আগো রফিকের মা, হেইজন্য না। আইচ্ছা, কওতো দেহি, রফিক বড় হওয়ার পর কয়দিন বাড়িত আছিল! না হের বৌ, না হের পোলা মাইয়া! বাড়িডা বড় খাঁখাঁ করেগো রফিকের মা।
আপনে যা-ই বলেন!
অমত কইরো নাগো। কও কী নাই আমগোর?
রইস বেগ রাতের খাবার খেয়ে আরাম করে চেয়ারে বসেছেন। হাতে সিগারেট। পাশে বসা সুবেত মিয়া। সুবেত মিয়া ঘুমোঘুমোভাবে বলল, বুঝছো রইস ভাই, শইলডা আর কুলায় না। একবার ভাবো তো, একাত্তরে এই শইলডা নিয়াই আমরা পাকিস্তানের পক্ষে নামছিলাম। তোমার মনে আছে, হানাদার বাহিনীর সাথে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করছিলাম! রইস বেগ ফিসফিস করে বললেন, আস্তে ক-রে এসব।
আস্তে কমু কেরে? এহন এই তল্লাটে আমাদের উপর কথা কইব এমুন মানুষ আছে!
নাই যে হেইডা জানি। তবু এই সব বলা ঠিক না।
তুমি হুদা হুদা ডরাও! তোমার মনে আছে, তোমার বাড়ির কাজের মাইয়া কলিমনের কথা? আরে আর কয়দিন বাঁচমু কও, এখন যদি সুখদুখের আলাপ না করি, তবে আর কবে করমু? কয়দিন পরে দেখমু হুট কইরা একদিন মইরা গেছি।
তাই বইলা!
আরে ধুর রইস ভাই, তুমি একটা বেরসিক। কলিমনরে যেদিন তুমি আমার হাতে তুইল্যা দিয়া কইলা তারে ক্যাম্পে দিয়া আয়, আমি কিন্তুক হেইদিন তারে ক্যাম্পে দিই নাই। বুঝতেই পারতাছো... হা... হা...।
থামলি, থামলি তুই! বলে রেগে গিয়ে আরো বললেন, তোর এখানে আর দরকার নাই। তুই এহন বাড়িত যা।
সুবেত মিয়া চলে গেলে তিনি বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলেন। কিছুতেই ঘুম লাগাতেই পারলেন না দু চোখের পাতায়। বারবার শুধু সুবেত মিয়ার কথাগুলোই তার কানে বাজছে। চোখের সামনে ভেসে আসছে ক্যাম্পের একটি রুমে আটকে রাখা উলঙ্গ কলিমনের দৃশ্যটি। রইস বেগ ছটফট করতে লাগলেন। বিছানা থেকে উঠে ঘড়ি দেখলেন। দুইটা আটাশ। গ্লাসে পানি ঢেলে ঢগঢগ করে তৃষ্ণা মেটালেন। তারপর বারান্দায় কিচ্ছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ফের পিঠ লাগালেন বিছানায়। অবশেষে বহু কষ্টে ঘুম এলো শেষ রাত্রের দিকে। কিন্তু ঘুমের মধ্যেও তিনি জেগে রইলেন। স্বপ্ন এসে তার ঘুম দখল করে নিল। তিনি দেখতে লাগলেন, কলিমন বড় একটা রামদা হাতে পোড়া বাড়ি থেকে বের হয়ে তার দিকেই ছুটে আসছে। আর তিনি প্রাণ রক্ষায় ছুটছেন বাজি রেখে। কলিমন ক্রমশই তার দূরত্ব কমিয়ে ফেলছে। তিনি আর পারছেন না। কলিমন এই রামদা দিয়ে কোপ বসালো বলে!...
স্বপ্নঘুম থেকে চিৎকার করে জেগে উঠলেন তিনি। পাশে তাকিয়ে দেখলেন তার স্ত্রী শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। বিছানা ছেড়ে ফের উঠে এলেন। সকাল হতে আরো বেশ বাকি। কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়িত চাঁদ ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে সামান্য লাবণ্য বিলাচ্ছে। মৃতপ্রায় চাঁদটার দিকে তাকিয়ে রইস বেগ ভাবলেন তিনিও বুঝি কৃষ্ণপক্ষের মানুষ। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বাকি রাতটা না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু সকাল হতেই শুয়ে গেলেন বিছানায়। এবার ঘুম এলো বর্ষা-বৃষ্টির আকাশের মতো মেঘ-ঘন করে।
মালেকা বেগম নিজেই এসে রইস বেগকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললেন, দেখে যান, দেখে যান কে আইছে! আনন্দজনিত স্বর তার। রইস বেগ বললেন, কে এসেছে?
আরে, কাল যে বলছিলেন, তিতু মিয়া আর তার মেয়ে উবি!
রইস বেগ ঘুম থেকে জেগে বাইরে এসে দেখেন সত্যিই। কিন্তু মেয়েটাকে দেখেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। তিনি বলতে লাগলেন, নাহ্ নাহ্!
তিতু মিয়া তাকে সালাম করে বলল, সাব, মাইয়াডা আমার খুব ভালা। হুদা একটাই দোষ, এই দা নিয়ে খাড়াইয়া থাহে। তয় খুবই শান্ত।
রইস বেগের স্ত্রী বললেন, উবিকে আমারও খুব পছন্দ হয়েছে। কেন জানেন? উবি হলো আমাদের যে কাজের মেয়ে কলিমন ছিল, তার আপন ছোট বোনের মেয়ে। আর দেখেন, চেহারাটাও ঠিক কলিমনের মতো। যুদ্ধের সময় কলিমন কোথায় যে হারাইয়া গেল! তার কোনো খোঁজই আর পাইলাম না।
রইস বেগের সামনের চারিপাশ ঘুরতে লাগল। তার চোখের সামনেই এই উবি নামের মেয়েটা কলিমনে রূপান্তরিত হতে লাগল। সত্যি, কলিমন যেন তার অতি সম্মুখে দা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। এক্ষুনি বুঝি এক কোপে দেহ থেকে তার মাথাটা আলাদা করে দেবে। আর কাটা মাথাটাকে বাঁশের কঞ্চির একমাথায় গুঁজে সারা গ্রাম ঘুরবে কলিমন। দৃশ্যটি রইস বেগের চোখের সামনে ভাসতেই তিনি সবকিছু কেমন আবছা দেখতে লাগলেন। শরীরের কোনো অংশে তিনি আর দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পেলেন না। দাঁড়ানো থেকে ঢলে পড়লেন মাটিতে।