সার্টিফিকেট

  • তুষার আবদুল্লাহ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

ফটো গ্যালারিতে হন্যে হয়ে খুঁজেও ছবিগুলো পাওয়া গেল না। নাকি আছে। এমন কোনো কোনো দিন হয়, প্রয়োজনের সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। পরে গ্যালারিতে ঢুঁ দিলে প্রথমেই সেই ছবি ভেসে ওঠে। আজকের ব্যাপারটাও হয়তো তাই। ছবি খুঁজতে গিয়ে আইফোনের চার্জও ফুরিয়ে গেছে। মামুন হোসেন উঠে গিয়ে আইফোন চার্জে দিল। চার বছর হলো ডিএসএলআর ক্যামেরা হাতে তুলে নেন না তিনি। আইফোনের ক্যামেরাই সর্বক্ষণের সঙ্গী। ক্যানন মার্ক থ্রি পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন। এখন ডিএসএলআরের স্বাদ আর ভালো লাগে না। লেন্স-বডি নিয়ে চলাচলের শক্তিটাও বুঝি ফুরিয়ে গেছে। শরীরের না মনের শক্তি। তাই তো শহর ছেড়ে আসা। ডামাডোলের বাইরে। কত মুখ ল্যান্সে ধরা পড়েছে, সবাইকে সামনে আনতে পারেননি। ডার্করুমেই মৃত্যু। ডিজিটাল যুগে এসে হার্ডডিস্কে বন্দী। মামুন হোসেন চাইলেই তো হবে না, পত্রিকার সম্পাদক, মালিকের চাওয়াটাই বড়। কখন কাকে সামনে নিয়ে আসবেন, তা তো তাদের বাণিজ্য-ভাবনা। বাজার দেখে মুখ তুলে আনা। কিংবা নিজের মতো করে বাজারে মুখ ছেড়ে দেওয়া। মামুন হোসেনকে এমন অনেক মুখের ছবি তুলতে হয়েছে। মন চায়নি, চোখ চায়নি। চোখ দেখেওনি। ল্যান্স যতটুকু দেখেছে, তাতেই বাজিমাত। চোখ দেখলে যে কী হতো!

আইফোনের ক্যামেরা অপশন নিয়ে মামুন হোসেনের দিন কাটে। কতভাবেই না ছবি তোলা যায় মুঠোতে মুখ গুঁজে থাকা এই ডিভাইস দিয়ে। বিস্ময়। সত্যি প্রতিমুহূর্তে তিনি বিস্মিত হন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর সময় মানুষের মুখ, সবুজ কোনো পাতার করতলে জায়গা পাওয়া রোদ, একাকী মেঠোপথে ঝ’রে পড়া বৃষ্টি, কোনো কিছুই মামুন হোসেনের চোখ এড়ায় না। আইফোনের ল্যান্সেরও যেন পলক পড়ে না। মামুন হোসেনের কখনো মনে হয় রসুল্লাবাদ দিয়ে যখন তিনি হেঁটে যাচ্ছিলেন। কাঁধে রাইফেল। সঙ্গীরা তার পেছনে। এমন একটি ছবি যদি তোলা থাকত। রণাঙ্গনে অনেকের হাতেই ক্যামেরা ছিল। মামুন হোসেনের সঙ্গে ছিল একটা। কিন্তু নবীনগরে এক অপারেশন শেষে ওই ক্যামেরা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। হারিয়ে গেছে ফিল্মগুলোও। গঙ্গা সাগর ব্রিজ উড়িয়ে দেবার অপারেশনের কিছু ছবি তোলা ছিল। আখাউরা রেলস্টেশন, গোকর্ণঘাট অপারেশনের ছবিও মামুন হোসেনের কাছে ছিল। আজ এই ছবিগুলো ইতিহাসের দলিল হয়ে থাকত। শ্যামগ্রাম স্কুলে কাটানো কয়েকটি রাতেও কথা আজও ভুলতে পারেনি মামুন হোসেন। রাতভর লোকমানের গান। চারুমিঞার পুঁথি। রওশন সকালে সন্ধ্যায় বানিয়ে নিয়ে আসত গুড়ের চা। হারিকেনের আলোয় সেই রাতগুলো পূর্ণিমা হয়ে উঠত গ্রামবাসী আর মুক্তিসেনাদের আড্ডায়।

বিজ্ঞাপন

একটি মুখ মনে পড়ে মামুন হোসেনের। মনে পড়ে বলা বুঝি ঠিক হলো না। সব সময় মুখটি তার সঙ্গে চলছে সেই একাত্তর থেকে। শ্যামগ্রামেই পরিচয়। অনিমা গোস্বামী। ওদের বাড়িতে প্রায় রাতেই খাবারের আয়োজন হতো। অনিমা এসে দাওয়াত দিয়ে যেত। খাবারের চেয়েও মামুন হোসেনের লোভ ছিল অনিমার গানের প্রতি। রবীন্দ্র-সংগীত প্রাণ দিয়ে গাইতো ও। শাহপুরে যেদিন হানাদার বাহিনী হামলা করে, সেদিন শ্যামগ্রাম জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। যদি হানাদার বাহিনী এই গ্রামে এসে হাজির হয়। গ্রাম-ভর্তি হিন্দুদের ঘরবাড়ি। এ-গ্রামের তিন চারটি পরিবার মেঘনা পাড়ি দিয়ে  ভৈরব হয়ে আগরতলার দিকে চলে গেছে। বাকিরা যাননি। মামুনদের দলটি শ্যামগ্রাম আসার পর এখানে দীর্ঘ সময় অবস্থান নেওয়ার কারণ হিন্দু পরিবারগুলোকে রক্ষা করা। শ্যামগ্রামের চারদিক ঘিরে তারা পাহাড়ায়। এদিকে কোনো সড়ক পথ নেই। আসতে হলে জলপথে আসতে হবে হানাদার  বাহিনীকে। সেইদিক থেকে শ্যামগ্রাম অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। হানাদার বাহিনী হুট করে চলে আসতে পারবে না। তবে সেপ্টেম্বরে মামুন হোসেনসহ চারজনকে শ্যামগ্রাম ছেড়ে যেতেই হয়।

হোমনায় যেতে হয় তাদের। যেদিন শ্যামগ্রাম ছেড়ে যাবেন মামুন হোসেনরা, সেদিন পুরনো মঠে অনিমা ডেকে নিয়ে গেছিল মামুন হোসেনকে। অমাবশ্যা রাতে আলো ছড়াচ্ছিল অনিমা। অনিমার আলোয় পথ দেখে চলছিল মামুন হোসেন। পুরনো মঠের ভেতরে ঢুকে অনেকক্ষণ মামুন হোসেনের হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল অনিমা। অনেকক্ষণ পর মুখ ফুটে বলে—যাচ্ছো তাহলে? মামুন হোসেন কাঁধ ঝাঁকায়। অনিমা মেহেদী পাতা বেটে এনেছিল। মামুন হোসেনের ডানহাতের করতলে ‘অ’ এঁকে দিয়ে বলে—যাও। সঙ্গে রেখো আমাকে। ওই ‘অ’ কবেই মুছে গেছে। কিন্তু অনিমার মুখটি তো এক মুহূর্তের জন্য আড়াল হলো না।

বিজ্ঞাপন

যুদ্ধের পরে যখন ক্যামেরা হাতে তুলে নিলেন, তারপর তো কম রমণীকে লেন্সে আটকাতে হয়নি। মামুন হোসেনের প্রতিবারই মনে হয়েছে, এখনো হয়-তিনি অনিমা গোস্বামীর ছবিই তুলে যাচ্ছেন। এত বছরে অনিমা এতটুকু বদলে যায়নি। ঠিক আগের মতোই আছে। কপালের টিপ আছে তেমনই। অনিমার কপালে বাংলাদেশ। মামুন হোসেন এমনটাই বিশ্বাস করেন। অনিমার সবুজ কপালে লাল টিপ। যখন কোথাও পতাকা ওড়ে, মামুন হোসেন পতাকা নয় দেখতে পান অনিমাকে। জুলাইর কোনো একদিন বটেশ্বরী গ্রামে যেতে হয়েছিল। বিশেষ কোনো কাজে নয়। নীল কমল দেখতে। কতদিন নীল কমল দেখা হয় না । মামুন হোসেনের ঢাকার বাড়ির ছাদে অপরাজিতা ও নীলকমল ভাই-বোনের মতো ফুটে থাকত। জলপুর এবং আশপাশের গ্রামে তাল আর খেজুর গাছ। উঠোনে ফুল ফোটে, ঝুমকো  ও লাল জবা আর মাধবীলতার বাইরে খুব বেশি ফুল দেখা যায় না। বনফুল তো আছেই। ফড়িং দেখতে গেলে বনফুলও দেখা হয়ে যায়। কয়েকদিন খুব নীলকমল দেখতে ইচ্ছে করছিল। তাই বটেশ্বরীতে যাওয়া। বিকেলে ফিরে আসার সময় বিহগলের সুর কানে আসে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গ্রামের একজন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন। তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানিয়ে বিদায় জানানো হচ্ছে। মামুন হোসেন পৌঁছানোর আগেই আনুষ্ঠানিকতা শেষ। কিন্তু মরদেহের ওপর বিছানো জাতীয় পতাকার দিকে স্থির হয়ে যায় তাঁর চোখ। আইফোনে কয়েকটি ছবি তুলে নেন। মামুন হোসেনের কাছে এ এক অপূর্ব ছবি। মরদেহ ঢেকে আছে বাংলাদেশে। মরদেহ ঢেকে আছে অনিমায়। মামুন হোসেনের চোখ জলে ভেসে যায়। কেউ একজন পাশ থেকে হয়তো বলল—আপনার চেনা মানুষ, কিছু লাগত? মামুন হোসেন কিছু বলেন না। ওই ময়দান থেকে সরে আসেন। বাজারে এসে চায়ের দোকানে বসেন। এদিকে এলে গরুর দুধের চা খাওয়া মামুনের হোসেনের সখ। চিনি ছাড়াই খান। মাঝে মধ্যে অবশ্য গুড়ের জিলিপিও চলে। আজ মন কেন যেন সায় দিচ্ছে না কিছু খেতে। তারপরও দুধ চিনি ছাড়া চা-ই নিলেন আজ।

মামুন হোসেনের সামনের টেবিলগুলো ফাঁকা। টিনের একটা গ্লাস, পুরনো দিনের একটা কাপ রাখা সামনের টেবিলে। তাদের ডিঙিয়ে চোখ চলে যায় মাঠের সরিষা ফুলের দিকে। আইফোনে এভাবেই ছবিটা ধরতে চাইলেন। কিন্তু ফ্রেমের ভেতর একটা মুখ ঢুকে পড়ল। মামুন হোসেনের চোখে বিরক্তি দেখে মুখটি হেসে বলতে থাকে—আমি এমনই বেহুদা ঢুইকা পড়ি। আবার তুলেন। আর ঢুকব না কেউ। মামুন হোসেন এবার ঠিকঠাকমতো ছবি নিতে পারলেন। সেই মুখ জগ থেকে পানি ঢেলে দুইগ্লাস খেয়ে নিলেন। তারপর মামুন হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলেন—সবাই স্যালুট দিতে গেছিল ভাই। আমি দূর থিকা দেখলাম। মুক্তিযোদ্ধারে স্যালুট দিল। লাশ পতাকা দিয়া ঢাকল। আমার মুখে একটা প্রশ্ন আসছিল কাউকে বলতে পারলাম না। চলে আসলাম। পানি দিয়া প্রশ্ন গিলা ফেললাম। মামুন হোসেন উঠে পড়েন। দোকান থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে থেমে যান। ফিরে এসে ওই মুখটির কাছে জানতে চান—কোন প্রশ্ন গিলে ফেললেন আপনি? মুখটি সন্দেহ নিয়ে তাকায় মামুন হোসেনের দিকে। তারপর বলেন—ও কবে যুদ্ধে গেল? ও তো গ্রামে বইয়া বিয়া করল আর মুদির দোকান চালাইল পুরা যুদ্ধের বছর। পেছন থেকে একজন বললেন—ওর তো সার্টিফিকেট আছে। রেগে যায় মুখ—রিলিফের মতো সার্টিফিকেট বিক্রি হয় নাই, তোমরা জানো না? মামুন হোসেন দোকান থেকে নেমে আসেন। ফেরার পথে রিকশা ভ্যান নিলেন না। হাঁটতে থাকেন। যতদূর হেঁটে যাওয়া যায়। পৌষের বিকেলের বাতাস শরীরে ভালোই আদর দিচ্ছে। মামুন হোসেন দেখতে পান পতাকায় মোড়া মরদেহ গোরস্তানের দিকে যাচ্ছে। তিনি সামনের পথ দেখতে পাচ্ছেন না। শুধু শুনতে পাচ্ছেন চারদিকে বিহগল বাজছে। সজ্জিত পুলিশের দল তাঁকে স্যালুট দেওয়ার জন্য তৈরি। হঠাৎ শোরগোল উঠল। ফিসফিসানি—মামুন হোসেনের সার্টিফিকেট নাই। গোরস্তানের দিকে উন্মুক্ত খাটিয়ায় যেতে যেতে মামুন হোসেন দেখতে পাচ্ছেন—সজ্জিত পুলিশের দল বিহগল নিয়ে চুপিচুপি পালিয়ে যাচ্ছে। ওদের পালিয়ে যাওয়া দেখে  মামুন হোসেনের সেকি অট্টহাসি। গোরস্তান গেইট থেকে কবরে পৌঁছাতে  সজনে পাতায় ঢেকে যায় মামুন হোসেনের শব।