দোলনচাঁপা

  • মুম রহমান
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অদ্ভুত সুন্দর ফুলের নাম দোলনচাঁপা। চারটা পাঁপড়ি এমনভাবে ছড়িয়ে থাকে মনে হয় যেন সাদা প্রজাপতি ফুটে আছে। একটা ডালে গুচ্ছে গুচ্ছে ফুটে থাকে দোলনচাঁপা। প্রজাপতির মতো দেখতে বলেই ইংরেজরা একে বলে হোয়াইট জিনজার লিলি। এর গাছটা আদার গাছের মতো বলেই জিনজার শব্দটা যোগ হয়ে গেছে। দোলনচাঁপার পাতাগুলোও কী নিখুত সবুজ। আকারে বড়, লম্বা, বর্শার মতো পাতা। তবে খুব নরম পাতা। ব্রাজিলে যখন ক্রীতদাস প্রথা ছিল তখন তাঁরা এই পাতা দিয়ে তোষক বানিয়ে ঘুমাত। এখন কিন্তু দোলনচাঁপার কদর বেশি নেই। কারণ ব্রাজিলে আগাছার মতো দোলনচাঁপায় ভরে গেছে। একে ওরা রাক্ষুসী গাছ মনে করে। আমি যদি ব্রাজিলে যেতে পারতাম, যদি থাকতে পারতাম এই অদ্ভুত রাক্ষুসী গাছের সঙ্গে। মিতাকে বলেছিলাম, যাবে আমার সাথে ব্রাজিল? আমি তোমার ক্রীতদাস হয়ে থাকব। দোলনচাঁপার পাতার তোষকে ঘুমিয়ে থাকব আমরা। মিতা বলেছিল, কবিদের যত আজগুবি খেয়াল। আমাকে কবি বলা কি ঠিক? মনে হয় না। ফেসবুকে হুটহাট দু’চারলাইন স্ট্যাটাস দিলেই কবি হওয়া যায় না। কবি হলেন সাফো, বোদলেয়ার, র্যাবো, রিলকে, বুকোস্কি, সিলভিয়া। তারা সব গুচ্ছ গুচ্ছ দোলনচাঁপার মতো ফুঁটে আছে কবিতার মহাকাশে।

কিন্তু একটা সত্যি কথা কি, মিতা যখন আমাকে কবি বলে আমার ভালোই লাগে। যখন পাগল বলে তখনও ভালো লাগে। যখন বলে, মদটা খেয়ো না, গাঁজা খেয়ো না, তখনও ভালো লাগে। না, শুক্রবার, শনিবার মিতা আমাকে কিছুই বলে না। ওইদিন আমাদের সম্পর্কটা ঘুমিয়ে থাকে, অথবা মরে থাকে। ছুটির ওই দুই দিন স্বামী বাসায় থাকে। স্বামী বাসায় থাকলে প্রেমিকের দিকে নজর দেওয়া নিরাপদ নয়। দোলনচাঁপা যে কারো জন্যেই ফোঁটে, গন্ধ ছড়ায়। কিন্তু মেয়েরা কেবল স্বামীদের জন্যে ফোঁটে, ঝরে, হারায়, ফুরায়।

বিজ্ঞাপন

তবে প্রত্যেক রোববার মিতা জেগে ওঠে, অথবা পুনরুত্থান হয় তার। রোববার? নাকি রবিবার? বাংলা একাডেমি কী বলে? যা খুশি বলুক, একটা হলেই হলো। বানান নিয়ে যারা খুঁতখুঁতে তারা হয়তো রান্না নিয়েও খুঁতখুঁতে। মিতার স্বামীটা খুব খুঁতখুঁতে। বাংলায় সাহিত্যের অধ্যাপক বলে কথা। সদাই পরিশীলিত, পরিমিত। মোটা চশমা গাম্ভীর্য। খাবার টেবিলে বসেও ভুল ধরে। লেবু নাই? একটু শসা কাটোনি? টমেটোর চাটনি করলেও তো পারো? কতবার বলেছি, শুধু ডাল ভালো লাগে না। ডালে টমেটো দাও, জলপাই দাও, ধনেপাতা দাও, কিছু না থাকলে আলু কিংবা পেঁপে কিংবা করল্লা দাও। এই যে রাজিব সাহেব, পেঁপে বানানে কি চন্দ্রবিন্দু হবে? এই যে রাজিব সাহেব, এই যে হ্যালো, আপনার বউ মিতার কি আজ মন ভালো? শুক্র, শনিবারে কি তার মন ভালো থাকে?

আমার মন ভালো থাকে রবিবারে। রবিবারই বলি? কী বলেন পাঠক? শনির পর রবি। শুনতে ভালো লাগে। রবিবার আমার প্রিয়বার। সেদিন কলেজের প্রথম দিন। সেদিন মিতা আসে। শাড়ি, টিপ, দুল, মালা, চুড়ি, নাকফুল... আমি দেখতেই থাকি, দেখতেই থাকি। মিতার মুখের ব্রণগুলোও আমার ভালো লাগে। মনে হয়, ওই ব্রণগুলো খুঁটে খুঁটে খাই। আমরা মাঝে মাঝে একসাথে খেতে যাই। হরেক রকমের হোটেলে, হরেক রকমের খাওয়া-দাওয়া। মিতা খেতে পছন্দ করে। কাচ্চি, বোরহানি, হালিম, গরুর মাংস আর প্রচুর কাঁচা মরিচ। একবার মিতা ৭টা কাঁচা মরিচ খেয়েছিল। দেখতে দেখতে আমারই জিভে ঝাল লাগছিল।

বিজ্ঞাপন

আমি একবার ঝাল চুমু খেয়েছিলাম। বহু রকমের চুমু আমি খেয়েছি। চুমু খাওয়ার নিরীক্ষাগুলো সব করেছি বুলার সাথে। বুলা কী বিশ্রী একটা পুরনো নাম। কিন্তু বুলা ছিল দারুণ যাকে বলে অগ্রগামী ধাঁচের। সিগারেট টানত, কেরু টানত, একাধিক প্রেম করত। আমাকে একবার বলেছিল, গ্রুপ করবা নাকি, ১:২। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বুলার কোনো ভরসা নেই। যদি নিয়ে আসে আরেকটা মেয়ে কি ছেলে! সেই ভয়ে আমি অনেক দিন ওকে এড়িয়ে চলেছি। কিন্তু চুমু খেয়েছি আমরা, হাজারে হাজার। ঝাল চুমুর কথা তো বললামই, মিষ্টি চুমু, ঠান্ডা চুমু, গরম চুমু, টক চুমু, তিতা চুমু...। আইসক্রিম মুখে নিয়ে চুমু, বরফ মুখে নিয়ে চুমু, কেরু মুখে নিয়ে চুমু, সিগারেট মুখে নিয়ে চুমু, স্ট্রবেরি চুমু, তরমুজ চুমু, কতবেল চুমু... আহা, চুমুর কথা মনে হলেই বুলাকে মনে পড়ে।

মিতাকে কিন্তু আমি চুমু খাইনি। একবার বলেছিলাম, চুমু খাব। ঘাড় বাঁকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, ছিঃ! আমি সাথে সাথে বললাম, ‘ওকে ছুঁয়ো না ছুঁয়ো ছিঃ, ও যে যমের অরুচি!’

এইসব কী ধরনের কথা! আমার ভাল্লাগে না। মিতা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ছিল। না, এমনকি মিতার হাতও ধরিনি আমি। এইসব তার পছন্দ না। ছোঁয়াছুঁয়ির প্রেমে তার ঘেন্না আসে। মিতা হলো, শেষের কবিতা টাইপ, প্লেটোনিক টাইপ। রান্না করে টিফিন বাটিতে ভাপা ইলিশ নিয়ে আসবে, গুণগুণ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবে, সেজেগুজে বলবে, আমার ছবি তুলে দাও। কিন্তু খবরদার, কাছে আসলেই যত সমস্যা! স্পর্শে নাকি ভালোবাসার তৃষ্ণা কমে যায়। মিতা বাকি জীবন তৃষ্ণার্ত থাকতে চায়। ওর কথা, চিন্তাভাবনাগুলো একটু সেকেলেই।
- কবি, তোমার ভালোবাসার কাঙাল আমি। এই ভালোবাসার তৃষ্ণাটা আমার থাকুক। অতৃপ্ত হয়ে আমি মরতে চাই। তোমাকে যে পাইনি, সেই না-পাওয়া বড় হয়ে বাজুক।
- ভালোবাসা কী মিতা?
- মৃত্যুর সময় যার মুখটি মনে পড়ে, সে-ই ভালোবাসা।
- আমার মুখ তোমার মনে পড়বে?
- মৃত্যু আসুক, কেবল তখনই বোঝা যাবে।
- মরণকালে ভালোবাসা বোঝা গেলেই বা কী লাভ?
- বাংলা কি ইংরেজি কোনো লাভই তো আমি খুঁজি না।
- ধুর, যত সব আজগুবি কথা। তুমি আদতে ডিপ্রেশন, ম্যালানকোলিয়ায় ভোগো। আর ভিতু, একটা আস্ত ভিতুর বস্তা। আর তুমি, তুমি, তুমি একটা কনফিউশন, আর একটা স্ববিরোধ!
- প্লিজ!
রাগ ওঠে গিয়েছিল আমার। ইচ্ছা করছিল, মিতাকে বেঁধে ফেলি। দু’হাত, দু’পা, মুখ বেঁধে নিয়ে আসি আমার ঘরে। তালা বন্ধ করে রাখি। কোনোদিন তালা খুলব। ও যখন মরতে বসবে, তখন গিয়ে বলব, বলো, আমার নাম বলো, মৃত্যুর সময় আমার নাম বলো, আমার মুখটি দেখো। না, এইসব কিছুই বলি নাই আমি, এইসব কিছুই করব না আমি। মিতা প্লিজ বললেই আমি ভেঙে পড়ি। ওর বড় বড় কাজল দেওয়া কান্না চোখ দেখলে আমি মরে যাই। আমি শুক্রবারে মরে যাই, শনিবারে মরে যাই। মিতা এলেই কেবল আমি বেঁচে ওঠি।

বাঁচতে আমার ভালো লাগে না। একটা ভাঙাচোরা জোড়াতালির জীবন নিয়ে বেঁচে কী লাভ। আমি প্রচুর মদ খেতে চাই, স্লিপিংপিল খেতে চাই। লিভার, কিডনি ড্যামেজ করে দিতে চাই। তারপর একদিন রেনাল ফেইলিওর কিংবা লিভার ড্যামেজে ঠুস হয়ে যেতে চাই। আমি ঠুস হয়ে গেলে কারোই কিছু যায় আসে না। এ জগতে আমার কেউ নেই। শুধু এক পেগ, দুই পেগ মদের মতো মিতা আসে মাঝে মাঝে। একই কলেজে চাকরি করি আমরা। প্রতি কর্মদিবসেই দেখা হয়। কিন্তু কথা হয় না সব সময়। একসাথে বসা, খাওয়া সেও খুব বেশি হয় না। মিতা অতো হুটহাট ঘোরাঘুরি পছন্দ করে না। কলেজ ছুটি হওয়ার আগ থেকে তার মাথায় অধরার চিন্তা। অধরা কী খাবে, অধরা অপেক্ষা করছে, অধরার ঠান্ডা লেগেছে। তবু রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার, একদিন কি দুইদিন আমরা একত্রে বসি। আধাঘণ্টা কিংবা একঘণ্টা। একবার দু’ঘণ্টা বসেছিলাম। সেদিন অধরা তার নানীর বাসায় ছিল।

সেদিনই আমি দোলনচাঁপা কিনে দিয়েছিলাম। কী আশ্চর্য, মিতা দোলন চাঁপা চেনে না। আগে নাকি এমন ফুল দেখেনি।  
- তুমি পৃথিবীর প্রথম নারী যে দোলনচাঁপা চেনে না।
- না। চিনি। মানে, ওভাবে... আহা, কী মিষ্টি ঘ্রাণ!
সবুজ ডাঁটাগুলো বুকের মধ্যে চেপে ধরে সাদা ফুলের গুচ্ছগুলোতে নাক ডুবিয়ে দেয় মিতা। মুখ ঘষতে থাকে। আমার তখন দোলনচাঁপা হতে ইচ্ছা করে। আমার খুব আফসোস হয়। কেন কোনো চাষি আমাকে চাষ করল না, কেটে এনে বাজারে বিক্রি করল না। হয়তো তখন আমি মিতার নাক-মুখের কাছে চলে যেতাম! এক জীবনে আমার আর দোলনচাঁপা হওয়া হয়ে ওঠে না। বরং আমি দোলন চাঁপা নিয়ে দীর্ঘ লেকচার দিই।
- শোনো, শেকসপিয়র নামে বিশ্বসেরা এক কবি নাকি বলেছিলেন, গোলাপকে যে নামেই ডাকো সে গন্ধ ছড়াবেই। তা তো ছড়াবেই। কিন্তু যে কোনো নামে ডাকতে কি ভালো লাগবে। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই, আমার প্রিয় ফুল দোলনচাঁপার কথাই ধরা যাক। ওর বৈজ্ঞানিক নাম, হাউডেচিয়াম কোরোনারিয়াম। আমার তো শুনলেই মনে হয়ে ভয়াবহ কোনো একটা রোগের নাম পড়ছি। ল্যাটিন এই নামটা শ্রেণী-প্রজাতি ইত্যাদি উদ্ভিদবিদ্যার অনেক কাজে লাগে হয়তো। কিন্তু এমন নাম শুনলে কি কারো মন ভেজে? অথচ দোলনচাঁপা নামটা যদি বলি, তাহলে সাথে সাথে একটা ঘ্রাণ কি ভেসে আসে না! দোলনচাঁপা বললেই নজরুলের কবিতা মনে পড়ে যায়। দোলনচাঁপা বললেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা মনে পড়ে যায়। আর দোলনচাঁপা নামটার মধ্যেই কোথায় একটা দোলা লুকিয়ে আছে কে জানে! হয়তো সে দোলা আনন্দের কিংবা বেদনার।
- শোনেন আমি মরে গেলে, আমার কবরে আপনি দোলনচাঁপা গাছ লাগিয়ে দেবেন?
কথাটা বলে মিতা কেমন চুপসে যায়। আমিও হতবাক। একবার বলতে মন চায়, জীবিত তোমাকেই ছুঁতে পারলাম না। জীবিত আমাকেই ‘তুমি’ বলে ডাকলে না, মৃত তোমার কবরে...

না। এসব কিছুই বলিনি আমি। কত কথাই মিতাকে বলা হয় না আমার। আমি মিতার হাতের ওপর হাতটা রাখি। যেন ক্রিস্টালের হাত। খুব আলতো করে রাখি। যেন ভেঙে না-যায়। এই প্রথম মিতা তার হাত সরিয়ে নেয় না। এই প্রথম মিতা আমার দিকে তাকায়। এই প্রথম আমার মনে হয়, হতেই পারতাম, এই একগুচ্ছ দোলনচাঁপার একটা ফুল, একটা সাদা প্রজাপতি, কারো মুঠোয় আটকে থাকা সুগন্ধি। হতেই পারতাম।
কে জানে, হয়তো আমি সত্যিই একটা দোলনচাঁপা।