রান্নার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি বোধহয় মেয়েদের সম্পর্ক। হ্যাঁ, এখনো আমরা বেরোতে পারলাম না এই ধারণার বেড়াজাল থেকে। একইসময়ে একদিকে জানছি ব্যাডমিন্টনে ক্যারোলিনা মারিনের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জেতার কথা অন্যদিকে জানছি রান্না নিয়ে মানসিক নির্যাতনে একটি মেয়ের আত্মহত্যার কথা। মুম্বই হাইকোর্টের একটি মামলায় জানা যায় একটি মেয়ে রান্না নিয়ে পারিবারিক অশান্তির কারণে অপমানে আত্মঘাতী হয়েছেন। আসলে আমরা উন্নয়নশীল শক্তিশালী মেয়েদের “মেয়ে” ভাবি না, ভাবি মেয়েজাতির ব্যতিক্রম। ফলে সেইসব মেয়েরা আমাদের কাছে সুপারহিরোইন। সাধারণ ঘরে সাধারণ মেয়েরাই যে এই সুপারহিরোইন তা আমাদের ভাবনায় কুলোয় না।
গণতান্ত্রিক এই দেশের আদমশুমারিতে শুধু তো পুরুষ ও বাচ্চার গণনা হয় না! স্বাভাবিকভাবে নারীও থাকে সেই গণনায়। ফলে একটা দেশের ছেলে, মেয়ে সকলের শিক্ষা ও জীবিকা থাকলে গোটা আর্থসামাজিক কাঠামোটাই বদলে যায় সেটাও ভাবতে পারি না! মেয়ে সন্তান জন্মালো অতএব তাকে সাবধানে রাখো, সে কোথায় গেল, অনেক পড়ে চাকরি করেই বা তার কী হবে, তাকেও তো রান্না করতেই হবে ইত্যাদি ভাবনা শিক্ষিত ঘরের আনাচে-কানাচেই জমে আছে। শুধু যে ভাবনার গাঁথুনিতে ভাবনা ঢুকে বসেছে তা নয়! বাবা-মা, পরিবেশ, এমনকি মেয়েরা নিজেরাও খারাপ শুনতে শুনতে নিজেকে বড় করার যাবতীয় সাহসটুকু বিসর্জন দেয়। শুধু কী এক অলীক নিরাপত্তাবোধের জন্য স্থানান্তরিত হয়ে বাধ্যতামূলক গৃহকর্মে নিপুণা হওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।
ভাবতে ভালো লাগছিল ইন্দ্রা নুয়ির কথা। এরকম মেধাবী এক মহিলা যিনি পেপসির সিইও পদে দীর্ঘদিন থেকে কর্পোরেট জগতে নারী-পুরুষের প্রাধান্যের হিসেবকেই বদলে দিয়েছেন। সেই ভাবনার ছন্দে এসে ঘোর কাটল যখন জানলাম তাঁর মাও তাকে বলেছেন চাকরির কথা গ্যারেজেই ফেলে এসে মনে রাখতে তিনি এক স্ত্রী, মা, পুত্রবধূ। তবুও নুয়ি এগিয়ে এসেছেন। মেয়েরা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, বিখ্যাত হয়েছে, স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে এরকম উদাহরণ অবশ্যই আছে। কিন্তু তাতে কী? আমদের স্মৃতিতে পুরনো উদাহরণ দূরে থাক, সমসাময়িক উদাহরণগুলোই ক্রমাগত এড়িয়ে চলেছি। সাধারণ ঘরের ডাল-ভাত খাওয়া মেয়েগুলোকে যতদিন সুপারহিরোইন হওয়ার কথা ভাবাতে পারব না ততদিন আমাদের ভয়েই থাকতে হবে।
বধূহত্যার ভয়, ধর্ষণের ভয়, বদনামের ভয়, বিয়ে ভাঙার ভয় এইসমস্ত ভয় ছাড়িয়ে যে পি ভি সিন্ধু, ইন্দ্রা নুয়ি, ইন্দিরা ব্যানার্জির মতো সাহসীরা আছেন তা যতদিন না মনে ঢুকবে ততদিন মেয়েদের রান্নার হলুদে, নুনে সেদ্ধই হতে হবে। যত বেশি নারীজীবনের আতঙ্কের কথা ভাবা হবে ততই দেখতে পাওয়া যাবে না নারীজীবনের সাফল্য। যে পরিমাণে ধর্ষণের আতঙ্ক, রান্নাবান্নার সতর্কতা মেয়েদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তার অর্ধেকও যদি শিক্ষা ও সাফল্যের কথা তাদের বোঝানো যেত, পরিস্থিতি আলাদা হতো। ১৯৪৯ সালে “THE SECOND SEX” নামক বিখ্যাত বইটির লেখিকা সিমোন দ্য বোভেয়ার ছোটবেলা থেকে তাঁর মাকে (ফ্রাঁসোয়া ব্রাসেয়ো) দেখে মেয়েদের জীবনকে ভয় পেয়েছিলেন। মায়ের প্রতিদিনের ক্লান্তিকর অর্থহীন ঘরের কাজ দেখে তিনি ছোটবয়সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কখনো মা কিম্বা গৃহিণী হবেন না। এখন প্রশ্ন জাগে এটাই, ঘরের কাজ, রান্নাবান্নার সঙ্গে উন্নত শিক্ষিত জীবনের বিরোধ কোথায়? বিরোধ কেবল লিঙ্গভিত্তিক বাধ্যতামূলক চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে যখন এটা চাপিয়ে দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে আরো মনে আসে মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের ১৭৯২ সালে প্রকাশিত “VINDICATION OF THE RIGHTS OF WOMAN” নামক যুগান্তকারী বইয়ের কথা। দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মানো একটি মেয়ে প্রচলিত ভাবনার উল্টদিকে গিয়ে মেয়েদের জন্য এই বই লিখেছিলেন। এই লেখার জন্য তাঁকে হায়েনা বলেও সম্বোধন করা হয়েছিল তবু তিনি ক্রমাগত লড়ে গেছেন।
সেই ১৭৯২ সাল থেকেই যদি ধরি, আজ ২০১৮ সাল অবধি আমাদের ভাবনার ভিত্তি এত দুর্বল হয়ে থাকা কি আমাদের নিজেদের বোধের অপমান নয়? ১৯৮৯ সালে ফতিমা বিবি সুপ্রিম কোর্টের প্রথম মহিলা বিচারপতি হন। ১৯৫০ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে ৮ জন মাত্র মহিলা বিচারপতি হয়ে এসেছেন। সংখ্যাটা খুব সৌভাগ্যজনক তা বলছি না কিন্তু মেয়েদের বাবা-মা, বন্ধু সকলেই যদি ভাবেন “কটা মেয়ে আর ওরকম হয়”, সেখানেই মেয়েজন্ম কেবলই রান্নাবান্নাকে স্বীকৃতি দিয়ে দেয়।
ভাগ্যিস এরকম ভাবনাকে প্রশ্রয় দেননি ইন্দিরা ব্যানার্জির মতো মেয়েরা, তাই আজ ২০১৮-তেও তিনি সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি। জীবনের আর সমস্ত কাজের মতো রান্নাও একটা কাজ, এর মধ্যে লিঙ্গ ভাবনাকে জড়িয়ে আমরাই নিজেদের প্রহসন বানাই এবং ভয়ঙ্কর গোলমালের পথ চওড়া করি। বড় বড় শেফ তারা তো পুরুষ, সেক্ষত্রে “মেয়েসম্পর্কিত রান্নার” বাগধারা কিভাবে বজায় রাখি ভাবতে আশ্চর্য লাগে! কাজের ক্ষেত্রে রান্নাও যেমন কোনো লিঙ্গভিত্তিক কাজ নয়, জীবনের ক্ষেত্রে মেয়েরাও আসলে মানুষ ছাড়া কিছু নয়!
এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হান কাং।
রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) সম্মানজনক এ পুরস্কারের জন্য তার নাম ঘোষণা করেছে। তার দারুণ কাব্যময় গদ্যের জন্য এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, যা ঐতিহাসিক ক্ষতগুলোকে সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরে এবং মানব জীবনের ভঙ্গুরতাকে প্রকাশ করে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক সাহিত্যিক হান কাং।
হান কাংয়ের প্রথম ইংরেজি উপন্যাস 'দ্য ভেজিটেরিয়ান' সম্পর্কে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সমালোচক ড্যানিয়েল হ্যান মন্তব্য করেছেন, বইটির তিন খণ্ড জুড়ে সমাজের সবচেয়ে অপরিবর্তনশীল কয়েকটি কাঠামোর অসহনীয় চাপ পাঠকমনকে বিচলিত করে তোলে। এই উপাদানগুলো হল চাহিদা ও আচরণ এবং প্রতিষ্ঠানগত কর্মপদ্ধতি, যা একে একে ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয়।
২০১৬ সালের আন্তর্জাতিক ম্যান বুকার প্রাইজ পেয়েছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার এই লেখক । উপন্যাস দ্য ভেজিটেরিয়ান'র জন্য তাকে এই পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা হয়।
হান কাং ১৯৭০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার শহর গোয়াংজুতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নয় বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে সিউলে চলে আসেন। হ্যান ক্যাং একটি সাহিত্যিক পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। তার বাবা একজন স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক। তিনি লেখার পাশাপাশি শিল্প ও সঙ্গীতেও নিজেকে নিয়োজিত করেছেন, যা তার সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়।
বোধহয় বৈরি সময়ে উর্বর মস্তিষ্কে চিন্তারা বেশি করে ভিড় করে। মৌলিক প্রতিভা সে চিন্তাকে ঘনীভূত করে জমাট বাধায়, উপহার দেয় চিন্তা বা কল্পনা করতে না পারা মানুষদের জন্য অভিনব কিছু। সাহিত্যে কবিতার যে শক্তি তা কম কবির লেখনিতেই মূর্ত হয়েছে কালেভদ্রে। কিন্তু মানুষের মুক্তির আকাঙ্খাকে ধারণ করে যে শব্দের সমষ্টি অজস্র পীড়িতের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় সেই তো সার্থক কবিতা। আর তার নির্মাতাই হয়ে উঠেন সার্থক কবি।
কবিতার এই যে মানদণ্ড তাতে একজন হেলাল হাফিজ অনেক আগেই উত্তীর্ণ। ৭ অক্টোবর বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান এই কবির জন্মদিন। কিন্তু কি আশ্চর্য! দুঃখকে নিত্যসহচর করে বেঁচে থাকা অধিকাংশ কবিদের অমোঘ নিয়তি হেলাল হাফিজকেও ছাড়েনি। ১৯৪৮ সালে নেত্রকোণায় জন্ম নেওয়া কবিতার এই বরপুত্র নব্যঔপনিবেশিক শাসকদের রোষানল দেখেছেন। দেখেছেন মুক্তির আকাঙ্খায় উদ্ভাসিত বাঙালি জাতির ব্যগ্রতা।
যৌবনের উদ্দাম দিনে দ্রোহ ও প্রেম-দুই-ই পেয়ে বসেছিল হেলাল হাফিজকে। তাকে অবলম্বন করতেও ছাড়েননি তিনি! সহজ কথায় তিনি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন সবার কথাকে, তাইতো তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন তাঁর সমকালীনতাকে। অন্তত ৫ দশক ধরে বাংলা সাহিত্যে কবিতার এই বরপুত্র সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে বার বার প্রাসঙ্গিক হয়ে ফিরে এসেছেন। এই সময়েও তাঁর কবিতার ঐশ্বর্য ম্লান হয়নি এতটুকুও! এখানেই তাঁর সার্থকতা।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলা সাহিত্যে অপেক্ষাকৃত এক বন্ধ্যা সময়েও মুগ্ধ পাঠকের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে হেলাল হাফিজের শব্দগাঁথা, যা তিনি জীবন অভিজ্ঞতা ও সঞ্চিত বিশ্বাসে ভর করে লিখেছিলেন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের তপ্ত আবহের মাঝে। ‘এখন যৌবন যার জুদ্ধে যখন তার শ্রেষ্ঠ সময়’-কবি হেলাল হাফিজের শক্তিশালী শব্দমালা এখনও পথে-প্রান্তরে দেয়ালে উৎকীর্ণ, হয়তবা এই পঙতির চিরকালীন আবেদনময়তার জন্যই।
‘যে জলে আগুন জলে’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার ছত্রে ছত্রে দ্রোহ ও প্রেমের যে আখ্যান কবি সৃষ্টি করেছেন তা কয়েক দশক পরে এখনও পাঠককে মুগ্ধ করে। মুগ্ধ করে বললেও অত্যুক্তি হবে-বলা প্রয়োজন আন্দোলিত করে।
২০১৩ সালে সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কবিকে বাংলা একাডেমি পদকে ভূষিত করা হয়। ২০১৯ সালে কবি পাঠকদের উপহার দিয়েছেন ‘বেদনাকে বলেছি কোঁদো না’ কাব্যগ্রন্থ। সঙ্গীহীন ব্যক্তিগত জীবনে কল্পনালোকে ডুবে থাকতেই পছন্দ করেন কবি।
তবে ঘুমন্ত সমাজকে জাগিয়ে তুলতে যে প্রবল শক্তি নিয়ে একজন হেলাল হাফিজ আবির্ভূত হয়েছিলেন তার সামান্যই হয়ত নিতে পেরেছি আমরা। কবিতার শক্তি যে সত্যসুন্দরের আহ্বান নিয়তই জানিয়ে যায় এই সমাজ হয়ত তাকে সর্বাঙ্গীন স্বাগত জানাতে প্রস্তুত নয়।
তা সত্ত্বেও সত্যসুন্দরের দীপশিখা জ্বেলে যান কবি হেলাল হাফিজ। শুভ জন্মদিন কবি।
বীর সাঈদ
মোঃ আলাউদ্দীন ভুইয়া
সাঈদ ছিল গুণী, এই পুলিশ যেন খুনি,
টের পাইনি সাঈদ বাবা।
সরলতার সুজোগে, দানবের মত হুজুগে,
তাঁজা বুকে মারলি থাবা।
হে ঘাতক চিনলে না-সাইদ কে,
অন্যরা কারা।
আকাশ ছুঁয়ে গুলি মেরে দিতে
করে কারা!
প্রশ্ন; বল, বল, বল ওরে ঘাতকের দল,
শত শত সংসার করে দিলে-অচল।
বুঝে, না বুঝে চালিয়েছ-বন্ধুকের নল।
আমাদের দেশ, করে দিলে শেষ,
অন্ধকারে তল।
এখন বুঝি, হত্যা ছিল তোমাদের পুঁজি,
তোমরা তো হার মানিয়েছ ব্রিটিশের যোগ।
তোমরা তো হার মানিয়েছ ক্যান্সার রোগ।
তোমরা তো হার মানিয়েছ পাকের ডান্ডা।
সব শেষে পেলে শুধু ঘোড়ার আন্ডা।
হে; প্রভু তোমার কাছে ফরিয়াদ,
না, ছিল ছাত্র জনতার অপরাধ,
শুধু হকের উপর ছিল প্রতিবাদ,
ওরে তার পাপের ছিল এত ভার।
হেলমেট খুলে গেল ইশারায় বিধাতার,
মুহুর্তে ভেসে গেল দানবের ছায়া,
ছেলের মত দেখেও, ঘাতকের হল না যে মায়া,
ঘাতক তোমার নামের মাঝে করি শুধু-বমি,
দোয়া, সাঈদ না ফেরার দেশে সুখে থাক তুমি।
কিছু না বোঝার আগে বুকে নিলে-তীর।
আজ তুমি হয়ে উঠেছ বাংলার বীর।
আজিম রাস্তায় হাঁটছে। কিন্তু চমকে যাচ্ছে বারবার। এ কোথায় এলো সে! আজিম ছাড়া সবার মাথায় হেলমেট। অথচ রাস্তার কোথাও কোনো মোটর সাইকেল নেই। হেলমেট পড়ে যে মারামারি করছে তাও না। প্রতিটা মানুষ স্বাভাবিক চলাফেরা করছে। অথচ মাথায় হেলমেট! কেবল আজিমের মাথায় কিছু নেই। হেলমেটের কারণে মুখের কিছুই দেখা যায় না। হেলমেটের সামনে অংশ কালো গ্লাস দিয়ে ঢাকা। হেলমেটের মানুষ হাঁটছে। ওই অবস্থাতেই কথা বলছে একে অপরের সাথে। কী অদ্ভুত। একটা বাস গেলো। বাসের যাত্রীদের সবার মাথায় হেলমেট। একেবারে মুখ ঢাকা।
আজিমের ঘোর কাটছে না। এ কোথায় এলো সে!
‘আজিম সাহেব?’
কে যেন ডাক দিলো।
‘কে, কে?’
চমকে উঠলো আজিম।
‘এই যে আপনার পেছনে।’
আজিম হকচকিয়ে পেছনে তাকালো। একটা লাল হেলমেট পরা মানুষ।
‘কে আপনি? আপনাকে চিনছি না তো। হেলমেট পরে আছেন কেন?’
হেলমেটের মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লোকটা হাসছে।
‘আপনিও পরবেন। সমস্যা নাই।’
‘দেখুন, হেলমেট না খুললে আমি কথা শুনব না। আপনাকে না দেখে তো আমি কথা বলছি না।’ আজিম রেগেই গেলো এবার।
লোকটা হেলমেট খুললো। আজিমের ঘোর কাটছে না। এ কি দেখছে সে!
লোকটার মাথাটা সংবাদপত্র দিয়ে মোড়ানো। চোখ নেই, নাক নেই। শুধু ঠোঁট, দাঁত আর জিহবা আছে। দাঁত দেখিয়ে হাসছে লোকটা।
লোকটার হাসি দেখে আশেপাশে আরো কয়েকজন হেলমেট মানব এলো। ওরাও দাঁড়ালো। আজিম খেয়াল করলো, সবাই গোল ওকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। হেলমেট খুলে ওরাও হাসছে জোরে জোরে।
ওদেরও সবার মাথা সংবাদপত্র দিয়ে মোড়ানো। এদেরও চোখ নেই, নাক নেই। দাঁত বের করে হাসছে আজিমের দিকে তাকিয়ে। যেন আজিম একটা কৌতুক।
একটা ঝাঁকুনি দিলো শরীরটা। মনে হলো হোঁচট খেলো। এতেই ঘুমটা ভাঙলো আজিমের। বিরক্ত মুখে বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটায় সময় দেখলো। রাত ৪টা ২৯ মিনিট। কোনো মানে হয়? প্রায়ই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে এই গভীর রাতে। স্বপ্নটা আবারো হানা দিয়েছে আজিমের চোখে। সেই একই স্বপ্ন। গরমে ঘেমে গেঞ্জি আর বিছানার চাদর এক হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। মগবাজারে আজিম যে বিল্ডিংটায় থাকে সেটা আটতলা। আজিম থাকে টপ ফ্লোরে। মাথার ওপরে ছাদ। আর ছাদ দিনভর সূর্যে তেতে থাকে। ফ্যানে আপাতত ঠাণ্ডা মেলে কিন্তু শরীরতো বিদ্রোহ করে।
তিন বেডরুমের ফ্ল্যাট বাসাটায় আজিম একটা রুমে থাকে। অন্য দুই রুমে থাকে সাদেক ও আফজাল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে হলে দুইজনই ছিল আজিমের রুমমেট। সাদেক এখন ব্যাংকার আর আফজাল কাজ করে ওষুধ কোম্পানিতে। পাস করে বের হওয়ার পর বাসাও একটা নেয়া একসাথে। সেই সাথে ডাইনিং রুমের জন্য একটা ডাইনিং টেবিল, ফ্রিজ আর কম দামের একটা সোফা সেট। ব্যাচেলর হলেও বাসাটাকে একটা পরিবারের স্পর্শে রাখা।
আজিম সাংবাদিক। সবচেয়ে দেরি করে বাসায় ফেরা লোক। রাত ১২টায় অফিস থেকেই বের হয়। বাসায় ফিরে বিছানায় যেতে যেতে রাত ১টার মত বেজে যায়। এরপরও যদি রাত ৪টার দিকে ঘুম ভেঙে যায় তাহলে মন ও মেজাজ কিছুই ভালো থাকার কথা না। এর ওপর বাড়তি যন্ত্রণা হয়ে এসেছে এক স্বপ্ন। সেটা দু:স্বপ্ন না ভালো কিছু সেটাই বুঝতে পারছে না আজিম। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় বিছানার পাশে রাখা স্টিলের গ্লাসটা শেষ করেও কাজ হলো না। ডাইনিং এ যেতেই হবে। এক বিন্দুও ইচ্ছা করছে না আজিমের। বাড়ি গেলে বিছানার পাশে বিশাল পানির বোতলটা রেখে দিয়ে যেতেন আজিমের বাবা, সিদ্দিকুর রহমান। সাথে একটা গ্লাস। রাতে যেনো রুম থেকে বের হওয়া না লাগে। রুমের দরজা লক করে না আজিম। ভোরের দিকে টের পেতো আজিমের গায়ে চাদর। কখন সিদ্দিকুর রহমান এসে চাদর দিয়ে ওকে ঢেকে দিয়ে গেছে টেরেই পায়নি সে।
রুমের দরজা খুলেই দেখে ডাইনিং রুমের বাতি জ্বালানো। ডাইনিং টেবিলে বসে পত্রিকা পড়ছেন সিদ্দিকুর রহমান!
আজিম অবাক হলো।
‘বাবা, আপনি কখন এলেন?’
পাজামা-পাঞ্জাবি পড়া সিদ্দিকুর রহমানের চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চশমাটা হাতে নিয়ে ফ্রেমের কাঁচটা পাঞ্জাবির কাপড়ে পরিস্কার করলেন। এটা সিদ্দিকুর রহমানের অনেক পুরানো অভ্যাস।
‘তোমার এখানে আসতে আসতে রাত ৯টা বেজে গেলো। তুমি অফিসের কাজে এই সময় ব্যস্ত থাকো, সেটা আমি জানি। তাই ফোন করে বিরক্ত করিনি।’
‘কী বলেন? আপনি এসেছেন, আমাকে বলবেন না? এতক্ষণ ধরে এখানে? খেয়েছেন? বাসায় আসার পরও ডাকেননি কেন?’
আজিম ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সিদ্দিকুর রহমান রুটিন মেনে চলা লোক। খেয়েছেন কিনা ঠিক মত, না ঘুমিয়ে এখানে বসে থাকা?
‘আরে তুমি এত ব্যস্ত হয়ো না। এখানে বসো। আমি ঠিক আছি?’ সিদ্দিকুর রহমান হেসে বললেন।
‘আচ্ছা তোমার লেখা মনে হচ্ছে কম আসছে। কারণ কী?’
আজিম হাসলো।
‘বাবা, ইদানিং ডেস্ক সামলাতে হচ্ছে। বাইরে যাওয়ার সময় কম পাচ্ছি। তাই রিপোর্ট লেখার সময় কম মিলছে।’
‘এটা কী করে হয়। তুমি এত ভালো রিপোর্ট করো আর তোমাকে ডেস্কে বসিয়ে দিলো! এডিটর জানে না তোমার রিপোর্ট ভালো হয়?’
‘জানেন বাবা। তারপরও উনার মনে হয়েছে ডেস্কেও যদি সময় দেই তাহলে ভালো হয়। আর ইচ্ছে করলেই বাইরে গিয়ে স্পেশাল রিপোর্ট করতে পারি। তাতে এডিটরের কোনো না নেই।’
‘হুম। আর তুমি বাইরে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছো!’
আজিম যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য সাংবাদিকতা বেছে নেয় তখন সিদ্দিকুর রহমান বেশ খুশি হয়েছিলেন। আজিমের মনে আছে ছোট বেলায় ওদের বাসায় দুটো পত্রিকা দিয়ে যেতো হকার। ইত্তেফাক আর অবজারভার। বইয়ের চেয়ে বেশি প্রিয় ছিল আজিমের ওই দুই পত্রিকা। খেলার খবর, কত ছবি, কত শব্দ, কত কত বাক্য। পাস করে বের হওয়ার পরই একটা পত্রিকায় চাকরি হয়ে যায় আজিমের। সিদ্দিকুর রহমানের খুশি ধরে রাখে কে! ছেলের নামে যেদিন রিপোর্ট ছাপা হয় নিজে সেদিন বন্ধুবান্ধব ও স্বজনদের বাসায় পত্রিকা নিয়ে দিয়ে আসেন। ছোট্ট শহরে ছেলেকে বিখ্যাত বানিয়ে তুলতে সিদ্দিকুর রহমানের উৎসাহের কমতি নেই।
‘আপনি খাওয়া দাওয়া করেছেন?’ আজিম পানি দিল তাঁর বাবাকে।
‘হ্যাঁ, তোমার বন্ধুরা বেশ খাইয়েছে। খেয়েই তো ড্রইংরুমে হেলান দিয়েছিলাম। তাতেই ঘুম।’
‘ঘুম ভাঙার পর আমার রুমে যেতেন। এখানে বসে ছিলেন কষ্ট করে।’
‘তুমি খুব ক্লান্ত থাকো। বিরক্ত করতে ইচ্ছা করল না। তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছিল। তাই চলে এলাম।’
‘ভালো করেছেন। কখন রওনা দিলেন?’
‘রওনা দেয়ার কথা সকালেই। কিন্তু দেরি হয়ে গেলো। প্রচণ্ড রোদ আর গরম মাথায় নিয়ে বের হলাম। বাসে উঠার পর বৃষ্টি। বাস থেকে নামার পর আবার গরম।’
বাইরে তাকালো আজিম। বিজলির চমক দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি নামবে দ্রুত।
‘এক কাজ করো। চা বানাও। তোমার জন্যও বানিও। চা খেতে খেতে গল্প করি।’
রান্নাঘরে যাওয়ার আগে নিজের রুমের আর ড্রইংরুমের জানালার গ্লাস টেনে দিলো আজিম। বৃষ্টিতে ঘর ভিজে যায়। ওদিকে ডাইনিংয়ে জানালার পাশেই বসেছেন সিদ্দিকুর। বাতাসে তাঁর পাতলা চুল উড়ছে। ৭০ এর বেশি বয়স হলেও চুলে কালো রং দেন তিনি। আজিম ভাবে, বাবাকে সাদা চুলে কখনোই ভালো লাগবে না।
‘জানালাটা লাগিয়ে দিব?’
‘না, থাক। তুমি চায়ের ব্যবস্থা করো।’
আজিম রান্নাঘরে যায়। বাবার জন্য চা বানানোটা সহজ। পানি গরম করলেই হয়। কাপে একটা টি প্যাক। আর কিছু না। আজিমও এভাবেই চা খায়। তবে চায়ে তার নেশা নেই।
চায়ে চুমুক দিলেন সিদ্দিকুর রহমান।
‘চায়ের সাথে কিছু খাবেন? মুড়ি আছে।’
‘না, তুমি বসো। দেশের কী অবস্থা?’
পত্রিকা সরিয়ে এক পাশে ভাঁজ করে রাখলেন সিদ্দিকুর।
‘আমি সাংবাদিক বলে আমার কাছে দেশের খবর সব থাকবে?’
আজিম ইচ্ছে করেই ওভাবে বললো।
‘অবশ্যই। তুমি দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছো। কাজ করছ খবর নিয়ে। মানুষ তোমার কাছেই তো খবর জানতে চাইবে। এটাই স্বাভাবিক।’
আজিম ভাবতে থাকে। এর কী উত্তর হতে পারে? আসলেই কি আজিম খবরের সাগরে ভেসে বেড়ায়? মানুষ চাইলেই কলসিতে করে বা বোতলে করে চাহিদা অনুযায়ী সাপ্লাই দেয়? কাগজের দাম বাড়ছে। মানুষ বাসায় পত্রিকা রাখা কমিয়ে দিচ্ছে। এখন অনলাইনের সময়। চাইলেই পকেটে থাকা ফোনেই খবর পড়ে নেওয়া যায়। আগে সারাদিন কাজ করে একটা সংবাদপত্র প্রকাশ হতো। এখন ওই পত্রিকার অনলাইন ভার্সন চলে এসেছে। যা মিনিটে মিনিটে খবর সাপ্লাই দেয়। তাতে তো কাজের ব্যস্ততা বেড়েছে। খুশি হওয়ার কথা। মুহিত সেদিন লিখেছে, ওজন কমানোর পাঁচ উপায়। সেটা সেদিন সবচেয়ে বেশি পঠিত সংবাদের তালিকার শীর্ষে ছিল। এডিটর পর্যন্ত বাহবা দিয়েছে ওকে। আমেরিকার নির্বাচন, ইউরোপের বাজারের খবর পর্যন্ত এখন মিনিটে মিনিটে আপডেট করা যায় দেশে বসে। কিন্তু, যমুনায় ভেসে যাওয়া গ্রামের স্কুলটার আপডেট কী? কবে আবার স্কুলটা চালু হবে সেই খবরটা মেলে না এত এত অনলাইনে। কাগজে আরো মেলে না। এখন কাগজের অনেক দাম।
‘থাক, দেশের অবস্থা বলতে হবে না। তোমার অবস্থা বলো। লেখাটা চালু রেখো। ছেড়ে দিও না। রিপোর্ট না লিখতে পারো এখন, কলাম লিখবে। তুমি কলামও ভালো লিখতে পারো।’
‘কলেজে পড়ার সময় ডিরোজিও কে নিয়ে একটা কলাম লিখেছিলাম। আপনার মনে আছে?’
`হ্যাঁ। ডিরোজিওর জন্মদিন উপলক্ষে লিখেছিলে। আমাদের শহরের সাপ্তাহিক পত্রিকাটায় ছাপা হয়েছিল সেটা। বেশ মনে আছে।’
‘এসএসসি পরীক্ষার পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময় বইটি কিনে দিয়েছিলেন আপনি। এক উপন্যাসে কত চরিত্র, কত ইতিহাস। কত কত নায়ক।’
‘তোমার ওই লেখা ছাপানোর কয়েক দিন পর ওই পত্রিকার সম্পাদকের সাথে আমার দেখা। আমাকে বলে, স্যার লেখাটা আপনার ছেলেই লিখেছে নাকি আপনি সাহায্য করেছেন? দিয়েছিলাম ধমক। ও নিজেই লিখেছে।’
‘তাই নাকি। এ কথা তো বলেননি কোনো দিন?’ আজিম অবাক হয়।
‘ওতটুকু বয়সে তোমাকে ওই কথা বললে তোমার কনফিডেন্স কমে যেতো। আমার মনে আছে, উপন্যাসটা পড়ে তুমি ডিরোজিওর ওপর আরো দুইটা বই পড়ে ফেলেছিলে।’
আজিম চায়ে চুমুক দেয়।
আজিম ভাবছে, সে বাসায় এলো। তার বাবাকে চোখে পড়লো না কেন? এসেই অবশ্য নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দেয়। গোসল করেই ঘুম দেয়। অফিসেই রাতের খাওয়াটা সেরে ফেলে আজিম। ছোটবেলায় রাত সাড়ে আটটায় রাতের খাবার শুরু করতে হতো। সিদ্দিকুর রহমানের কড়া নির্দেশ। রাত আটটায় বিটিভির বাংলা সংবাদ শুরু। সেটা দেখে তারপর খাওয়া। আর ১০টার দিকে ঘুম। আজিম হলেও রাত আটটার দিকে খেয়ে ফেলতো। অভ্যাসটা এখনো আছে।
বাবা তো ওর ঘরেও শুয়ে থাকতে পারতো। আজিম আসলে কিছু মেলাতে পারছে না।
‘আমি বাসায় আসার পর আমাকে ডাকলেন না কেন? এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?’ আজিম এবার প্রশ্নই করে।
‘আরে ওদের সাথে খেয়ে ড্রইংরুমেই সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিলাম। কখন যে ঘুম এসে গেলো টের পাইনি। বাতিটাও নেভানো ছিল। তুমি হয়তো খেয়াল করো নি।’
এটা ঠিক। আজিম নি:শব্দে বাসায় ঢুকে। না পারতে ড্রইং বা ডাইনিংয়ের বাতি জ্বালায় না। এমনিতেই দেরি করে বাসায় আসে। এর ওপরে রাতে শব্দ করাটা আসলেও অন্য দুইজনের ওপর অন্যায়।
‘তুমি কেমন আছো সেটা বললে না কিন্তু।’ সিদ্দিকুর চশমার কাঁচ মুছলেন।
‘এইতো বাবা। চলছে।’
‘না। সামথিং রং। আমাকে বলো।’ সিদ্দিকুর ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন।
‘তেমন কোনো সমস্যা না।’
‘তাহলে যে স্বপ্নটা দেখছো, ঘুম ভাঙছে রাতবিরাতে সেটাকে সমস্যা মনে হচ্ছে না?’
‘বলেন কী? আমার এ কথা আপনি জানলেন কী করে?’ আজিম অবাক হয়। সাদেক বা আফজালের কেউ বলবে। এরা যে কী?
‘আমাকে বলো।’
আজিম পানি খেলো। সিদ্দিকুর এমনিতেই তাকে নিয়ে টেনশন করেন। এসব স্বপ্ন টপ্নের কথা বলে তাঁকে চিন্তায় ফেলার ইচ্ছা ছিল না আজিমের। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাবাকে বললেই একটা সুরাহা মিলবে।
‘বিষয়টা তোমাকে নিয়ে হেলমেট মানবেরা হাসাহাসি করে ওই পর্যন্তই? নাকি আরো কিছু দেখো?’ সিদ্দিকুর জানতে চাইলেন।
‘মাঝে মাঝে একটু বেশিও দেখি। হঠাৎ এক হেলমেট মানব দৌড়ে আসতে থাকে। হাতে বড় একটা লাঠি। এটা দিয়ে সে আমার মাথায় জোরে আঘাত করে। তীব্র যন্ত্রণায় আমি মাটিতে বসে পড়ি। লাঠির আঘাতে আমার মাথাটা দুই ভাগ হয়ে যায়। বেরিয়ে যায় মগজ, রক্তে মুখটা ভরে যায়। আর….’
‘আর কী?’ সিদ্দিকুর মন দিয়ে শুনছেন।
‘মাথাটা ফেটে যাওয়ার সাথে সাথেই মাথাটা থেকেই কতগুলো বর্ণ, শব্দ দৌড়ে বের হয়ে গেলো! ঠিক যেমন কোনো বস্তা বা ব্যাগে আটকা ইঁদুর ছাড়া পেলে যেভাবে দৌড় দেয়, ঠিক সেই রকম।’
‘বর্ণগুলো বা শব্দগুলো কীসের?’
‘জানি না। আমি খেয়াল করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু এরপরই ঘটে আরেকটা ঘটনা। একজন হেলমেট মানব একটা সংবাদপত্র নিয়ে দৌড়ে আমার কাছে আসতে থাকে। আরেকজন হেলমেট মানব একটা হেলমেট নিয়ে আসতে থাকে। আমার মগজবিহীন রক্তাক্ত মাথাটা সংবাদপত্র দিয়ে মুড়ে দিতে থাকে। এমনকি চোখটাও ঢাকা পড়ে যায়। অন্ধকার হয়ে আসে সবকিছু।’
আজিম ঘামতে থাকে। শ্বাস নিতে থাকে জোরে জোরে। টেবিলে মাথা ফেলে দুই হাত দিয়ে মাথাটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করে।
‘মাথাটা অসম্ভব যন্ত্রনা করে বাবা।’
‘হ্যাঁ। বুঝতে পারছো কী রক্ষা করা দরকার? ওই শব্দগুলো বেঁচে থাকুক, বর্ণগুলোও।’
‘এই আজিম। আজিম। উঠ। কীরে কী হলো তোর?’ সাদেক ডাকছে।
আজিম মাথা তুলে তাকালো, চোখে বিস্তর ঘুম।
‘কীরে, ডাইনিং টেবিলে ঘুমাচ্ছিস কেন?’ সাদেক অবাক হলো।
আজিম মাথাটা তুলে এদিক ওদিক তাকালো। সকালের রোদ এসে পড়েছে টেবিলে। গরমে ঘেমে গেছে আজিমের শরীর।
‘উঠে রুমে যা। রুমে গিয়ে ঘুমা। কখন এসেছিস এখানে?’
আজিম এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করলো।
‘কীরে কিছু খুঁজছিস?’ সাদেকের প্রশ্ন। আফজালও বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো।
বাসায় আর কেউ নেই। আজিম বুঝতে পেরে আর কিছু বললো না।
‘আমি ঠিক আছি। সমস্যা নেই। মুখ ধুয়ে আসছি। নাস্তা করব তোদের সাথে।’
‘আজিম, তুই বাড়ি যাবি কবে? ভাবছি ছুটি পেলে তোর সাথে যাব। কাকার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তোর সাথে না হয় থাকলাম দিনটা।’ আফজাল বলে।
‘তাই তো। কবে যেন আজিম?’ সাদেক বলে।
‘আগামী সপ্তাহে। ১৭ তারিখ। বাবার মৃত্যুর এক বছর হবে।’ আজিম খেয়াল করলো টেবিলে দুই কাপ চা। একটা শেষ হয়েছে। আরেকটাতে কেউ চুমুক দেয়নি।
পরিশিষ্ট
দুপুরে অফিসে যাচ্ছে আজিম। মেট্রোরেলের গেটের নিচে এক ভবঘুরে লোক বসা। এই গরমে তার গায়ে চাদর। দুই পাশে পুরানো ছেঁড়া কম্বল। এ ধরণের ভবঘুরে ঢাকা শহরে অনেক। তারপরও আজিম দাঁড়িয়ে গেলো। লোকটার মাথায় হেলমেট। এমন হতদরিদ্র, ভবঘুরে লোকটার মাথায় লাল একটা হেলমেট। যার সামনের দিকটা কালো গ্লাসে ঢাকা!
‘ভাই, ওরে কী দেখেন। পাগল। ওভারব্রিজ নাইলে মেট্রোরেলের গেটের কাছে বইসা থাকে হেলমেট পইরা, চাদর গা দিয়া। এখন দেখি এখানে বইসা পড়সে। কবে উঠব কে জানে।’
সিটি করপোরেশনের ঝাড়ুদার বলছিল আজিমকে এসব কথা।
হঠাৎ করে ভবঘুরেটা হেলমেটের গ্লাসটা উপরের দিকে তুললো। আজিমের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো।
আজিমের দিকেই তাকিয়ে বললো, ‘কীরে, হেলমেট পড়বি?’