একজন ফিরোজের দিন

  • জুলিয়ান সিদ্দিকী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

আগস্ট মাস। এ মাসের একুশ তারিখটি বিশেষ একটি দিন। ক্যালেন্ডারের পাতায় লাল কালি দিয়ে বেষ্টন করে রাখা আছে কালো রঙে ছাপানো  তারিখটি। এ দিনটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, সেদিন যে কোনো মূল্যে ফিরোজকে থাকতে হবে ঢাকায়। সেদিন তার হাত ভাঙুক কি পা ভাঙুক এমন কি ডায়রিয়া হয়ে বিছানা থেকে উঠতে না পারলেও তাকে যেতে হবে সেখানে। বিকেল চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে তাকে উপস্থিত থাকতে হবে নগর ভবনের সামনে।

তাদের গ্রামের ফরিদ সাহেব চাকরি করেন সেখানে। অনেক বড় চাকরি। দামী আর ইস্ত্রি করা শার্ট-প্যান্ট, পায়ে দামী চকচকে জুতো পরে তিনি মাঝে মধ্যেই গ্রামে আসেন। লোকজন তাকে ঘিরে রাখে সারাক্ষণ। মানুষটি খুবই ভালো। গ্রামের বেশ কয়েকজনকে চাকরি দিয়েছেন। কিছুদিন আগে ফিরোজও মায়ের সঙ্গে গিয়েছিল ফরিদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। অনেক অনুনয় করে মা  ফরিদ সাহেবকে বলেছিলেন ছেলের জন্যে একটি চাকরির ব্যবস্থা করতে। মানুষটি ভালো বলেই হয়তো একজন মায়ের আকুতিতে সাড়া দিতে দেরি করেননি। সঙ্গে সঙ্গেই বলেছিলেন যে, আগস্ট মাসের একুশ তারিখ যেন তিনি ছেলেকে পাঠিয়ে দেন। সেদিন বিকেল চারটার সময় নগর ভবনের গেটে থাকবেন। সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন রতনের গ্যারেজে। পেটে-ভাতে সেখানে কাজ শিখবে আর রাতে সেখানেই ঘুমাবে। কাজ শেখা হয়ে গেলে ভালো বেতন পাবে ফিরোজ। তখন মাতা-পুত্রের খাওয়া-পরার অভাব থাকবে না।

বিজ্ঞাপন

স্কুল মাস্টার রজব ভাণ্ডারীকে জিজ্ঞেস করে ফিরোজ জেনে নিয়েছিল একুশে আগস্ট হতে আর কতদিন বাকি। সেদিনের পর থেকেই মাতা-পুত্র অপেক্ষা করছিল দিনটির জন্যে। দিনটিকে মনে রাখতে বাজার থেকে একটি এক পাতার সরকারি ক্যালেন্ডার কিনে এনেছে দশটাকা দিয়ে। তাতে লাল কালি দিয়ে একটি বৃত্ত এঁকে কালো অক্ষরের তারিখটিকে বন্দী করে দিয়েছেন মাস্টার।

হাটের দিন গাছ থেকে বেশ কটি নারকেল পেড়ে সে নিয়ে গিয়েছিল সিদ্ধেশ্বরী বাজারে। নারকেল বিক্রি করে বাজার থেকে ফিরে আসবার পথে পশ্চিম পাড়ার ছিরিপদ জিজ্ঞেস করেছিল, কিরে ফিরুজ্যা, একুইশ তারিখ হইতে আর কয়দিন?
- দুইদিন বাদেই।
হাস্যোজ্জ্বল মুখেই জানিয়েছিল ফিরোজ।
কিছুটা পথ একই সঙ্গে চলতে চলতে ছিরিপদ আরো বলেছিল, ঢাকা শহরডা অনেক সোন্দর রে! গণশার লগে যোগালির কাম করছিলাম কয়দিন।
- গণশা কইছে আমারে।
- ঢাকা শহরের খারাপ দিক হইল থাকনের জাগার খুব অভাব। এত বড়বড় দলান থাকলে হইব কী, ঘুমান-থাকনের বেশি জাগা নাই। পানি তো কিন্যা খাওনই লাগে, হাগদে মুত্তেও ট্যাকা লাগে!
ফিরোজ কী বলবে ভেবে পায় না। গ্রামে তো এ বাড়ি ও বাড়ি দু-চার পাঁচদিন থাকলেও কেউ কিছু বলবে না। এমন অনেক গেরস্থ আছে যাদের এক-আধটি ঘর বছরের বেশিরভাগ সময় খালিই পড়ে থাকে। একবার গণশার সঙ্গে সে নিজেও ঢাকা শহরের গুলশানে কাজ করতে গিয়েছিল। যে কয়েকটি দিন সেখানে ছিল, রাতের বেলা একটি ভাঙা দালানের বারান্দায় ঘুমাত। তাও কোনো কোনো রাতে চৌকিদার এসে লাঠির গুঁতো মেরে ঘুম ভাঙিয়ে দিত। তখনই সে জেনে গিয়েছিল যে, সত্যি সত্যিই ঢাকা শহর একটি কঠিন জায়গা।

বিজ্ঞাপন

ছিরিপদ নিজের বাড়ির দিকে যাবার আগে ফিরোজের একটা হাত ধরে বলল, তুই ভালোয় ভালোয় কাজ-কাম পাইলে আমার লাইগ্যাও খাইয়া পিন্দা চলনের মতন একটা কিছু ভাও করিস।
- আইচ্ছা আইচ্ছা, তুই চিন্তা করিস না!

আর দুদিন বাদেই একুশ তারিখ। ফিরোজের জীবনে খুব প্রত্যাশিত একটি দিন। ভাবতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে তার।

এমনিতেই ফিরোজের মা প্রতিদিন খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়ে উঠোন-বার ঝাঁট দেন। রাতভর ঝরে পড়া শুকনো পাতাগুলোকে একখানে জড়ো করে একটি পুরনো বস্তায় পুরে রান্নাঘরে রেখে দেন। আর সেই শুকনো পাতার আগুনেই তাদের দুজনের খাবার রান্নাবান্না হয়ে যায়।

ভোরবেলা মায়ের উঠোন ঝাঁট দেবার শব্দে প্রতিদিনই ঘুম ভাঙে ফিরোজের। কিন্তু আজ কেন যেন মায়ের ঘুম ভাঙার আগেই জেগে উঠেছে সে। আজকের দিনটার অপেক্ষাতেই ছিল সে। এ দিনটাতেই তাকে ঢাকা যাওয়ার কথা বলে দিয়েছেন ফরিদ সাহেব। দুপুর বারোটার দিকে কুটিলা স্টেশনে এসে থামবে ট্রেন। মিনিট দশেক জিরিয়ে নিয়ে ফের ছুটতে থাকবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। অতটা কম সময়ে টিকেট কাটা, খালি বগি খুঁজে ট্রেনে ওঠা খুবই ঝামেলার বলে মনে হয় তার কাছে। তাই খানিকটা সময় হাতে নিয়ে বের হলে আগে আগে টিকেট পেতে সুবিধা হয়।

বিছানায় শুয়ে থেকেই সে মায়ের জেগে উঠবার শব্দ টের পায়। অনেক বছর ধরে সে পরিচিত এসব শব্দের সঙ্গে। মায়ের ঘুম ভাঙার পর বিছানায় উঠে বসা। মেঝেতে পা রেখে উঠে দাঁড়ানো। পরনের কাপড় গোছাবার শব্দ। তারপর ছোট ছোট পদক্ষেপে দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়া। হুড়কো খোলা। কাঠের দরজার পাল্লা টানবার সময় লোহার ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দ। পুকুর ঘাটে মায়ের কুলকুচা, গলা খাকারির শব্দ। শ্লথ পায়ে ফিরে আসা। মেঝেতে নামাজের পাটি বিছানো। সব শব্দই আলাদা করে চেনা আছে তার।

অন্যান্য দিন সকাল সকাল কাজে যাবার তোড়জোড় শুরু করলেও আজ কোনো তাড়া নেই বলে কেমন একটা আলসেমিতে পেয়ে বসে তাকে। অন্য দিনগুলোর মতো হাত-পা তেমন ছটফট করে না। মনের ভেতরও নেই কোনো রকম অস্থিরতার দাপানি। হয়তো মায়েরও তেমন কোনো তাড়া নেই আজ। ছেলে শহরে যাবে। সময়টা জানা আছে বলেই হয়তো উঠোন-বার ঝাঁট দেবার শব্দগুলো তেমন একটা জোরালো শোনায় না। ফিরোজ কোনো তাড়া বোধ করে না বলেই হয়তো ফের ঘুমিয়ে পড়ে। এক সময় মায়ের ডাকে দ্বিতীয় ঘুমটা ভেঙে যায় তার। কিন্তু ততক্ষণে বেশ বেলা হয়ে গেছে। সূর্যটাও তেতে উঠেছে অনেকটা। ঘামে ভিজে চিটচিটে হয়ে আছে গলার কাছটা।

ছেলেটা বেলা করে শহরে যাবে বলেই হয়তো মায়ের রান্নার আয়োজনটা অন্যান্য দিনের চেয়ে খানিকটা ভিন্ন মনে হয়। অন্য সময় প্রতিদিন সকালে পান্তা খেয়ে সে কাজে যেত। আজ পান্তার বদলে নারকেল-চিড়ে আর গুড় দেখতে পেয়ে তার মনটা যেন আরো ভালো হয়ে যায়। বছর বছর গাছে নারকেল ধরলেও তা মাতা-পুত্রের ভাগ্যে খুব কমই জোটে। সংসারের অন্যান্য প্রয়োজনে প্রায় সবগুলোই বেচে দিতে হয়। ছোটবেলা থেকেই নারকেলের নাড়ু তার খুব পছন্দ। কখনো এমনি এমনি একটা দুটো নাড়ু কখনো বা মুড়ির সঙ্গে খেতে চমৎকার।

গুড়-নারকেল দিয়ে চিড়া মেখে খেতে খেতে সে লক্ষ্য করে যে, তার মা একটি গামছাতে কিছুটা শুকনো চিড়া আর কয়েকটি নাড়ু বেঁধে রাখলেন। তারপর তাকে দেখিয়ে বললেন, এইডা লগে লইয়া যাইস কইলাম!

ফিরোজ জানে, ট্রেনে বসে খিদে পেলেও যাতে অযথা পয়সা খরচ করে বাইরের খাবার কিনে খেতে না হয়, তার জন্যেই এমন ব্যবস্থা।

মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কুটিলা স্টেশনে এসে অবাক হয়ে যায় সে। অন্যান্য সময় স্টেশনে এত মানুষ কখনো দেখেনি সে। ঈদ আর বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতের এক দুদিন আগে ছাড়া এমন ভিড় কখনো হয় না। এত মানুষ কেন ঢাকা যাবে বুঝে উঠতে পারে না সে। টিকেট কাটতে গিয়ে দেখে কেউ নেই সেখানে। ট্রেন চলে আসতেই কেমন হুড়মুড় করে লোকজন উঠতে থাকে। বগিগুলোতে জায়গা না পেয়ে জানালায় পা দিয়ে ছাদের ওপর উঠে যেতে থাকে কেউ কেউ। ফিরোজও টিকেট ছাড়া ট্রেনের ছাদে উঠে পড়ে। আস্তে আস্তে ছাদও পরিপূর্ণ হয়ে যায়। পাশের কয়েকজনের আলাপ থেকে জানতে পারে তারা ঢাকা যাচ্ছে জনসভায় যোগ দিতে। আসলে বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়েকে দেখতে, যিনি এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী।

এতক্ষণে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় ফিরোজের কাছে। কখনো বঙ্গবন্ধুর মেয়ে, কখনো বা শেখ হাসিনা, কখনো বা প্রধানমন্ত্রী শব্দগুলো তার কানে এসেছে বহুবার। একজনই যে এই তিনটি নামে দেশের মানুষের কাছে পরিচিত তা সে জানলেও চর্ম চোখে কখনো দেখেনি। একজন নারী হয়ে কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, না জানি তিনি দেখতে কেমন। যদিও মাঝে মধ্যে বাজারে কোনো কোনো পত্রিকায় বা কোনো পোস্টারে ছবি দেখেছে, কিন্তু মন তার ভরেনি। নিজের চোখে সামনাসামনি দেখা আর ছবি দেখার মাঝে অনেক ফারাক বলে বিশ্বাস করে সে। তাই অনেকদিন থেকেই ইচ্ছেটি তার মনের ভেতর ডালপালা ছড়িয়ে শক্ত পোক্ত হয়ে শিকড় গেড়ে বসেছিল। কিন্তু তেমন কোনো সুযোগ সে পায়নি। ট্রেন ছাড়বার আগমুহূর্ত পর্যন্ত লোকজনের টুকরো টুকরো কথায় সে জেনে গিয়েছিল যে, বিকেলের দিকে জনসভায় আসবেন প্রধানমন্ত্রী। তখনই সে ঠিক করে রেখেছে যে, ফরিদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে একবার জনসভায় যাবে। কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে চাক্ষুষ করে যাবে একবার।

গ্রামের আকবর সওদাগরের মুখে অনেকবার শুনেছে বঙ্গবন্ধুর কথা। শেখ হাসিনার কথা। ছোটবেলা থেকেই তাদের নাম শুনে শুনে ভালোবাসতে শিখেছে। শ্রদ্ধা-ভক্তি করতে শিখেছে। আকবর সওদাগরের কাছে যারা ভক্তি-শ্রদ্ধার পাত্র-পাত্রী, তারা কোনো অংশেই ছোটখাটো মানুষ বা অল্প-স্বল্প ক্ষমতার মানুষ নন। এমন ধরনের মানুষদের সামনে থেকে দেখতে পাওয়াটাও অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার বলে মনে হয় তার কাছে।

চলন্ত ট্রেনের ছাদে হুহু বাতাস ফিরোজের বাবরি চুল নিয়ে খেলা করে। দুষ্টুমি করে চেপে ধরবার মতো চোখের দু পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। ট্রেনের দু পাশ দিয়ে পেছন পানে ধাবমান জনপদ ক্রমশ তাদের এগিয়ে নিয়ে যায় কমলাপুর স্টেশনের দিকে।

কমলাপুর স্টেশনটা অচেনা নয় ফিরোজের কাছে। তারপরও ট্রেনের ছাদ থেকে নামার পর নিজের মনোমতো হাঁটবার সুযোগ পায় না। স্রোতের মতো লোকজন নিজে চলতে চলতে সামনের আর দুপাশের লোকজনকেও যেন ঠেলতে থাকে সমান বেগে। যেন বাধভাঙা স্রোত সামনের ঘরবাড়ি, জমি ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে অবিরাম। সে সঙ্গে হালকা পাতলা হাতাহাতি ঠেলাঠেলি বাকবিতণ্ডা কোনোটাই থেমে নেই। ফলে একটা গমগমে ভাব ফুটে উঠেছে পুরো স্টেশন জুড়ে।

জনস্রোত ছুটে চলেছে দক্ষিণের কাচ লাগানো সদর দরজা লক্ষ্য করে। কিন্তু ডানে বামে বা আগে পেছনে মানুষ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না ফিরোজ। চলতে চলতে এক সময় নিজেকে আবিষ্কার করে স্টেশনের বাইরে। হায় হায়, জনসভায় যাওয়ার জন্যে আসা দলটিকে আর দেখতে পাচ্ছিল না। মনেমনে খানিকটা হতাশ হলেও সে কান রাখে কে কী বলছে সেদিকে। কিন্তু কাউকেই যেন জিজ্ঞেস করবার প্রয়োজন দেখে না। একটি ছোটখাটো মিছিল আসে উত্তর দিক থেকে। নানা রকম শ্লোগানে শ্লোগানে বাতাস কাঁপাচ্ছিল। কিছু না ভেবেই মিছিলে ঢুকে পড়ে সে। যে ভাবেই হোক মিছিল তো জনসভাতেই যাবে। আর সেখানে একবার যেতে পারলে প্রধানমন্ত্রীকেও এক নজর দেখা হয়ে যাবে।

মিছিলের লোকজনের মুখে নানা রকম স্লোগান শুনতে শুনতে আর বিচিত্র সব মানুষের মুখ দেখতে দেখতে কখন যে সে জনসভায় পৌঁছে  যায় বুঝতে পারে না। কিন্তু এরই মাঝে অনেক মানুষ চলে এসেছে। সামনের দিকে বাঁশের ঘেরের ভেতর দুভাগ হয়ে বসে আছে অনেক নারী-পুরুষ। জনসভার সীমানা থেকে অনেকটা দূরে রঙ-বেরঙের শরবত বিক্রি করছে একটি লোক। ফিরোজের ইচ্ছে হয় বের হয়ে গিয়ে এক গ্লাস শরবত খেয়ে আসে। কিন্তু বের হতে গিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে নানা রঙের পোস্টার-ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে আসা নানা দলের ঠেলা ধাক্কায় বের হতে পারে না। নিরুপায় হয়ে সে সামনের সারিতেই মাটিতে বসে পড়ে। পাশের একজন বোতল থেকে পানি খেয়ে সেটা ফেলে রেখেই উঠে পড়ে সামনের দিকে আগায়। সে অবসরে ফিরোজ বোতলটা টেনে নিয়ে পানি খায় আর তখনই চারদিক থেকে মুহুর্মুহু ধ্বনি উঠতে থাকে, শেখ হাসিনা, শেখ হাসিনা!
পেছন থেকে কেউ একজন তার পিঠে খোঁচা দিয়ে বলে, এই মিয়া, চুপ কইরা আছো ক্যান?
ফিরোজ কিছু একটা বলবে বলবে ভাবতেই থেমে যায় শ্লোগান। পেছনের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পায় এরই মাঝে পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। আরো পেছনের দিকে অনেক মানুষ হয়তো বসতে জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আশপাশের উঁচুউঁচু দালানগুলোর ছাদেও মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কোনো দালানের জানালায়ও দেখা যাচ্ছিল মানুষের মুখ।

প্রধানমন্ত্রী আসতে হয়তো এখনো অনেক দেরি। তাই তিনি আসবার আগে আগে সে চিড়া-আর নারকেলের নাড়ুগুলো খেয়ে নিতে পারে। ভাবতে ভাবতে সামনে গামছার পুটলিটা খুলে মেলে ধরে ফিরোজ। একটি নাড়ু মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে একমুঠ চিড়া-মুড়িও মুখে দেয়। আর খেতে খেতেই টের পায় যে, জবর খিদে পেয়েছে। এতক্ষণ মানুষের শ্লোগান, চিৎকার-ঠেলাঠেলিতে কিছু বুঝতে পারেনি। সামনের উঁচু জায়গাটা থেকে কেউ একজন প্রধানমন্ত্রী, শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুসহ আরো অনেকের কথাই হয়তো বলছিল; যার অনেক কিছুই বুঝতে পারে না সে। খানিক বাদেই সেই উঁচু জায়গাটায় অনেক মানুষ উঠে আসে আর তখনই আবার চারদিক থেকে শেখ হাসিনা, জয়বাংলা চিৎকারে বিমূঢ় হয়ে যায় সে।

চারপাশ শান্ত হতেই সে পানি খেয়ে অবশিষ্ট চিড়া-মুড়ি আর নাড়ু পুটলিটা ভালো করে বাঁধে। কাঁধের ব্যাগে সেটা গুছিয়ে রাখতে রাখতে শুনতে পায় মাইকে খুব রাগী রাগী কণ্ঠে কেউ কিছু বলছে। লোকটির পেছনে সার বেঁধে চেয়ারে বসে থাকা মানুষগুলোর মাঝে অনেক ফুল যার পেছনে একজন খুব সুশ্রী মায়ের মতো মায়াবী চেহারার নারী উঠে এসে বসলেন। পাশের লোকটিকে ফিরোজ জিজ্ঞেস করে, শেখ হাসিনা ক্যাডায় গো?
- ওই যে, ফুলগুলার পিছনে দামী চেয়ারটায় বইসা আছেন। মাথায় ঘোমটা, চোখে সোনার চশমা।
তাইলে প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু কই?
কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খেলেও আর কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না তার। বরং চিৎকার করে লোকটা মাইকে কী কী বলছে তা শুনতেই মনোযোগী হয় আরো। কিন্তু দু একটি শব্দ ছাড়া বেশিরভাগই তার কানে শব্দজট ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।

তার আবার চিড়া-মুড়ি খেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু ব্যাগে হাত দিলেও চিড়া-মুড়ির পুটলি বের করা হয় না তার। একটি বিকট শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই সব কিছু যেন অন্ধকার হয়ে যায়। পরপর আরো কয়েকটি বিকট শব্দ শুনতে পায় সে। তারপরই যেন হাজার বছরের নৈঃশব্দ্য গ্রাস করে তাকে। উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করতেই বুঝতে পারে হাত-পা অসাড় হয়ে আছে। চারপাশ অন্ধকার বলে বুঝতে পারছে না চোখ দুটো খোলা কি বন্ধ। এমন কি এও বুঝতে পারে না, সে বসে আছে কি শুয়ে আছে।

গলাটা বারবার শুকিয়ে আসছিল। পাশেই পানির বোতলটা ছিল কিন্তু হাত নাড়াতে না পারলে বোতল তুলবে কিভাবে? খুবই নিঃশক্তি লাগছিল তার। তাই শুয়ে পড়ে সেখানেই। পানি পিপাসা ছাপিয়ে যেন রাজ্যের ঘুম এসে জাপটে ধরে তাকে।