কোনো মাদকসেবীরই দোয়া কবুল হয় না
মদ সেবনের ক্ষেত্রে কোনো মাত্রাই আর নিরাপদ নয়। স্বল্প পরিমাণ মদ্যপানেও স্বাস্থ্য ঝুঁকি স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। নতুন এক গবেষণা রিপোর্টে এ কথা বলা হয়েছে। ওই গবেষণা রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি তিনজনে একজন মদ পান করে। অপরিণত বয়সে মৃত্যু ও প্রতিবন্ধিতার জন্য সপ্তম ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস মদ্যপান। বিশ্বে প্রতিবছর ২৮ লাখ মানুষ মারা যায় মদ সেবনের কারণে।
সম্প্রতি মদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে এক প্রবন্ধে এসব তথ্য প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট (the lancet)। ১৯৯০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ১৯৫টি দেশে মদের ব্যবহার, অসুস্থতা ও মৃত্যুর তথ্য এতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে গবেষকেরা বলেছেন, মদের কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই।
প্রবন্ধে বলা হয়, ডেনমার্কের মানুষ সবচেয়ে বেশি মদ পান করে। সবচেয়ে কম মদ পান করা দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের নামও আছে।
এই প্রথমবারের মতো বিশ্বের গবেষকেরা এক সুরে বলছেন, মদের কোনো গ্রহণযোগ্য মাত্রা নেই। গবেষকদের মতে, ১৫-৪৯ বছর বয়সী মানুষের ১০টি মৃত্যুর মধ্যে একটি ঘটে মদের কারণে। নিয়মিত মদ্যপান শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ও টিস্যুতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। মদে অভ্যস্ত মানুষ সহিংস হয় এবং অনেক সময় নিজের ক্ষতি করে।
বস্তুত মাদক মানব সভ্যতার চরম শত্রু। এটা জীবন ও সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেয়। শান্তির পরিবারে অশান্তির আগুন প্রজ্জ্বলিত করে এবং সমাজে অনাচার ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে। সভ্যতার চাকা পেছনের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। তাই কল্যাণের ধর্ম ইসলামে নেশা ও মাদক সম্পূর্ণ হারাম।
এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ, এসব শয়তানের অপবিত্র কার্য বৈ তো নয়। অতএব, এগুলো থেকে বেঁচে থাকো, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। শয়তান তো চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে তোমাদের বিরত রাখতে। অতএব, তোমরা এখনও কি নিবৃত্ত হবে? -সূরা মায়েদা: ৯০-৯১
বর্ণিত আয়াতে মাদক সম্পর্কে চূড়ান্ত বিধান দেওয়া হয়েছে এবং একে ঘৃণ্য ও বর্জনীয় ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু তাই নয় একে উল্লেখ করা হয়েছে পূজার বেদীর সঙ্গে।
সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যখন শরাব হারাম করা হলো- তখন আল্লাহর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবিগণ একে অপরের কাছে গিয়ে বললেন, ‘শরাব হারাম হয়েছে এবং একে শিরকের মতো (মারাত্মক গুনাহ) সাব্যস্ত করা হয়েছে।’ -আত তারগিব ওয়াত তারহিব: ৩/১৮০
হাদিস শরিফের ঘোষণায় নেশা ও মাদক সম্পূর্ণরূপে হারাম, সেটা যে নামেরই হোক; আর যেভাবেই তা গ্রহণ করা হোক। এমনকি মাদকদ্রব্যের বেচাকেনা এবং এর সঙ্গে যেকোনো পর্যায়ের সংশ্লিষ্টতা নিষিদ্ধ আর তা আল্লাহর অভিশাপের কারণ।
এককথায়, মাদক এমনই খারাপ বস্তু; যেটা উৎপাদন, বিপণন, পরিবেশন ও গ্রহণের যেকোনো পর্যায়ে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকা আল্লাহ ও তার রাসূলের অভিশাপের কারণ। আর এ তো বলাই বাহুল্য যে, আল্লাহ ও তার রাসূলের অভিশাপ যার ওপর তার জীবন কখনও শান্তির হতে পারে না। মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা তো নিষিদ্ধই, যে মজলিসে মদপান করা হয় ওই মজলিসে উপস্থিত থাকাও নিষিদ্ধ।
ইসলামে নেশা ও মাদক চরমভাবে ঘৃণিত ও বর্জনীয়। অথচ এ ঘৃণ্য ও বর্জনীয় বস্তরই ব্যাপক বিস্তার ঘটছে, সভ্য যুগের মুসলিম সমাজে। কোরআনে বর্ণিত এর কুফলও সমাজকে ভুগতে হচ্ছে। তাই তো দেখা যাচ্ছে- সমাজে পরস্পরে শত্রুতা, হানাহানি, আত্মবিস্মৃতি ও আল্লাহ বিস্মৃতি, নামাজ-রোজা বিমুখতা, উচ্ছৃঙ্খলা ও উন্মত্ততা। মাদক সেবন করে খুনের ঘটনাও আর নতুন কিছু নয়। এ সব আমাদের সমাজে ঘটছে। আমরা মাদকের এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে চাই। কিন্তু মুক্তির উপায়?
মুক্তির একমাত্র উপায় ইসলাম। কোনো মানুষ যদি ইসলামকে জীবনে যথার্থ ও আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে এবং কোরআন-সুন্নাহর বিধানকে সমর্পিত চিত্তে শিরোধার্য করে, তাহলে সে মদ ও মাদক থেকে মুক্তি পাবে- ইনশাআল্লাহ।
অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা গেছে, এখনও যারা ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলেন, তারা এ ধরণের ব্যাধি থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত।
মিরাজের রজনীতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে বিভিন্ন অপরাধে শাস্তি দেখানো হলো। তিনি মদ, মাদক ও নেশা গ্রহণকারীদের শাস্তি দেখলেন। তারা জাহান্নামিদের শরীর থেকে নির্গত বিষাক্ত নোংরা পুঁজ পান করছে। নবী করিম (সা.) মালিক নামে জাহান্নামের রক্ষী ফেরেশতাকে দেখলেন। সে মলিন মুখ, হাসি নেই। বলা হলো, জাহান্নাম সৃষ্টির পর থেকে সে কখনও হাসেনি। -সহিহ বোখারি ও মুসলিম, মিরাজ অধ্যায়
হজরত আবু সালাবা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন অর্ধশাবানের রাত (শবে বরাত) আসে তখন আল্লাহতায়ালা মাখলুকাতের (সৃষ্টি) প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকান; মুমিনদিগকে ক্ষমা করে দেন, কাফেরদের ফিরে আসার সুযোগ দেন এবং মদ্যপায়ীদের মদ্যপান পরিত্যাগ ছাড়া ক্ষমা করেন না।’-শোয়াবুল ইমান: ৩৮২
রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোর মধ্যে রয়েছে শবে কদর বা লাইলাতুল কদর। যে রাতে কোরআনে কারিম নাজিল হয়েছে। যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতে সন্ধ্যালগ্নে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেন, ‘কে আছ ক্ষমাপ্রার্থী? আমি ক্ষমা করে দেবো।’ এভাবে সকাল পর্যন্ত ডেকে ডেকে ক্ষমা করতে থাকেন। কিন্তু এ পবিত্র ও মহিমান্বিত কদরের রাতেও আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত থেকে যে পাঁচ প্রকার লোক বঞ্চিত থাকবে, তাদের মধ্যে প্রথম হলো মাদকসেবীরা। ওই পাঁচ প্রকার লোক হলো- ১. মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ী, ২. মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান, ৩. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, ৪. ইচ্ছাকৃত নামাজ তরককারী, ৫. বিনা কারণে অপর মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নকারী।