স্বাধীনতা আল্লাহর দান, বিশেষ নেয়ামত
স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার, যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য এক বিশেষ নেয়ামত। এ অধিকার যে কত বড় মাপের, তা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধরাই কেবল অনুধাবন করতে পারেন। আল্লাহতায়ালা তা খর্ব করার অধিকার দেননি কাউকে। ইসলামের শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠিত এ অধিকার খর্ব করা যেমন মানবাধিকার পরিপন্থী, তেমনি মহান আল্লাহর আইনের বিরোধীও বটে।
শান্তির ধর্ম ইসলাম গতানুগতিক কোনো স্বাধীনতার স্লোগান নিয়ে আসেনি, বরং বিশ্ব মানবতার সামগ্রিক জীবনে মুক্তি, সাম্য ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার বাস্তব কর্মসূচি দিয়ে মানুষকে সৎপথে চলার দিকনির্দেশনা দিতে এসেছে।
আইয়ামে জাহেলিয়া তথা অন্ধকার যুগেই ইসলাম দেখিয়েছে স্বাধীনতার আলোকরশ্মি। যেখানে ছিল প্রচুর রাজনৈতিক শক্তি। সর্বসাধারণকে রোম-পারস্যের মতো পরাশক্তিগুলোর কঠিন নিপীড়ন ও অত্যাচারী আইন-কানুনের অধীনে জীবন কাটাতে হতো। এক ধরনের গৃহবন্দী অবস্থায় জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছিল চরমে।
বিশেষভাবে ধর্মীয় অঙ্গনে এই মাত্রা ছিল ধ্বংসাত্মক। অথচ ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল একটি মৌলিক স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতা রক্ষায় ইসলাম বদ্ধপরিকর। তাই অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস গ্রহণ করানোর ক্ষেত্রে কোনোরূপ জবরদস্তি ইসলামে বৈধ নয়। এ বিষয়ে কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সবাই ঈমান আনত। তবে কি তুমি মুমিন হওয়ার জন্য মানুষের ওপর জবরদস্তি করবে?’ -সূরা ইউনুস: ৯৯
অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।’ -সূরা বাকারা: ২৫৬
ইসলামে অন্য ধর্মের উপাস্যকে গালি দিতে নিষেধ করে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহকে ছেড়ে যাদের তারা ডাকে, তাদের তোমরা গালি দিও না।’ -সূরা আনয়াম: ১০৮
ইসলাম অমুসলিমদের শুধু তাদের ধর্ম পালনে স্বাধীনতা দেয়নি, বরং ইসলামি আইন অমুসলিমদের তাদের কার্যক্রম এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারেও সাহায্য করে থাকে।
মানুষের বহুরূপ দাসত্ব-শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে ইসলাম স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। বিশ্বাসের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা এবং সমালোচনা সব ক্ষেত্রেই ইসলাম এই স্বাধীনতা দিয়েছে। ইসলাম মানুষকে চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির স্বাধীনতা দিয়ে মানব অস্তিত্বে স্বাধীনতার বীজ বপন করে দিয়েছে। ইসলাম মানুষকে সঠিক পথ প্রাপ্তির জন্য কোরআনে কারিম নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ ও চিন্তাভাবনা করার আহ্বান জানিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তবে কি তারা কোরআন সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করে না? এটা যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছ হতে আসত তবে তারা তাতে অনেক অসঙ্গতি পেত।’ -সূরা নিসা: ৮২
বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রসরতা ও মুক্তচিন্তাকে ইসলাম সাধুবাদ জানায়। আল্লাহতায়ালা চিন্তাশীল মানুষদের ভালোবাসেন। যারা চিন্তা করে না, তাদের ভর্ৎসনা করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি জাহান্নামের জন্য বহু জীন ও মানবকে সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তদ্দারা তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চোখ আছে কিন্তু তাদ্বারা তারা দেখে না।’ -সূরা আরাফ: ১৭৯
মূলত ইসলাম যুক্তি, বুদ্ধি-বিবেচনার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছে, দিয়েছে যথাযথ মর্যাদা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি বোধসম্পন্ন লোকদের কাছে নিদর্শনাবলি বিবৃত করি।’ -সূরা রূম: ২৮
এই আয়াতে প্রতীয়মান হয়, বোধসম্পন্ন লোক তারাই যারা বিবেক বা চিন্তাশক্তির মাধ্যমে প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করতে পারে। তাই কোরআনে চিন্তা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিবেক কাজে লাগানোর কথা বলা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী! বলুন, আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করো।’ -সূরা ইউনুস: ১০১
মত প্রকাশের অধিকার মানুষের জন্মগত। ইসলাম প্রতিটি নাগরিককে জাতীয়, আঞ্চলিক এমনকি ব্যক্তিগত বিষয়েও সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ মত প্রকাশের অধিকার দিয়েছে। এ অধিকার উপেক্ষা করে যুগে যুগে কিছু পাপাচারী স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে আইনি বাধ্যবাধকতা আরোপ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে পরোক্ষভাবে নাগরিক জীবনকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে দেশে দেশে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ইসলাম শুধু পুরুষদের তার মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয়নি, নারীদেরও তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। মদিনা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে মহানবী হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীর মতামত দেওয়াকে আইনগত ভিত্তি দান করেন। তিনি পুরুষদের মতো নারীদের থেকেও বিভিন্ন বিষয়ে অঙ্গীকার গ্রহণ করতেন। তার এ সুন্নতের ওপর আমল করে খোলাফায়ে রাশেদিন তাদের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে নারীদের মতামতের গুরুত্ব নিশ্চিত করেন।
একদিন মসজিদে খুতবা দানকালে হজরত উমর (রা.) বেশি পরিমাণ দেনমোহর দেওয়াকে নিরুৎসাহিত করেন। এ ভাষণ শুনে এক মহিলা প্রতিবাদ করে বললেন, ‘আল্লাহ তো আমাদের দিয়েছেন আর আপনি কেড়ে নিচ্ছেন? আপনি কি জানেন না, আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা যদি এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করা স্থির করো এবং তাদের একজনকে অগাধ অর্থও দিয়ে থাকো, তবুও তা থেকে কিছুই প্রতিগ্রহণ করো না।’ -সূরা নিসা: ২০
মহিলার এ কথা শুনে হজরত উমর (রা.) সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বললেন, একজন নারী সত্য বলেছে, উমর ভুল করেছে।’ এটাই ইসলাম।
ইসলামে স্বাধীনতার মর্ম হলো ব্যাপক। ইসলাম রক্তপাত, হানাহানি, মারামারি, হত্যা অথবা ইসলাম গ্রহণে জবরদস্তির অনুমোদন দেয় না, কিন্তু অন্যায়, হত্যা, স্বাধীনতা হরণ প্রতিরোধে যুদ্ধ করতেও নির্দেশ দেয়। নিজ দেশকে পরাধীনতামুক্ত রাখতে সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগে নির্র্দেশ দিয়েছে ইসলাম।
কেননা, কোনো জুলুমকেই ইসলাম প্রশ্রয় দেয় না। জালিমদের খপ্পর থেকে মুক্ত ও স্বাধীন করতে লড়াই করার তাগিদ দিয়ে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের কী হলো যে, তোমরা যুদ্ধ করবে না আল্লাহর পথে এবং অসহায় নর-নারী এবং শিশুদের জন্য যারা বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এই জনপদ যার অধিপতি জালিম, তার থেকে আমাদের অন্যত্র নিয়ে যাও, তোমার কাছ থেকে কাউকে আমাদের অভিভাবক করো এবং তোমার কাছ থেকে কাউকেও আমাদের সহায় করো।’ -সূরা নিসা: ৭৫
জুলুম ও শোষণমুক্ত, আল্লাহদ্রোহী মানসিকতামুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রকে কল্যাণরাষ্ট্রে অক্ষুণ্ণ রাখতে নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। কেননা, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা অধিক কঠিন। তাই তো আল্লাহ আদেশ করেছেন, ‘তোমরা সর্বদাই তোমাদের শত্রুদের প্রতিহত করতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে সাবধান থাকবে। এই প্রস্তুতি দ্বারা তোমরা তোমাদের এবং আল্লাহর দুশমনদের ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখবে।’ -সূরা আনফাল: ৬০
ইসলাম স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হলেও সে স্বাধীনতা বল্গাহীন স্বাধীনতা নয়। সে স্বাধীনতা কিছু বিধি-নিষেধ দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত। ইসলামে স্বাধীনতা হচ্ছে নিজেকে আল্লাহর কাছে অত্মসর্ম্পণ করে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করা। আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘বলো, আমার নামাজ, আমার ইবাদত, আমার জীবন ও আমার মরণ জগতের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে।’ -সূরা আনয়াম: ১৬২
ইসলাম মানুষকে রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছে, কিন্তু স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বৈরতান্ত্রিকতাকে মোটেও প্রশ্রয় দেয়নি। দলের ঊর্ধ্বে উঠে ছোট-বড়, ধনী-নির্ধন, দুর্বল-সবল সবার প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। ইসলাম শোষণমুক্তির কথা বলে। মানুষের দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে মানুষকে আল্লাহর কাছে সমর্পিত হতে শিক্ষা দেয়। কাজেই মুসলমানের প্রকৃত মুক্তি ও সফলতা হলো- পরকালীন মুক্তি ও সাফল্য। কোনো কাজে আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্য না হওয়া পর্যন্ত মুসলমানদের স্বাধীনতা রয়েছে।
ইসলাম স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। বস্তুত দেশপ্রেম ও জাতিপ্রেমের কোনো বিকল্প নেই। দেশের প্রচলিত (ইসলামবিরোধী নয় এমন) দেশীয় পণ্যকে প্রাধান্য দেওয়া, জাতীয় সম্পদের সুরক্ষা, অপচয়রোধ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা ইত্যাদি বিষয় হলো দেশপ্রেমের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এসব বিষয়ের প্রতি প্রতিটি নাগরিককে যেমন সজাগ থাকতে হবে, তেমনি শাসকদেরও এর প্রতি যত্নশীল হতে হবে।
ইসলাম শান্তির কথা বলে। মানুষকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর কাছে সমর্পিত হতে শিক্ষা দেয়। কাজেই মুসলমানদের প্রকৃত মুক্তি ও সফলতা হলো- ইহজগতে স্বাধীন হয়ে বেঁচে থাকা এবং পরকালীন মুক্তি ও সাফল্য। প্রতি বছর মহান স্বাধীনতা দিবস জাতির জীবনে প্রেরণায় উজ্জীবিত হওয়ার নতুন বার্তা নিয়ে আসে। স্বাধীনতা দিবস তাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে মুক্তির প্রতিজ্ঞায় উদ্দীপ্ত হওয়ার ইতিহাস। যাদের রক্তদান এবং ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন, তাদের জন্য আমাদের উচিত মহান আল্লাহর দরবারে মন উজাড় করে দোয়া করা। মহান আল্লাহর অপূর্ব দান স্বাধীনতা মূলত তখনই অর্থবহ হবে, যখন প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়করণ, লুটপাট, ক্ষমতার অপব্যবহার, আইনের অপপ্রয়োগ, জবরদখল, সুদ-ঘুষ, ঋণখেলাপি, যিনা-ব্যভিচার, হত্যা, গুম ইত্যাদি অপশাসন দূর হবে।
প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে- শহীদদের স্বপ্ন ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে সর্বাত্মক চেষ্টা করা। এবারের স্বাধীনতা দিবসে এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।