স্থিরতা নামাজের প্রাণ
খুশু অর্থ মনের স্থিরতা। ইসলামি পরিভাষায় খুশু বলা হয়- মনের গহীনে আল্লাহতায়ালার প্রতি সীমাহীন শ্রদ্ধাবোধ, ভক্তি, ভালোবাসা ও ভয় লালন করে বিনয়ের আতিশয্যে নামাজে নিমগ্ন হয়ে থাকাকে। সারকথা, মন নামাজ থেকে ছুটে অন্যকোনো কিছুর দিকে না যাওয়া, নামাজের মধ্যে মনে অন্যকিছুর খেয়াল না আসা, আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথনের অনুভূতি ও অবস্থা জাগ্রত থাকা ইত্যাদিই খুশু।
খুশু যদিও মনের একটি অবস্থার নাম কিন্তু বাহ্যিক অঙ্গে তার একটা ছাপ ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেয়ে থাকে। তাই হাত, পা, চোখ, মাথা ইত্যাদি অঙ্গ নামাজের মধ্যে অহেতুক নড়াচড়া না করাও খুশুর অংশ।
খুশু নামাজের প্রাণ। এ ছাড়া নামাজ হবে নিষ্প্রাণ, মূল্যহীন, নিছক লাশ। নামাজের যত সওয়াব, ফজিলত, মর্যাদা ও পুরষ্কার কোরআন-হাদিসে বর্ণিত হয়েছে সে সবকিছু খুশুযুক্ত নামাজের জন্যই। খুশুবিহীন নামাজ মহান মালিকের কাছে সওয়াব ও পুরষ্কার যোগ্য হয় না।
জীবনে চূড়ান্ত সফলতা লাভের জন্য মহান আল্লাহ সর্বপ্রথম যে গুণ অর্জন করতে বলেছেন তা হলো- নামাজের খুশু। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে, ‘অবশ্যই সফল হয়েছে ওই সকল মুমিন, যারা তাদের নামাজে খুশু (মনের স্থিরতা ও ধ্যান মগ্নতা) ধরে রাখে।’ -সূরা মুমিনুন: ১-২
খুশুর প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে যেয়ে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর জিকিরের (নামাজ) জন্য এবং যে সত্য তিনি অবতীর্ণ করেছেন তার (কোরআন) জন্য তাদের অন্তরে খুশু আসার (ভক্তি-বিগলিত হওয়ার) সময় কি এখনও আসেনি?’ -সূরা হাদিদ: ১৬
এ আয়াতে মহান আল্লাহ মনের মধ্যে খুশু অর্জনের আদেশ দিয়েছেন। আবার এ আয়াতের শেষাংশে তিনি পূর্ববর্তী পাপীদের মতো কঠিন মনের হতে নিষেধ করেছেন।
এ থেকে বুঝা যায় মানুষের পক্ষে মন কঠিন হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করা আর মনের মধ্যে খুশু অর্জন করা সম্ভব। চেষ্টা করলে ও সদিচ্ছা থাকলে এক জন মানুষ এ গুণ অর্জন করতে পারবে।
মনের মধ্যে খুশু অর্জনের কিছু উপায়
১. খুশু লাভের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করা। তার তওফিক ছাড়া কোনো সৎ কর্ম করার সাধ্য বান্দার নেই।
২. নামাজের আগে সকল সুন্নত ও আদব রেয়ায়েত করে অজু করা।
৩. অজু ও নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে দুনিয়াবি কোনো কাজে লিপ্ত না হওয়া।
৪. খুশু লাভের সদিচ্ছায় নামাজের বাহ্যিক সকল সুন্নত ও আদব রক্ষা করা। দাঁড়ানো অবস্থায় সেজদার স্থানে, রুকু অবস্থায় পায়ের মাঝে, সেজদা অবস্থায় নাকে, বসা অবস্থায় কোলে দৃষ্টি রাখা।
৫. নামাজে পাঠ করা প্রতিটি বাক্য ও শব্দকে তার অর্থ ও মর্ম বুঝে বুঝে মনের আবেগ থেকে উচ্চারণ করা। সেই অর্থ ও মর্মের সঙ্গে নিজের অনুভূতি ও উপলব্ধিকে একাকার করে ফেলা।
৬. নামাজে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকা, এটাই আমার জীবনের শেষ নামাজ।
৭. নিয়মিত কিছুক্ষণ নিজেকে মৃত্যু, কবর, হাশর ও জাহান্নামের সম্মুখীন কল্পনা করা।
৮. নিয়মিত (সম্ভব হলে অর্থ বুঝে) কোরআন তেলাওয়াত করা।
৯. সকল কাজের ও সকাল-সন্ধ্যার মাসনূন জিকির অর্থ বুঝে আদায় করা।
১০. হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবাগণের নামাজ আদায়ের ধরণ পাঠ করা ও পরস্পর আলোচনা করা।
১১. নামাজে এ কথা ভাবা যে, আমি এখন সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে কথা বলছি। তিনি আমার প্রতিটি কথার উত্তর দিচ্ছেন।
মনে রাখতে হবে, নামাজে বাহ্যিক অঙ্গগুলোর অবস্থান ঠিক করা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো- নামাজে মনের স্থিরতা, মনের নিমগ্নতা ধরে রাখা। নামাজে হাত কোথায় থাকবে, দৃষ্টি কোথায় থাকবে, হাত কখন উঠাতে হবে আর কখন ছেড়ে দিতে হবে এগুলো নিয়ে হাদিস বিশারদ ও ফেকাহবিদদের মাঝে প্রচুর মতপার্থক্য আছে। কিন্তু নামাজ কবুল হওয়ার জন্য যে মন স্থির রাখতে হবে, ধ্যানমগ্নতার সাথে নামাজ পড়তে হবে এতে কিন্তু কোনো হাদিসবিদ, ফেকাহবিদ, তাফসিরবিদ মতপার্থক্য করেননি। সর্বসম্মত বিষয়ের প্রতি অত্যাধিক যত্নবান না হয়ে, বিরোধপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিবাদ করে আমরা নিজেদের সময় ও সম্পর্ককে নষ্ট করি।
নামাজের কাজগুলোর মধ্যে সবার আগে ও সবার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে খুশুকে।