হিজরি সন: পরিচিতি ও দৈনন্দিন জীবনে এর প্রভাব
মানুষ তাদের প্রয়োজনে, বিভিন্ন কাজের সুবিধার্থে দিন-তারিখ ঠিক রাখতে কোনো না কোনো বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করে থাকে। আমাদের দেশে সাধারণ তিনটি ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হয়। সেগুলো হলো- বাংলা সন, ইংরেজি সাল ও হিজরি সন। এর মধ্যে হিজরি সনের সম্পর্ক চন্দ্রের সঙ্গে। বিশ্বের প্রায় দেড়শ’ কোটি মুসলমান এই সন ব্যবহার করে থাকেন। হিজরি সন প্রচলন হয় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু খিলাফতকালে।
মুসলমানদের কাছে হিজরি সন গুরুত্ব হওয়ার কারণ হলো, মুসলিম বিশ্বে চাঁদের হিসাবে অনেক ইবাদত-বন্দেগি, আমল-অনুশাসন পালিত হওয়ায় হিজরি সনের পবিত্র মাহাত্ম্য ও প্রাচুর্য প্রত্যেক মুসলিমের অন্তরজুড়ে সমানভাবে বিশেষ মর্যাদায় সমাসীন হয়েছে।
হিজরি সনের মাসগুলো হলো- মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জমাদিউল আউয়াল, জমাদিউস সানি, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ।
হিজরি সনের নবম মাস রমজানুল মোবারক সবচেয়ে প্রাচুর্যমণ্ডিত ও মর্যাদাপূর্ণ। এটা রোজা পালনের মাস। সহমর্মিতার মাস, তাকওয়া অর্জনের মাস।
হিজরি নববর্ষের শুরুর মাস হচ্ছে মহররম, যার অর্থ হচ্ছে- অলঙ্ঘনীয় পবিত্র। এই মহররমের ১০ তারিখকে বলা হয় আশুরা। এই আশুরা সৃষ্টির আদিকাল থেকেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার নীরব সাক্ষী। আজকের আলোচনা সেসব বিষয়ে নয়।
রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেরাজে গমন করেন, যা লাইলাতুল মেরাজ হিসেবে পরিচিত। হিজরি সনের অষ্টম মাস শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে বলা হয় লাইলাতুল বরাত, যার অর্থ মুক্তির রজনী। শাওয়ালের প্রথম তারিখ পালিত হয় পবিত্র ঈদুল ফিতর।
জিলহজ মাসে মুসলমানরা হজ পালন করে থাকেন। যা সামর্থ্যবানদের জন্য জীবনে একবার পালন করা ফরজ। ১০ জিলহজ বিশ্ব মুসলিম পালন করে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ।
প্রাচীনকাল থেকে আরব দেশে চাঁদের হিসাবে মাস গণনা করার রেওয়াজ চালু ছিল। মাসের গণনা আরবদের মাঝে থাকলেও সাল বা বর্ষ গণনার রীতি তাদের মধ্যে ছিল না। আরব দেশে প্রাচীনকালে ১২টি মাসের মধ্যে সফর আউয়াল, রজব, জিলকদ ও জিলহজ এই চারটি মাসকে বলা হতো- আল মহররম অর্থাৎ অলঙ্ঘনীয় পবিত্র। এ চারটি মাসে সব ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, মারামারি-খুনাখুনি থেকে তারা বিরত থাকত। পরবর্তীকালে আরবি মাসগুলোর প্রথম মাস সফরে আউয়ালকে মহররম নামকরণ করা হয়। হিজরি সনের প্রবর্তন করেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)।
তিনি ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করে একে একে যেমন ইসলামের বিজয় পতাকা তদানীন্তন পৃথিবীর বৃহৎ এলাকাজুড়ে উড্ডীন করেন; তেমনি বহু সংস্কারমূলক কাজ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন তিনি।
৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত হিজরি সন তার এক অমর কীর্তি। আর এই হিজরি সনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার সেই ঐতিহাসিক স্মৃতি।
হজরত ওমর (রা.) খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করে লক্ষ্য করলেন যে, সরকারি নথিপত্রে তারিখ লিখতে শুধু মাসের নাম লেখা হয়। ফলে বোঝা যায় না যে এই মাস কোন বছরের। আর নিজস্ব সাল না থাকার কারণে শুধু মাসের নাম উল্লেখ করা ছাড়া কোনো বিকল্প পথ ছিল না। যথাযথভাবে তারিখ না লেখার কারণে বহু জটিলতা ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে থাকে। বিশেষ করে বিভিন্ন প্রদেশের শাসনকর্তাদের কাছে পত্রাদি ও ফরমানাদিতে শুধু মাসের উল্লেখ থাকায় কোন বছরের মাস তা নির্ধারণ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।
এ ব্যাপারে সাহাবি হজরত আবু মুসা আশয়ারি (রা.) খলিফা হজরত ওমরের (রা.) দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি একটি নিজস্ব সাল উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা ভীষণভাবে অনুধাবন করলেন। তিনি হজরত উসমান (রা.) ও হজরত আলী (রা.)সহ বিশিষ্ট কয়েকজন সাহাবির কাছে নতুন সনের ব্যাপারে পরামর্শ চাইলেন। হজরত আলী (রা.)-এর পরামর্শে হিজরতের বছরকে নতুন সন গণনার শুরু ধরে হিজরি সন প্রবর্তিত হয়। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) হিজরত করেন ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল। হিজরতের ঘটনা রবিউল আউয়াল মাসে ঘটলেও আরবের প্রচলিত মাস গণনার প্রথম মাস সফরে আউয়াল বা মহররমের ১ তারিখকেই হিজরি সনের শুরু হিসেবে স্থির করে এই নতুন সনের প্রবর্তন ঘোষণা করা হয়।
৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিজরি সন প্রবর্তিত হলে তার এক বছরের মধ্যে তা আমাদের এই বাংলাদেশে চলে আসে আরব বণিকদের হাত ধরে। হিজরি সন প্রবর্তনের বছর বা তার পরের বছর এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয় এবং হিজরি সনও স্বাভাবিকভাবে আমাদের দেশে প্রচলিত হয়। এই হিজরি সন আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় সন হিসেবেও প্রচলিত হয়েছিল, যা ৫৫৬ বছর স্থায়ী হয়েছিল। এখনও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে হিজরি সনের প্রভাবই বেশি।