ভ্যাট ফাঁকি দিয়েও রফতানি ট্রফি লাভ!

  • মাহফুজুল ইসলাম, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

নরসিংদীতে অবস্থিত থার্মেক্স গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান/ ছবি: সংগৃহীত

নরসিংদীতে অবস্থিত থার্মেক্স গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান/ ছবি: সংগৃহীত

নিয়মিত ভ্যাট ফাঁকি দেন তিনি, আবার শিল্প মন্ত্রণালয়ের দেওয়া রফতানি ট্রফিও পান। যে যে বছর কমার্শিয়ালি ইমপরট্যান্ট পারসন (সিআইপি) সম্মাননা নিজের ঘরে তুলেছেন, সে কয় বছর নিজের প্রতিষ্ঠানের প্রযোজ্য মূসকের এক টাকাও পরিশোধ করেননি।

তিনি নরসিংদি ভিত্তিক থার্মেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুল কাদির মোল্লা। সরকারকে কর দেন না, অথচ রফতানি ট্রফি লাভ করেন। আবার গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতেও একেবারেই অনীহা তার। 

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে প্রতিষ্ঠানটির জালিয়াতির তথ্য। কর না দিয়েও কিভাবে সিআইপি হন তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা।

ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে পোশাকখাতের রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান থার্মেক্স গ্রুপের। এই গ্রুপের দুই অঙ্গ প্রতিষ্ঠান থার্মেক্স টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড ও মেসার্স আদুরি অ্যাপারেলসের বিরুদ্ধে কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর।

তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, মেসার্স থার্মেক্স টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত অপরিশোধিত মূল্য সংযোজন করের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৮ লাখ ৪৮ হাজার ৩৪৩ টাকা। আর এই পরিমাণ মূসক সরকারি কোষাগারে পরিশোধ না করায় ১৯৯১ সালের মূসক আইনের ধারা ৩৭ এর উপধারা ৩ অনুসারে ২ শতাংশ হারে সুদসহ বকেয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ লাখ ১৩ হাজার ৯৮১ টাকা।

অন্যদিকে এই গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান আদুরি অ্যাপারেলসের ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বার্ষিক অডিট রিপোর্টের তথ্যানুযায়ী প্রযোজ্য মূসকের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০ লাখ ৭৪ হাজার ৭৭০ টাকা। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি মূসক পরিশোধ করেছে মাত্র ১৮ লাখ ৯২ হাজার ৬১৪ টাকা।

অপরিশোধিত মূসকের পরিমাণ দাঁড়ায় ১১ লাখ ৬২ হাজার ১৫৬ টাকা। সুদসহ অপরিশোধিত মূসকের পরিমাণ ১৭ লাখ ৪৩ হাজার  ২৩৪ টাকা। থার্মেক্স গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠানের অপরিশোধিত মূসকের পরিমাণ এক কোটি ১০ লাখ ৫৭ হাজার ২১৫ টাকা।

একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল কাদির মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

থার্মেক্স গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজার ইকবাল মাহমুদ বার্তা২৪.কমকে জানান, তার প্রতিষ্ঠানের কাছে এনবিআরে মূসক পরিশোধের ক্লিয়ারেন্স আছে। তাদের কোনো অসঙ্গতি নেই। এনবিআর থেকে পাওয়া তথ্যে অসঙ্গতি থাকতে পারে বলেও দাবি করেন তিনি।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Mar/06/1551872588073.jpg

অনুসন্ধানে জানা যায়, থার্মেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল কাদির মোল্লা ২০১২-১৩ অর্থবছরে ব্যক্তি শ্রেণীতে সেরা করদাতা ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মধ্যে সেরা করদাতা নির্বাচিত হয়েছিলেন।

অথচ এনবিআরের তদন্ত প্রতিবেদন বলছে ২০১২-১৩ অর্থবছরে তার প্রতিষ্ঠান থার্মেক্স টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড সরকারি কোষাগারে এক টাকাও মূসক প্রদান করেনি। 

২০১৫ সালেও পোশাক রফতানিতে বিশেষ অবদান রাখায় সিআইপি নির্বাচিত হয়েছিলেন থার্মেক্স গ্রুপের কর্ণধার। অথচ এনবিআরের তদন্ত বলছে, একই বছর থার্মেক্স টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড মূসক পরিশোধ করেছে নামে মাত্র।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে মূসক আরোপযোগ্য সেবার মূল্য ছিলো ৪৪ লাখ আট হাজার ৭২ টাকা, বিপরীতে প্রদেয় মূসকের পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচ লাখ সাত হাজার চার টাকা। এই বছরও বেশ কর ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এ বছর প্রতিষ্ঠানটি মূসক পরিশোধ করে দুই লাখ ৩৯ হাজার ৮২৩ টাকা, অপরিশোধিত থাকে দুই লাখ ৬৭ হাজার ১৮১ টাকা।

এই বছর আদুরি অ্যাপারেলস লিমিটেডের অপরিশোধিত মূসকের পরিমাণ দাঁড়ায় ১১ লাখ ৬২ হাজার ১৫৬ টাকা, যা সুদসহ মোট অপরিশোধিত মূসকের পরিমাণ ১৭ লাখ ৪৩ হাজার  ২৩৪ টাকা।

প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির  মূসক আরোপযোগ্য সেবার মূল্য ছিল দুই কোটি ২১ লাখ এক হাজার টাকা। এর বিপরীতে প্রদেয় মূসকের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৩ লাখ ১০ হাজার ১২৬ টাকা।

২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠানটির মূসক আরোপযোগ্য সেবার মূল্য ছিলো ৮০ লাখ ৯৬ হাজার ৮২০ টাকা, বিপরীতে প্রদেয় মূসকের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮ লাখ ৬৯ হাজার ১৬ টাকা।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির মূসক আরোপযোগ্য সেবার মূল্য ছিলো ৬ কোটি ২৯ লাখ ৮৬ হাজার ৬২৪ টাকা, বিপরীতে প্রদেয় মূসকের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩২ লাখ ৭ হাজার ৯৬৮ টাকা। কিন্তু এই তিন অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি সরকারি কোষাগারে এক টাকাও মূসক আদায় করেনি।

২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানির মূসক আরোপযোগ্য সেবার মূল্য ছিলো ২২ লাখ ৯৬ হাজার ১৪৮ টাকা, বিপরীতে প্রদেয় মূসকের পরিমাণ দাঁড়ায় দুই লাখ ৫ হাজার ৩০০ টাকা। অথচ এই অর্থবছরে এসে প্রতিষ্ঠানটি মূসক দেয় ১১ হাজার ২৫০ টাকা। অর্থাৎ ঐ অর্থবছরে বকেয়া থেকে যায় এক লাখ ৯৪ হাজার ৪৯ টাকা।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে মূসক আরোপযোগ্য সেবার মূল্য ছিলো ৪৪ লাখ ৮ হাজার ৭২ টাকা, বিপরীতে প্রদেয় মূসকের পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচ লাখ সাত হাজার চার টাকা। এই বছরও বেশ কর ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এ বছর প্রতিষ্ঠানটি মূসক পরিশোধ করে দুই লাখ ৩৯ হাজার ৮২৩ টাকা, অপরিশোধিত থাকে দুই লাখ ৬৭ হাজার ১৮১ টাকা।

প্রতিবেদনের পর্যালোচনায় তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত কর্তনযোগ্য প্রদেয় মূসকের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮০ লাখ ৯৯ হাজার ৪১৬ টাকা। এই মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ দুই লাখ ৫১ হাজার ৭৪ টাকা।

বিপরীতে পরিহারকৃত মূলধন দাঁড়ায় ৭৮ লাখ ৪৮ হাজার ৩৪৩ টাকা। এই সময়ে উক্ত মূসক যথাসময়ে পরিশোধ না করায় মূল্য সংযোজন কর আইন ১৯৯১ এর ধারা ৬ এবং একই আইনের প্রণীত বিধিমালার বিধি ২৩ লঙ্ঘন করা হয়েছে।