শার্লটটাউনের চিঠি : জীবন যখন যেমন
করোনাকালে সবচেয়ে বেশি শোনা বাক্য : ‘ভাল্লাগছে না’। কোভিড-১৯ নামের ক্ষুদে অদেখা শত্রু সারা বিশ্বকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। টপাটপ মানুষ মরছে। অথচ যমদুয়ারে কাঁটা দেওয়ার কোনো পন্থা বেরোচ্ছে না। সংক্রমণের ভয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সঠিক সময়ে চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির অনিশ্চয়তার আতঙ্ক। আর এই সব মিলেমিশে আমাদের মনের চাপ ঊর্ধ্বসীমা অতিক্রম করেছে এবং আমরা সকলেই কোনো না কোনো সময়ে পরস্পরকে উচ্চস্বরে অথবা নিজেকেই অনুচ্চারে বলছি, ‘ভাল্লাগছে না’।
এই ক্রান্তিকালের শুরুতে কিন্তু এমনটি ছিল না। নটা-পাঁচটার যে জীবনে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম সেটাতে হঠাৎ বিরাম পড়ায় খুব একটা অখুশি হইনি কেউ। সবার মধ্যে বেশ একটা ছুটি-ছুটি হালকাভাব এসেছিল। সংক্রমণের খবরে তেমন উদ্বেগ ছোঁয়নি তখনও। মনে হয়েছিল এই রোগে আমাদের চেনা-জানা কিংবা আপনজনদের কারো কিচ্ছুটি হবে না। বিশ্বাস করেছিলাম হ্যান্ড-সেনিটাইজার আর মাস্কের বর্মেই এই আপদ শতহস্ত দূরে থাকবে। তাই আতঙ্ক নয় হালকা মেজাজেই আমাদের ঘরবন্দী জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল। নতুন রান্না, পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঘন হয়ে বসে পুরনো সিনেমা/সিরিয়াল দেখা, নতুন বই কিংবা পুরনো কোনো শখ নতুন করে ঝালাই করা...এইসব নানা আয়োজনে বেশ কাটছিল সবার। প্রায় সকলের বাড়িতেই গৃহসহকারীদের ছুটি দিয়ে দেওয়ার ফলে যে বাড়তি কাজের চাপ, তাও পরিবারের সবার সঙ্গে ভাগবাটোয়ারায় সামলানো গিয়েছিল। কিন্তু এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকেই আমরা টের পেলাম এই লকডাউন এক অনিশ্চিত আগামীর পূর্বাভাষ মাত্র, এর পরেই শুরু হবে মন্দা এবং মঙ্গাকাল। আর তখন থেকেই সংক্রমণ এবং মৃত্যুচিন্তার সঙ্গে অনাগত আগামীর উৎকণ্ঠা মিলেমিশে আমাদের ঘরবন্দী সময়কে পাথরের মতো ভারী করে দিল। অনেকের জন্যই এক একটা দিন ঠেলে সরানোও দুরূহ হয়ে দাঁড়াল। আর তখনই এই ‘ভাল্লাগে না’র নায়ে পাল চড়ল! এখন সেই স্বর ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। এই লেখা যখন লিখছি তখনও সংখ্যায় এবং বিষাদের ঘনঘটায় ভারাক্রান্ত হচ্ছে আরো অনেকে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা কিন্তু এরই আগাম আভাষ দিয়েছিলেন করোনাকালের শুরুতেই।
অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে লকডাউন খুলতে হবে পর্যায়ক্রমে। কোথাও কোথাও সীমিত পরিসরে ইতোমধ্যেই খুলে গেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যারা বাড়িতে বসে কাজের সুযোগ ভোগ করেই ভারাক্রান্ত তাদের আগামীতে চাকরিস্থলে যোগ দিতে হবে, অথবা হচ্ছে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমরা একটা নতুন পৃথিবীতে ঢুকছি। আমাদের জীবনযাপনে বিস্তর পরিবর্তন এরই মধ্যে ঘটেছে এবং এখন এই অণুজীবের সংক্রমণ ঠেকাতে কার্যকর প্রতিষেধক বাজারে না-আসা পর্যন্ত আমাদেরই স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজেকে নিরাপদ রাখতে হবে। এই সময়ে যদি নিজেদের অথবা পরিবারের কারো মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটে তবে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
মনের সঙ্গে আমাদের শরীর লেপ্টে থাকে। মন নাজুক হলেই আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে। তাছাড়া এই মন খারাপের নাগালেই ঘোরে বিষণ্নতা। মন খারাপ যদি বিষণ্ণতায় পালটায় তবে এর সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে ঢোকে নানারকম ক্ষতিকর আসক্তি, উঁকি দেয় আত্মহত্যার প্রবণতা এবং বাড়ে পারিবারিক কিংবা সামাজিক সহিংসতা। এই যে ক্রমশ ঢাল গড়িয়ে খাদের কাছে গড়িয়ে যাওয়া এটা কিন্তু থামানো যায়। এবং থামানো উচিত এখনই।
আগেই বলেছি এখনকার ‘ভাল্লাগে না’র উৎসের কথা। কিন্তু যারা ভালো লাগে না বলে নিজেকে দুখি করছেন তারা কিন্তু কারণ হিসেবে প্রথমেই বলেন, ‘এই ঘরবন্দী থাকা আর কত!’ এর পরেই অবশ্য পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো এই সব অনুযোগ, অভিযোগের ঝাঁঝ বাড়তে বাড়তে মূল সমস্যায় পৌঁছায় কেউ কেউ। যারা পৌঁছান তারা বেরোতে চান তবে এর মধ্যে অনেকেই আছেন এরই মধ্যেই যাদের কথা বলার ইচ্ছেও ‘ভাল্লাগে না’-তে আটকে গেছে। আমরা জানি ভিড়ে থেকেও ‘মানুষ একা!—মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ একা’, কবি আবুল হাসান বলেছিলেন। এই একাকিত্ব নিয়েই তো মানুষ হাজার বছর পার করে দিল, ‘মারি ও মড়ক’ উজিয়ে বিস্তার করল সংখ্যায় এবং টিকে রইল এখনো। কাজেই এই ঝঞ্ঝাও পার হবে।
ব্যাপার হলো আমরা সকলে কমবেশি একঘেয়েমির চক্করে পড়েছি। একঘেয়ে আর একঘেয়েমি সমার্থক মনে হলেও একঘেয়েমিতে একটা দীর্ঘসূত্রিতার ব্যাপার আছে। একঘেয়ে লাগাটা হালকা দুধের সরের মতো। একে জ্বাল দিয়ে দিয়ে আমরা নিজেরাই একঘেয়েমির ঘন সর তৈরি করেছি। এখন এই একঘেয়েমি থেকে বেরোবার পন্থা বার করতে হবে আমাদের নিজেদেরই।
লকডাউনে সবারই দিনের রুটিন পাল্টে গেছে। কারো কারো অবশ্য কোনো রুটিনই ছিল না কখনোই। অনেকে ভাবেন রুটিন আবার কী? সেও তো একঘেয়েমিই। আসলে তা নয় রুটিন মানে আগামীকালের জন্য কিছু অসমাপ্ত কাজ তুলে রাখা। আগামীকালের আশায় বাঁচা। সে আগামীকাল দেখা হবে কিনা না জানলেও জীবন টানার প্রেরণা আছে এই আশাতেই।
আমি যে রুটিনের কথা বলছি তার মানে লাগাতার ঘণ্টা ধরে কাজ নয় বরং কাজকে গড়িয়ে মেঝেতে জমতে না দেওয়ার চেষ্টা। এবং মনের স্থবিরতা কাটানোর একটা চেষ্টা। এই রুটিন হোক খানিক এলানো। নিজের দেখভালের বিষয়টাও থাকুক এই রুটিনে। থাকুক না-দেখা সিনেমা বা না-পড়া কোনো বই পড়ার ইচ্ছা। যারা একঘেয়েমির চক্করে এরই মধ্যে পা দিয়েছেন তাদের বলি আমার নিজের অভিজ্ঞতা আছে এই দুরন্ত ঘুর্ণিতে চুবানি খাওয়ার। আমার নিজের খাদে গড়ানো আটকেছি এই রুটিন-পথ্যে বহুবার। প্ল্যানারে বা নোটবুকে কিংবা একটুকরো কাগজে দিনের করণীয় বিষয়গুলো যখন লিখতে থাকি বিশ্বাস করুন সেই কিছু না-করার ইচ্ছেটার বিশ ভাগ উবে যায়। আমি আগামীকালের কথা ভাবতে শুরু করি এবং আমার বিষণ্ণতার কালো বেড়াল বুকে স্থির হয়ে চেপে বসতে পারে না। আপনিও চেষ্টা করুন এতে বন্দীদশার একঘেয়েমি খানিক কাটবেই। এছাড়া যারা বলেন, ‘কোথাও যেতে পারছি না, কারো সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। চার দেওয়ালের চৌহদ্দিতে আর কত?’ তাদের বলি, মানছি ঘরের বাইরে প্রিয় মানুষদের সঙ্গ পাচ্ছেন না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আজকের দিনে যোগাযোগ তো কোনো ব্যাপার নয়। ট্যাকনোলজির আশির্বাদে নিয়ম করে আমরা আমাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলতেই পারি। সুযোগ থাকলে অনলাইনে অনেকে একসঙ্গে আড্ডাও দিতে পারি। কেবল মুখোমুখি দেখা নয়, দূরে থেকেও ছুঁয়ে থাকা যায়। আপনার জীবনকে যারা নানাভাবে সহজ করেছেন, আশির্বাদ হয়ে পাশে ছিলেন কিংবা আছেন তাদের কৃতজ্ঞতা অথবা ভালোবাসা জানানোর কোনো মোক্ষম মুহূর্ত নেই। সুযোগ পেলেই বলুন, জানান; কেননা কারো মনে খুশির ঝিলিক দেওয়ার মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই। দুঃসময়ে আপনার এই ছোট প্রয়াস সেই মানুষটিকে আস্থা দেবে, মনে জোর দেবে এবং আপনার মনেও সেই ছুঁয়ে থাকার আনন্দ রোদ ছড়াবে।
এই সময়ে অস্থির হওয়া, দুশ্চিন্তা হওয়া কিন্তু খুব স্বাভাবিক। আসলে এমন পরিস্থিতি তো আমরা প্রায় সকলেই এতদিন বইয়ে পড়েছি। সিনেমায় দেখেছি। হাতে কলমে অভিজ্ঞতার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। একবার ভাবুন, আমরা কিন্তু এই কঠিন সময়ের অনেকটাই ধৈর্য ধরেই পার করছি। এবং জীবনের বড় কিছু পরিবর্তনও এরই মধ্যে প্রতিদিনের অভ্যাসে পাল্টেছি। এই যে রেস্তোরাঁয় যাচ্ছেন না, সহকারীর সাহায্য ছাড়াই নিজে রান্না করছেন কিংবা দোকানে অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা ছাড়া তিনমাস কাটিয়ে দিলেন এই অর্জনও কি কম? আপনি, আমি এবং অনেকেই জেনেছি অপ্রয়োজনীয় কত কী করি আমরা যা না করলেও জীবন দিব্যি চলে যায়!
এই সময়ে মৃত্যুচিন্তাও অস্বাভাবিক নয় কিন্তু এই ভাবনার গতি যেন জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ না করে সেই দিকেই লক্ষ রেখে জীবনের আশির্বাদগুলো ফিরে দেখাও জরুরি। এই পৃথিবীতে আসাটা যেমন আমাদের হাতে নেই যাওয়াটাও নয়। কেবল মাঝের জীবন-যাপনের সময়টাই আমাদের পাঠকাল। এই সময় ফুরোবার আগেই চলুন নিজের সৃজনশীল দিকটি খুঁজে বার করি যা আগে কখনো খেয়াল করিনি। একে তাকে চিনতে গিয়ে রাগে, ক্ষোভে অপমানে কত সময় নষ্ট করেছি! আজ করোনা বুঝিয়েছে আমির কিংবা ঘুঁটে-কুড়ানি যেই হোক বিধিই জানে কে রইবে আর কে যাবে। তাই অন্যের যা কিছু আমাদের বিরক্তি বাড়ায়, রাগ হয় কিংবা ঘৃণা, নিজের ভেতর থেকে সেই বদভ্যাসগুলো ঘষে-মেজে দূর করার ব্রত তো নিতে পারি যেন করোনা-উত্তর পৃথিবীকে আরেকটু বেশি মানবিক চোখে দেখার অভ্যেস হয়।
খুব বেশিদূর ভাবার অভ্যেসটাও অবশ্য এইসময় ক্লান্তি আনে এবং আমাদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে। তাই এক একটা দিনই ভালো কাটাবার চেষ্টা করি। এবং বিশ্বাস রাখি যে এই দুঃসময় কাটবে। আমি, আপনি একা নই সারা বিশ্ব সংগ্রাম করছে এই দুঃসময় পেরিয়ে স্বাভাবিক পৃথিবীকে ফিরিয়ে আনার। অন্তত এই একটি বিষয়ে উন্নত কিংবা তৃতীয়বিশ্ব সকলেই নিরলস খাটছে। অতএব সমাধান আসবেই। তবে আমাদের নিজের জায়গা থেকে নিজনিজ লড়াইটাও চালু রাখতে হবে, যার মধ্যে নিজেদের কর্মক্ষম এবং মনের স্বাস্থ্য ভালো রাখাটা অন্যতম।
একটাই জীবন আমাদের এবং একটাই পৃথিবী। তাই প্রত্যয় হোক, ‘মরার আগে মরব না’। চলুন ‘ভাল্লাগে না’র খোপ থেকে বেরিয়ে আজই জানালা খুলে ভোর দেখি, দেখি বিকেলের সূর্যাস্তও। এবং বুক ভরে শ্বাস টেনে জোর গলায় বলি : ভালো লাগছে সবই।