বৈশ্বিক রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘নারী নেতৃত্ব’
নেতৃত্ব, বিচক্ষণতা আর সাহসিকতায় ইতিহাসের আদিম পাতা থেকে শুরু করে বর্তমান মানচিত্রে স্বীয় মেধা বলে উজ্জ্বল হয়ে আছেন নারীরা। যুগে যুগে এসব নারীরা কর্মপ্রেরণা যুগিয়েছেন, হয়েছেন অনুপ্রেরণার গান। এমনকি নেতৃত্বগুণে বৈশ্বিক রাজনীতির চেহারা পাল্টে দিচ্ছেন নারীরা। তাদের হাত ধরেই লিঙ্গ সমতা আনার ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটেছে বিশ্বে। বিশ্বে জুড়ে নারী নেতৃত্বে উদাহারণ সৃষ্টিকারী এমন কয়েকজন নারীকে নিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বার্তা২৪.কম-এর আয়োজন।
ন্যান্সি পেলোসি
মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের নেতৃত্বে ইরাক যুদ্ধে সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচিত হয়েছিলেন ন্যান্সি পেলোসি। তৎকালীন সময়ে সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে কার্যকরী ভূমিকা রেখে প্রশংসিত হন তিনি। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ডেমোক্রেটিক দলের ন্যান্সি পেলোসি মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে স্পিকার হিসেবে মনোনীত হন। এ পদে আসীন ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি। ৭৮ বছর বয়সী ন্যান্সি পেলোসি ১৯৪০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত ডেমোক্র্যাট। হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ্স এর ৫২তম স্পিকার। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তিনি একমাত্র মহিলা প্রতিনিধি পরিষদে স্পিকার হিসেবে কাজ করেছেন।
সম্প্রতি অভিশংসন ইস্যুতে ট্রাম্পের নামের সঙ্গে অপর যে নামটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছে সেটি হল ন্যান্সি পেলোসি। ট্রাম্পের এহেন কর্মকাণ্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের অন্যান্য নেতারা যখন মুখে কুলুপ এটে বসেছিলেন তখন মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়ার কাজ শুরু করেন।
এর আগে ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের নেতৃত্বে ইরাক যুদ্ধে সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচিত হয়েছিলেন ন্যান্সি পেলোসি। তৎকালীন সময়ে সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে কার্যকরী ভূমিকা রেখে প্রশংসিত হন তিনি।
জেসিন্ডা আরডার্ন
জেসিন্ডা আরডার্ন (নিউজিল্যান্ড) সন্ত্রাস ও রক্তপাতের বিরুদ্ধে শান্তি, সমন্বয়ও ঐক্যের প্রতীক হয়েছিলেন পশ্চিমা শ্বের এই নেত্রী। তার পুরো নাম জাসিন্ডা কেট লরেলআরডার্ন। নিউজিল্যান্ডের হ্যামিলটন শহরে ১৯৮০ সালের ২৫ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। ২০১৭সালের ২৬ অক্টোবর থেকে নিউজিল্যান্ডের ৪০তম এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকরছেন তিনি। এছাড়াও তিনি ২০১৭ সালের ১ আগস্ট থেকে নিউজিল্যান্ড লেবার পার্টির সভাপতিরদায়িত্বও পালন করছেন।
২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডে বন্দুকধারীর গুলিতে৫১ জন প্রার্থনারত নিরীহ মানুষ নিহতের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যে ভূমিকা জেসিন্ডাআরডার্ন রেখেছেন তা সকলের নজরে আসে। এমন বিতর্কিত বিষয়ে জেসিন্ডার অবস্থান সকল রাষ্ট্রপ্রধানেরজন্য অনুকরণীয়। হামলার শিকার শরণার্থী মুসলিমদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন তিনি। তাদেরজড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়েছেন। এমনকি এই হামলাকে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড হিসেবে আখ্যাদিয়েছেন তিনি। সামরিক যুদ্ধাস্ত্র অটোমেটিক সাব-মেশিনগানের বেসামরিক ব্যবহারকে তিনি নিষিদ্ধ করেছেন। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ যে বিশ্ব সমস্যা এবং একে ধর্মের নামে না ডেকেঅপরাধের আলোকে দেখার শিক্ষা দিয়েছেন তিনি। পশ্চিমা জগতে সর্বধর্মের মিলন ও পারস্পরিকসৌহার্দ্যের উজ্জ্বল উপমা তিনি স্থাপন করেছেন সন্ত্রাস ও রক্তপাতের কঠিন পরিস্থিতিতে।
থেরেসা মে
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে আলোচিত নাম থেরেসা মে। ব্রিটেনের রাজনীতি যখন ব্রেক্সিট ইস্যু নিয়ে নাজেহাল সে সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। ব্রেক্সিট কার্যকরে সফল না হলেও সংকটকালীন অবস্থায় হাল ধরেন থেরেসা মে।
ব্রেক্সিট ইস্যুতে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে মূলত আলোচনায় আসেন তিনি। ব্রেক্সিট ইস্যুতে দলের সমর্থন হারিয়ে নাকাল হয়ে চলতি বছর জুনে সিদ্ধান্ত নেন ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াবার।
ব্রেক্সিটের জের ধরে ডেভিড ক্যামেরুনের পর দ্বিতীয় নেতা হিসেবে আলোচনায় আসেন থেরেসা মে। থেরেসা মে ব্রেক্সিটকে জগাখিচুড়ি পাকিয়েছেবলে মন্তব্যও করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ব্রিটেনের দ্বিতীয় নারী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই গত তিন বছর ধরে ব্রেক্সিট নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে পড়েন মে। এই নিয়ে দেশটির পার্লামেন্টে বেশ কয়েক বার ভোটও হয়েছে। এতে কয়েকবার মে’র পক্ষে রায় গেলেও পার্লামেন্টে নিয়মিত তোপের মুখে ছিলেন তিনি। তবে এসব মোকাবিলা করে নিজের দায়িত্বে অবিচল থেকেছেন থেরেসা মে।
অ্যাঞ্জেলা মার্কেল
অ্যাঞ্জেলা মার্কেল জার্মানির বর্তমান চ্যন্সেলর। জার্মান চ্যান্সেলর মার্কেলই ইউরোপিয় ইউনিয়নের কার্যত নেতা। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারীদের তালিকার শীর্ষে রয়েছেন মার্কেল। একইসঙ্গে তিনি উন্নত দেশগুলোর সংগঠন জি-৭ এর অন্যতম সিনিয়র নেতা। অ্যাঞ্জেলা মার্কেল ১৯৫৪ সালে জার্মানির হামবুর্গ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ২০১৫ সালে টাইম ম্যাগাজিন কর্তৃক পার্সন অবদ্য ইয়ার নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। ইউরোপের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটমোকাবেলা এবং ইউরোপের অভিবাসী ও শরণার্থী সংকট সমাধানে তিনি যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছেন।
সান্না মারিন
সানা মিরেলা মারিন (জন্ম ১৬ নভেম্বর ১৯৮৫) হলেন একজন ফিনীয় রাজনীতিবিদ। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলের সদস্য মারিন ২০১৫ সাল থেকে ফিনল্যান্ডের সংসদে অধিষ্ঠিত এবং ২০১৯ সালের ৬ই জুন থেকে দেশটির পরিবহন ও যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আন্টি রিনে তার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ালে ফিনল্যান্ডের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ২০১৯ সালে নতুন প্রধানমন্ত্রী পদ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত করেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ৩৪ বছর বয়সী সান্না বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ ও ফিনল্যান্ডের তৃতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান।
উরসুলা ভন ডের লিয়েন
উরসুলা ভন ডের লিয়েনের জন্ম ১৯৫৮ সালে। ২০১৯ সালে ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হন। জার্মান রাজনীতিবিদ উরসুলা ২০০৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত জার্মানির ফেডারেল সরকারের (অ্যাঞ্জেলা মার্কেল) মন্ত্রিসভায় সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা ব্রাসেলস সিটিতে। তার বাবা আর্নস্ট অ্যালব্রেক্ট ছিলেন প্রথম ইউরোপীয় বেসামরিক কর্মচারীদের একজন। ১৯৭১ সালে রাজনীতিতে আসেন তার বাবা। তখন আর্নস্ট অ্যালব্রেক্ট সপরিবারে জার্মানিতে চলে আসেন। জার্মানির লোইয়ার স্যাক্সানি রাজ্যের মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন উরসুলার বাবা। ১৯৮৭ সালে চিকিৎসক হিসেবে স্নাতক শেষ করেন উরসুলা। পরবর্তীতে মহিলাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মনোনিবেশ করেন তিনি। ১৯৯০ সালের শেষ দিকে স্থানীয় রাজনীতিতে যোগ দেন তিনি। এরপরই উরসুলার রাজনীতিতে পথচলা। ২০০৩ সালে মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব প্রাপ্ত হন উরসুলা। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্যত আছেন উরসুলা।
রুথ বেডার গিন্সবার্গ
মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের সহযোগী বিচারপতি রুথ বেডার গিন্সবার্গ। ১৯৩৩ সালে নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে তার জন্ম। একজন ইহুদি অভিবাসীর মেয়ে তিনি। ১৭ বছর বয়সে মাকে হারিয়েছেন ক্যান্সারে। ১৯৫৪ সালে কর্নওয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করেন।
১৯৫৬ সালে হার্ভাড ল স্কুলে মাত্র ৯ জন ছাত্রী ভর্তি হয়েছিলেন। আর রুথ গিন্সবার্গ ছিলেন তাদের একজন। ক্লাসের সেরা ছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র একজন নারী, ইহুদি ও মা হওয়ায় তাকে চাকরি পেতে বেশ বেগ পেতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে সবচেয়ে দীর্ঘদিন যাবত বিচারকার্য পরিচালনা করছেন গিন্সবার্গ।
এখানেই শেষ নয় গিন্সবার্গের জীবন নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে চলচ্চিত্র। এর আগে তথ্যচিত্রও তৈরি করা হয়। এমনকি তাকে নিয়ে লেখা বই যুক্তরাষ্ট্রে 'বেস্ট সেলার' বইয়ের তালিকায় ছিল।