নারীদেহ শিল্প কেবল!

  • ফারিসা মাহমুদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

ফারিসা মাহমুদ একজন চিত্রশিল্পী। আঁকার বিষয়বস্তুতে প্রাধান্য পায় গ্রামবাংলার পটভূমি, বিচিত্র পেশাজীবীর জীবনযাত্রা। নিয়মিত লেখালেখি করেন প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকায়। তাঁর প্রকাশিত তিনটি উপন্যাস ‘চন্দ্রাহত হাসন’, ‘দ্বিতীয় মুখ’, ‘জল রঙ ও চড়ুই পাখি’। চিত্রকলার পাশাপাশি সমাজের নানা পেশার নারীদের অধিকার লড়াইয়ে কাজ করে যাচ্ছেন


শুধুমাত্র নারী হয়ে জন্ম নিয়েছে বলেই নারীর নিজস্ব একটা যুদ্ধ তৈরি হয়ে যায়। দরিদ্র ঘরে অথবা ধনীর ঘর, যে ঘরেই নারীর জন্ম হোক না কেন—এই যুদ্ধটা তাকে করতেই হয়। প্রতিটা ইচ্ছের জন্যে, প্রতিটা সিদ্ধান্তের জন্যে তাকে জীবনভর যুদ্ধ করে যেতে হবে। যুদ্ধটা কতভাবে আর কতদিন চলবে, এর উত্তরটা নারীর জীবন থেকে বললে—এর শেষ নেই। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজটা যতদিন থাকবে, পৃথিবীর সব নারীই এক একটা সংগ্রামের গল্প। সমাজ ও রাষ্ট্রে যতদিন পুরুষতান্ত্রিক চেহারাটা যতদিন থাকবে ততদিন এই লড়াইয়ের শেষ নেই।

বিজ্ঞাপন

এই গল্পের শুরু তখন থেকে, যখন মানুষ আদিম যুগ সাম্যবাদী সমাজ ভেঙে আধিপত্যবাদী একটা বৈষম্যমূলক সমাজ তৈরি করল। মানুষ আর শুধু মানুষ থাকল না। সে দাস হলো, সে মালিক হলো। সে নারী হলো, সে পুরুষ হলো। এই বিভেদমূলক ব্যবস্থাটাই পুরুষতন্ত্র। সে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা হয় না। শ্রেণী হিসেবে দেখা হয়। ছোট-বড় করে দেখা হয়। প্রভূ-ভৃত্য হিসেবে দেখা হয়। একদল মানুষের ওপর আরেকদল মানুষের আধিপত্য তৈরি এবং তাকে বজায় রাখার জন্য কত ধরনের আইন তৈরি করে। জন্মগতভাবেই আমি উচ্চ তুমি অধম এই মূল্যবোধ তৈরি করে। মানুষ হিসেবে প্রকৃতিগত যে অধিকার—তাকে অস্বীকার করে, বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা তৈরি করে। এটাই পুরুষতন্ত্র। এর প্রথম আর সবচেয়ে বড় শিকার হয় নারীরা। পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ এই নারী মানুষ না। মানুষ শুধু পুরুষ। নারী হলো সেই পুরষের অধিকারে একটা আধা মানুষ। পুরুষতন্ত্রের শিকার বেশিরভাগ পুরুষ। ঘরের বাইরে যে পুরুষতন্ত্রের শিকার হলেও ঘরের মধ্যে সে কর্তা। মালিক। নারী তার অধিকারভুক্ত।

নারীকে ঘরের বাঁধা অতিক্রম করে বাইরে আসলেও নারীকে নারী হিসেবেই দেখা হচ্ছে। পুরুষের পাশে এসে একই কাজ করলেও, শুধু নারী বলেই সে তার প্রাপ্যটুকু পাচ্ছে না। প্রতিটা পেশায়, প্রতিটা ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার শুধু নারী। কেবল আমাদের দেশেই যদি দেখেন, কোন পেশায় নারী পাবেন না? কোন কাজটায় নারী পুরুষের চেয়ে কম দক্ষ বলবেন আপনি? অথচ সমতা বা সমমার্যাদা কি আমরা অর্জন করতে পেরেছি? বা খুব শীঘ্রই তা পাব এমন আশা কি করতে পারি?

বিজ্ঞাপন

প্রত্যেক নারীরই এই নিয়ে একটা গল্প আছে। সব ক্ষেত্রেই গল্পটা আলাদা হলেও আসলে একই। সংগ্রামের গল্প। আমি একজন চিত্রশিল্পী বা আর্টিস্ট। আমি আমার কাজের ক্ষেত্রে নারীদের সংগ্রামটা নিয়ে কথাটা বলি। সংগ্রাম হচ্ছে সমাজ থেকে একজন মানুষের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা সামনে আসে সেগুলার মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়া। যুদ্ধ হচ্ছে এসব প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে মাথা উচু করে দাঁড়ানো, নিজের পরিচয় তৈরি করা। কেবল অস্ত্র হাতে যুদ্ধই তো যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধটা চিত্রশিল্পে কেমন?

আপনি কি আমাদের দেশের পাঁচজন নারী চিত্রশিল্পীর নাম বলতে পারবেন?

হয়তো আপনি আর্ট কালচার বিষয়ে আগ্রহ রাখেন তাই হয়তো আপনি পারবেন। ভাবেন তো এমনি সাধারণ কোনো মানুষ কি বলতে পারবে আমাদের দেশের পাঁচজন নারী আর্টিস্টের নাম? যেমন বলতে পারবে জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খাঁন, সাহাবুদ্দিন আহমেদ এদের নাম, তেমন? জানি পারবেন না। কেন? নারী কাঁথায় নকশা করে, নারী ঘর সাজায়, নারী পিঠেয় নকশা করে, নারী বারো হাতের একটা কাপড় গুছিয়ে সুন্দর করে শাড়ি পরে, নারী হাতে মেহেদী দিয়ে নকশা করে, আরো কত কত শিল্পকে নারী সহজাতভাবেই ধারণ করে। আবার পুরুষ শিল্পীর কাজের অন্যতম বিষয় এবং প্রেরণার জায়গায়ও নারীর ভূমিকা অস্বীকার্য। সুন্দর আর নারী তো এপিঠ ওপিঠ তবে নারী আর্টিস্ট হয়ে উঠতে পারে না কেন? ভেবেছেন কখনো? অনেক নারীই তো এই দেশের প্রথম আর্ট কলেজে শুরু থেকেই পড়ালেখা করে বের হয়েছেন। বর্তমানেও প্রতি বছর হাজার হাজার নারী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্ট নিয়ে পড়া লেখা করে বের হচ্ছে। অনেকেই নিয়মিতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন এবং ভালো কাজও করছেন কিন্তু তবু আমরা সহজভাবে পাঁচজন নারী আর্টিস্টের নাম বলতে পারব না।

এটা দুঃখজনক তো বটেই। আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একটা মেয়ে আর্টিস্ট হতে হতে যে লম্বা একটা যুদ্ধ করে আসেন সেই যুদ্ধ কতটা কঠিন ভাবতে পারেন? আর্টিস্ট হওয়ার ইচ্ছেটা করার সঙ্গে সঙ্গেই তার যুদ্ধ শুরু হয়।

সিমির কথা মনে আছে আপনাদের?

বেশ অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেছে সিমির চলে যাওয়ার। এতদিনে অনেকেই হয়তো ওকে ভুলে গেছেন। মনে রাখার মতো একটা শিল্পকর্মও তো সে করে যেতে পারেনি। নারায়ণগঞ্জ চারুকলার ছাত্রী ছিল। কখনো কখনো কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে তার দেরি হতো, একটু রাত হতো। পাড়ার ছেলেরা বাড়ি ফেরার পথে ওকে উত্যক্ত করত। দিনের পরে দিন। বেচারি সিমিকে সাহায্য করতে, মানসিকভাবে ওকে শক্তি দিতে কেউ এগিয়ে আসেনি। কেউ বলেনি, মেয়ে ভয় নেই তোমার! সিমি তো শিল্পী ছিল, ওর মন তো সুন্দর দেখত, নিতে পারেনি মেয়েটা সমাজের এই কদর্য রূপ। আত্মহত্যা করেছিল সিমি। সিমি তো আত্মহত্যা করে সব কিছুর উর্ধ্বে চলে গেছে। কিন্তু চারুকলায় পড়েছে অথবা ছবি আঁকে এমন কয়জন মেয়ে আছে যাদের এমন মানসিক যাতনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি! চারুকলায় পড়া মেয়ে মানেই মাল, শিল্পচর্চা করা মেয়ে মানেই সহজে শোওয়া যাবে, আর্টিস্ট মানেই বহু পুরুষের সাথে যায়—এসব মানসিকতার বাইরে কজন বাঙালি আছে?

শিল্পী হতে হলে সবার আগে যে জিনিসটা প্রয়োজন তা হলো স্বাধীনতা। জীবন যাপনের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা ছাড়া কারো মননেই কোনো সৃষ্টিশীল চিন্তা আসা সম্ভব নয়। আর্থিকভাবে চরম কষ্টে থাকলেও কখনো শিল্পীর অভিযোগ শুনবেন না। কষ্টের রঙকেও উপভোগ্য করে তুলতে পারে একজন শিল্পী। জীবনের নানা দিক এবং নানা রূপকে দেখাই শিল্পীর কাজ। যেখানে শিল্পীর জন্যে স্বাধীন জীবন যাপন করা একজন পুরুষের জন্যেই যথেষ্ট কঠিন যেখানে নারীর জন্যে এই আশা করা সম্ভব নয়। আপনারা হয়তো ভাবছেন আমাদের দেশ তো স্বাধীন তবে শিল্পীর জন্যে আবার কেমন স্বাধীনতা দরকার? একদম আক্ষরিক অর্থেই স্বাধীনতা, চিন্তা যতদূর যায় ততটা দূরে যাবার স্বাধীনতা।

সেটা যদি সমাজের চোখে চরম সেচ্ছাচারিতাও হয় তবু সেই স্বাধীনতা শিল্পীর জন্যে জরুরি। সীমানা ছিঁড়েফুঁড়ে, ভেঙেচুরে না দেখতে পারলে শিল্পী হওয়া সম্ভব নয়। এখন আপনি ভাবেন তো একজন নারীর পক্ষে কি সেই স্বাধীন জীবন যাপন করা সম্ভব? শিল্পী জীবনের ছবি আঁকে। আঁকাটা তার ভাষা। যৌনতা জীবনের একটা অপরিহার্য বিষয়। যৌনতা বাদ দিয়ে জীবন নয়। অথচ আমাদের দেশের নারী আর্টিস্টদের কাজে এই অপরিহার্য বিষয়টা আনা অলিখিত নিষেধ। কে দিয়েছে এক সীমা রেখা টেনে? একজন আর্টিস্ট সে নারী হোক বা পুরুষ শিক্ষানবিশ অবস্থায় ফিগার স্টাডি বাধ্যতামূলক। সে তখন থাকে একজন মানুষ, নারী পুরুষের উর্ধ্বে। মানুষের দৈহিক আকৃতি এবং এর ভাষাটা তখন সে চর্চা করে। মানব দেহের একটা সৌন্দর্য আছে তা সেটা দীর্ঘ, খাটো, ফর্সা, কালো, বাঁকা ত্যাড়া যেমনই হোক। এই সৌন্দর্য কেবল একজন শিল্পীর চোখেই দেখা সম্ভব। এবং শিক্ষানবিশ অবস্থায় সে থাকে সমমনা অন্য শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের নিয়ে একটা পরিবেশে। সেখানে ও জানে মানুষের শরীর কেবল একটা মাধ্যম। মানুষের অনুভূতি থাকে তার চিন্তায়, শরীরে নয়। যখন শিক্ষালাভের পরে একজন নারী জীবিকা ও জীবিনের সামনে এসে দাঁড়ায় তখন সে দেখে তার জগৎ ভিন্ন। ওর চিন্তার সাথে ওর শিক্ষার সাথে সমাজ মিলছে না। একজন পুরুষ অনায়াসে ন্যুডিজম নিয়ে কাজ করতে পারে কিন্তু নারীর জন্যে সেটা প্রায় অসম্ভব। তাকে আঁকতে হবে নৈস্বর্গিক প্রকৃতি। নগ্নতা শরীর ও প্রকৃতির অংশ হলেও তাকে এইদিকটা একদম কপাট বন্ধ করে রাখতে হবে। তো জীবনের একটা অংশ কপাটের ওইপারে রেখে নারীকে কাজ করতে হলে সে শিল্পী হবে কী করে?

তবু পাহাড় সমান বাঁধা ঠেলতে ঠেলতে আমাদের দেশেও কিছু কঠিন নারী ছবি এঁকে যাচ্ছেন। সীমাবদ্ধতার জালে জড়িয়েও নিজেদের ভাষাটা তুলে ধরছেন সমাজের সামনে। আমি এই সময়ের কয়েকজন নারী শিল্পীদের সাক্ষাৎকার পড়েছি। তাদের মধ্যে প্রায় সবাই বলেছেন, আমি নারীবাদী না। তবে আমি আমার কাজে নারীদের সংগ্রামটাকে তুলে আনি। আসলে শিল্পীর পক্ষে নারীবাদী হওয়া কতটা সহজ আমি জানি না কারণ একজন শিল্পী তো কখনো নারী পুরুষ আলাদা করে দেখেই না। সেই চর্চাই শিল্পীর কাজ না। নারী শিল্পী বা পুরুষ শিল্পী আমরা মানে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভাষা। শিল্পীর কোনো জেন্ডার হয় না। যখন যে দেশে, যে সমাজে শিল্পীর জেন্ডার নির্ণয় হয় সেই দেশে আর নারীরা শিল্পী হবে কী করে?

এভাবেই একজন নারী শিল্পী হতে গিয়ে পুরুষতন্ত্রের শিকার হয়ে পড়েন। যাকে ছিন্ন না করে আর তার শিল্পী হয়ে ওঠা হয়ে ওঠে না।