বর্ণময় জীবনের কর্মময় নয়টি দশক

  • কনক জ্যোতি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

রমিলা থাপার

রমিলা থাপার

একজন আধুনিক, ঋদ্ধ ও মননশীল মানুষের যাবতীয় মহৎ বৃত্তিতে কয়েকদিন আগে তিনি স্পর্শ করেছেন বর্ণময় জীবনের কর্মময় নয়টি দশক। দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশ তো বটেই, তাবৎ বিশ্বের ইতিহাসচর্চায় এই নারী এক অনন্য উদাহরণ। রমিলা থাপার নামটি উচ্চারণ করলেই অনুভব করা যায় তাঁর অ্যাকাডেমিক উচ্চতা। একদা যিনি দম্ভ ও কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, 'ইতিহাস মূলত কোনো কমিটি গঠনের মাধ্যমে রচিত হয় না। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ নিজেই তা রচনা করেন।'

১৯৩১ সালের ৩০ নভেম্বর উত্তর ভারতের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শহর লখনৌতে জন্মগ্রহণকারী রমিলা থাপার ৯০ বছরেও সচল আর কর্মপ্রবর্তনার দৃষ্টান্ত। বিশিষ্ট ভারতীয় ইতিহাসবেত্তা এবং দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় এমিরিটাস অধ্যাপক তিনি। তাঁর প্রধান চর্চার বিষয় প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস—প্রকাশিত বেশ কয়েকটি বইয়ের মধ্যে ‘অ্যা হিস্টোরি অফ ইন্ডিয়া’ বহুল আলোচিত—দু’বার ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মভূষণে ভূষিত হয়েছেন, কিন্তু দু’বারই তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন। এমন সাহসিতার নমুনা বিরল।

বিজ্ঞাপন

রমিলা সেনা বিভাগের চিকিৎসক দয়া রাম থাপারের কন্যা। মায়ের নাম কৌশল্যা। তিনিও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর চিকিৎসা সেবা বিভাগের মহাপরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। প্রয়াত সাংবাদিক রমেশ থাপার ছিলেন তাঁর সহোদর ভাই এবং বিশিষ্ট নিউজ প্রেজেন্টার করণ থাপার তাঁর সম্পর্কিত ভাই।

রমিলার ছোটবেলায় তাঁর বাবাকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সামরিক কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল, তাই তিনি ভারতের বিভিন্ন শহরের বিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন শ্রেণিতে পড়াশোনা করেছেন। পরে তিনি পুনের ওয়াদিয়া কলেজের ইন্টারমিডিয়েট অব আর্টসে পড়েন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক হবার পরে, থাপার দ্বিতীয়বার সাম্মানিক স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ভারতীয় ইতিহাসে। এরপর তিনি ১৯৫৮ সালে স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল এবং আফ্রিকান স্টাডিজ, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ. এল. বাশামের অধীনে ভারতীয় ইতিহাসে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। বাশাম হলেন সেই ধ্রুপদী ঐতিহাসিক, যিনি 'দ্য ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া' নামের কালজয়ী গ্রন্থ রচনা করেছেন।

রমিলা ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে রীডার ছিলেন এবং ১৯৬৩ থেকে ১৯৭০ সাল অবধি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই একই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। পরে, তিনি নতুন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের অধ্যাপক হিসাবে কাজ করেছিলেন, যেখানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত হওয়ার পর এখন  এমিরিটাস অধ্যাপক।

থাপারের প্রকাশিত প্রধান কাজগুলো হল অশোক এবং মৌর্যসাম্রাজ্যের পতন, প্রাচীন ভারতীয় সামাজিক ইতিহাস: কিছু ব্যাখ্যা, আদি ভারতীয় ইতিহাসের সাম্প্রতিক দৃষ্টিভঙ্গি (সম্পাদক), ভারতের ইতিহাস প্রথম খণ্ড এবং আদি ভারত: আদি থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর প্রথম লেখা, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অশোক এবং মৌর্যসাম্রাজ্যের পতন ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয়। থাপার অশোকের ধম্ম নীতিটি, বিভিন্ন জাতি ও ভিন্ন সংস্কৃতির একটি সাম্রাজ্য একত্র রাখার উদ্দেশ্যে, একটি অসাম্প্রদায়িক নাগরিক নীতি হিসাবে সংস্থাপিত বলে মনে করেছেন। তিনি মনে করেছেন মৌর্য্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য এর কেন্দ্রীয় প্রশাসন দায়ী। এর জন্য ব্যতিক্রমী দক্ষতার শাসকদের ভালভাবে কাজ করার দরকার ছিল।

থাপারের ভারতের ইতিহাস-এর প্রথম খণ্ডটি পাঠকদের জনপ্রিয়তার কথা ভেবে রচিত এবং এটি পূর্ববর্তী ইতিহাস থেকে শুরু করে ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপীয়দের আগমন পর্যন্ত দেখিয়েছে। তাঁর প্রাচীন ভারতীয় সামাজিক ইতিহাস গ্রন্থটি প্রথম দিকের ইতিহাস থেকে শুরু করে প্রথম সহস্রাব্দের শেষের সময়কাল নিয়ে একটি কাজ, এটিতে হিন্দু ও বৌদ্ধ আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার তুলনামূলক অধ্যয়ন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, এবং বর্ণবাদ পদ্ধতিতে সামাজিক প্রতিবাদ এবং সামাজিক গতিশীলতায় বৌদ্ধধর্মের ভূমিকা পরীক্ষা করেছে। বংশ থেকে রাজ্য বইতে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকায় রাজ্য গঠনের বিশ্লেষণ করা হয়েছে, লোহার ব্যবহার এবং কৃষিতে লাঙ্গলের ব্যবহার আসার ফলে যে পরিবর্তন, যাজকবাদী এবং গতিময় বংশ ভিত্তিক সমাজ থেকে শুরু করে বসতি করে কৃষকের জমি নেওয়া, পুঁজিভবন এবং বর্ধিত নগরায়ন এই প্রক্রিয়াগুলির সন্ধান করা হয়েছে।

অতি সম্প্রতি তিনি 'ভারতের পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল' প্রসঙ্গে গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে উগ্রতার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। ইতিহাসকে শক্তি ও ক্ষমতার প্রভাব বলয়ের বাইরে বস্তুনিষ্ঠ-নৈর্ব্যক্তিকভাবে বিশ্লেষণের সাহসী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে তিনি রাষ্ট্রীয় সম্মাননা, পদক ও পৃষ্ঠপোকতা প্রত্যাখান করে মানুষ, সমাজ ও শিক্ষাঙ্গনে প্রভূত সম্মান লাভ করেছেন।