আজাদ ফাউন্ডেশনের ‘উইমেন উইথ হুইলস’
দিল্লির অলাভজনক সংস্থা ‘আজাদ ফাউন্ডেশন’ নিয়ে এসেছে ‘উইমেন উইথ হুইলস’। ভাড়া গাড়ির জন্য কল করলে 'ড্রাইভার দাদা'র মতো ছুটে আসছেন 'ড্রাইভার দিদি'।
সচরাচর মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন থেকে ক্যাব বুক করা হলে ব্যস্ততা নিয়ে আরোহী ড্রাইভারের নাম্বারে ফোন করে প্রথমেই জানতে চান, 'দাদা, কোথায়, কতদূরে আছেন?' হ্যাঁ, এই প্রশ্ন শুনতে বা করতেই মহানগরের নাগরিকগণ অভ্যস্ত। কারণ ক্যাব ড্রাইভাররা মূলত পুরুষই হন। অন্তত দক্ষিণ এশিয়ার নগর কাঠামোর যোগাযোগ ব্যবস্থায় এমনই দস্তুর।
তবে পরিবহণ সেবায় চিরচেনা ড্রাইভার দাদা বা ভাইদের এই লিঙ্গপরিসরের বাইরে গিয়েও যে চিন্তা করা যায়, সেটাই শেখাচ্ছে দিল্লির অলাভজনক সংস্থা ‘আজাদ ফাউন্ডেশন’। শিক্ষা, সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মহিলাদের স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি সমাজের প্রচলিত মানসিকতাতেও বদল আনছে এই বেসরকারি উদ্যোগ। এতদিন যে ধরনের কাজ শুধুই পুরুষদের বলে পরিচিত ছিল, এবার মহিলারাও সমানভাবে এগিয়ে আসছেন সেই কাজের অংশীদার হয়ে। 'আজাদ' বা 'স্বাধীন' এই শব্দের মর্মার্থ ব্যবহারিকভাবেও প্রয়োগ করতে পারছেন শহুরে নারীরা।
২০১৩ সালে প্রথম ‘উইমেন উইথ হুইলস’ উদ্যোগ নিয়ে হাজির হয় 'আজাদ ফাউন্ডেশন'। এর আগে বস্তি অঞ্চলের ও পিছিয়ে পড়া এলাকার মহিলাদের নিয়ে নানা ধরণের সচেতনতামূলক উদ্যোগ নিয়েছিল এই সংস্থা। তবে মহিলা-পরিচালিত ক্যাব-প্রজেক্ট নিয়ে এক অন্য রকমের দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে 'আজাদ ফাউন্ডেশন'।
'আজাদ ফাউন্ডেশন' এই উদ্যোগ শুরুর আগে প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা দিল্লির বাড়ি, পাড়া ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মহিলাদের আর্থসামাজিক অবস্থা সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করেছে। তাতে ফাউন্ডেশন দেখতে পেয়েছে যে, ভারতের সুরম্য রাজধানী শহরটি প্রাচীনত্ব ও ঐতিহাসিক ব্যাপ্তি সত্ত্বেও নারী-বান্ধব নয়। বিশেষত, নিরাপত্তা ও আর্থিক দিল থেকে নারীদের অবস্থান তলানিতে।
'আজাদ ফাউন্ডেশন'-এর প্রাক-প্রজেক্ট গবেষণায় দিল্লিতে আজও এক বড়ো অংশের মহিলারাই প্রতিনিয়ত পুরুষদের নির্যাতনের স্বীকার হন বলে প্রকাশ পায়। কোথাও কোথাও তাদের স্বামী এখনও রাতে মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে মারধোর করে স্ত্রীদের। আর এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সামর্থ্যও পশ্চাৎপদ নারীদের নেই।
কারণ, এই পুরুষতান্ত্রিকতার দাপট ও আগ্রাসনকেই উত্তর ভারতের প্রথাগত সমাজ স্বাভাবিক ও কাম্য মনে করে। অথচ, এই নির্যাতন ও অসাম্যের জন্য দায়ী হলো নির্ভরশীলতা। কারণ দিল্লির অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সিংহভাগ নারী পুরুষের উপার্যনের উপরেই নির্ভরশীল। তাই নারীর সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য সর্বাগ্রে তাদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো দরকার বলে 'আজাদ ফাউন্ডেশন'-এর গবেষণা প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়। যার ভিত্তিতে উদ্ভব হয় ‘উইমেন উইথ হুইলস’।
'আজাদ ফাউন্ডেশন'-এর ‘উইমেন উইথ হুইলস’ সঙ্গে যুক্ত ক্যাব ড্রাইভার মহিলাদের কেউ কেউ এমনও আছেন, যারা কোনোদিন স্কুলেই যাননি। কেউ কম বয়সে বিয়ের পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছেন। অবশ্য কয়েকজন আছেন যারা কলেজের গণ্ডি পার করেছেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এসব নারীরাই চমৎকার দক্ষতা ও সফলতা দেখিয়েছেন।
নানা বয়স ও শিক্ষার নারীকে একসঙ্গে নিয়েই শুরু হয় এই ‘উইমেন উইথ হুইলস’ উদ্যোগ। প্রথম প্রথম অবশ্য বাণিজ্যিক পরিবহণ সংস্থাগুলো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। তাদের মধ্যেও সংশয় কাজ করেছে। যদি এর ফলে ভারতের মতো দেশে ব্যবসা কমে যায়? তবে বারবার আবেদন জানানোর ফলে শেষ পর্যন্ত সাড়া মিলেছে। ক্রমশ দিল্লি থেকে সংস্থার কাজের পরিসর বিস্তৃত হয়েছে পাশের রাজ্য জয়পুর, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাতেও। আর কিছুদিনের মধ্যেই চেন্নাই শহরেও আলাদা একটি ইউনিট খুলতে চলেছেন তারা।
সব মিলিয়ে এখন ১ হাজারের বেশি মহিলা যুক্ত এই উদ্যোগের সঙ্গে। করোনাকালে লকডাউনে অবশ্য অনেকেই আর্থিক দুরাবস্থার মধ্যে পড়েছেন। কিন্তু 'আজাদ ফাউন্ডেশন' তাদের হাত ছেড়ে দেননি। এই মুহূর্তে একজন সদস্যার হারিয়ে যাওয়াও যে লিঙ্গসাম্যের লড়াইতে পরাজয় স্বীকার করে নেওয়ার সামিল, এমন বিশ্বাস থেকে 'আজাদ ফাউন্ডেশন' সব নারীকে একাট্টা করে লড়ছে নারীদের প্রকৃত 'আজাদি'র জন্য।