ঠাকুরবাড়ির তেজস্বিনী
উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ শুরুর অন্যতম পীঠস্থান উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। নবজাগৃত বাংলায় সুরুচি,নন্দনতত্ত্ব ও সৌন্দর্য্যবোধের অনেকটাই ঠাকুরবাড়ির অবদান।
দ্বারকানাথের আমল থেকেই এ বাড়িতে নিজস্ব একটি সংস্কার গড়ে ওঠে। এই নব উত্তরণের পর্বে ঠাকুরবাড়ির মেযেরাও অন্দরমহলের আবছা পর্দার আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রাখেন নি। নবযুগের ভিত গড়ার কাজে তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হাত লাগিয়েছেন।
প্রথমদিকে অবশ্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। তবে এদের অনেকেই শিল্প ও সাহিত্যে বিশেষ ভূমিকা রেখে গেছেন। নিজের চলার মসৃণ পথ তারা পাননি, পথ তৈরি করে নিতে হয়েছিল তাদের। তারা তৎকালীন নারীদের জন্য উন্মুক্ত করেছেন সম্ভাবনার পথ। মূলত ঔপনিবেশিক শাসনে বাঙালি নারীর এগিয়ে যাওয়ার আদি প্রেরণা ও শক্তি সঞ্চারিত হয়েছিল ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের কাছ থেকেই। চলুন জেনে আসি ঠাকুরবাড়ির তেজস্বিনীদের সম্পর্কে-
অলকাসুন্দরী
ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের মধ্যে যার কথা সবার আগে বলা প্রয়োজন, তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথের প্রপিতামহী অলকাসুন্দরী। তিনি ছিলেন দ্বারকানাথের মা ও রামলোচনের স্ত্রী। ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য মেয়েদের মধ্যে তিনিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন সে যুগে। দ্বারকানাথের বয়স যখন মাত্র ১৩ তখন রামলোচন দেহত্যাগ করেন। উইলে নাবালক দ্বারকানাথকে রামলোচন নির্দেশ করেছিলেন, সে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগ অব্দি প্রযোজনীয় যাবতীয় দস্তখত মা অলকাসুন্দরীই করবেন। তাছাড়া প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পরও যাবতীয় আমদানির তহবিল যেন অলকাসুন্দরীর কাছেই রাখা হয়। এ নির্দেশই জানান দেয়, হিসাব নিকাশ রাখা ও সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে অলকাসুন্দরীর শক্ত অবস্থানের কথা। তিনি শক্ত হাতে সংসার ও স্বামীর কাজের হাল ধরেছিলেন বৈকি! তিনি ধর্মে যেমন বিশ্বাসী ছিলেন, তেমনি তার স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতাও ছিল অসীম। মৃত্যুর সময়েও তিনি তার স্বাধীন চিন্তা ব্যক্ত করেছিলেন। গঙ্গায় অন্তর্জলি যাত্রায় সম্মতি দেননি। যদিও ওই যুগে অলকাসুন্দরীর এ ইচ্ছায় স্বাভাবিকভাবেই কেউ কর্ণপাত করেনি। যার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, যদি দ্বারকানাথ বাড়ি থাকত তবে আমাকে এভাবে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না। তিনি আরও বাঁচতে চেয়েছিলেন।
দিগম্বরী
লোকমুখে শোনা যায়, অপরূপ লাবণ্যময়ী দিগম্বরী এসেছিলেন ঠাকুরবাড়ির লক্ষ্ণীশ্রী হয়ে। দিগম্বরীর জন্ম যশোরের নরেন্দ্রপুরে। মাত্র ছয় বছর বয়সে দ্বারকানাথের স্ত্রী হয়ে তিনি পা রাখেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। দিগম্বরীর রূপ এখন প্রবাদে পরিণত হয়েছে। ধারণা করা হয় দিগম্বরীর সময় থেকেই ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের রূপের খ্যাতি। শোনা যায় তার মুখের আদলেই নাকি ঠাকুরবাড়ির জগদ্ধাত্রী প্রতিমা গড়া হতো। দুধে-আলতা মেশানো গায়ের রঙ, পিঠে একঢাল কোঁকড়া কালো চুল, চাঁপাকলির মতো আঙুল আর দেব প্রতিমার মতো তার পা দুখানি ছিল। রূপের সঙ্গে দিগম্বরীর ছিল প্রচণ্ড তেজ। শাশুড়ি অলকাসুন্দরীও এই ব্যক্তিত্বময়ী বউটিকে সমীহ করে চলতেন বলে শোনা যায়। ব্যবসায়িক সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে যখন বিলাসিতা আর বাবুয়ানির ছদ্মবেশ পরে নবযুগের ভাবনার বাসা বাঁধলো দ্বারকানাথের মনে তখন তিনি নিজ হাতে পূজা করা ছাড়লেন।মাইনে দিয়ে রাখলেন ১৮জন শুদ্ধাচরী ব্রাহ্মণ।তাছাড়া ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ইংরেজের মতো মাংস ও শেরি খাওয়া অভ্যাস করলেন। এসময়ে ভিন্নখাতে বইতে শুরু করলো দ্বারকানাথ ও ধর্মকর্মে মগ্ন দিগম্বরীর জীবন। এক পর্যায়ে দিগম্বরী জানতে পারেন দ্বারকানাথের ভোজসভায় নাকি মদের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। প্রথমে বিশ্বস না করলেও পরে পতিব্রতা দিগম্বরী স্বয়ং হাজির হন ম্লেচ্ছ ভোজসভায়। দেখলেন সাহেব-বিবিদের সঙ্গে একাসনে পানাহারে মত্ত তার স্বামী। বুকটা ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল তার। কিন্তু তবুও চেষ্টা করেছিলেন সে পথ থেকে দ্বারকানাথকে ফিরিয়ে আনতে। সেকালে এমন পরিস্থিতিতে ধনী গৃহিনীরা অন্দরমহলেই কেঁদে-কেটে সময় পার করতেন। তবুও চাইতেন সংসার টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু দিগম্বরী নিজ ধর্মকর্মে আরও মন দিলেন। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মতামত চাইলেন, এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিৎ তার? স্বামীকে ত্যাগ করে কূল ধর্ম ত্যাগ করবেন কিনা? অতঃপর নির্ধারিত হলো কেবল সেবা ছাড়া স্বামীর কাছে তিনি যাবেন না। আলাদা বাবুর্চিও রাখা হলো। খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলাও বন্ধ করে দিলেন। যে যুগে স্বামীর আদেশ অমান্য করা ও আলাদা থাকার ব্যাপারটি স্ত্রীরা ভাবতেও পারতো না। সেসময়ে দিগম্বরী স্বামীকে ত্যাগ করার বিষয়েও সিদ্ধান্ত চেয়েছিলেন ব্রহ্মাণের কাছে। যুগের পরিপ্রেক্ষিতে দিগম্বরী যে সাহস দেখিয়েছেন সেই তেজ, সেই শক্তি তার পুত্রবধুদের মধ্যে দেখা যায়নি।
তথ্যসূত্র: চিত্রা দেবের 'ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল' অবলম্বনে।