প্রশান্ত পশ্চিম

  • মাহমুদ হাফিজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

পর্ব-৩

লাউঞ্জ ফ্লোর থেকে বিপনীতলায় নেমে লিফটে উঠি। নিচের ফ্লোরের ডি-১১তে আমাদের বোর্ডিং গেট। তুসু সমান্তরাল চলন্ত ওয়াকওয়ের ওপর কেবিন ব্যাগ রেখেছে। পিঠে ব্যাকপাক নিয়ে চলেছে আমাদের আগে আগে। সে আমাদের পিছনে ভৃপৃষ্ঠে এলেও এখন অগ্রবর্তী, আশার আলো।  জলি আর আমি আস্তে আস্তে গিয়ে উঠি স্বতঃশ্চল সে রাস্তায়। যেসব গেটমুখে বিমানের বোর্ডিং শুরু হয়েছে কিংবা বিমান ছাড়ার সময় লাস্ট কল দেয়া হচ্ছে, সেসবের দিকে চলন্ত ওয়াকওয়ে’র ওপর দিয়ে  যাত্রীরা দৌড়ে যাচ্ছে। বিমানবন্দরে এই এক সুবিধা। লাগেজপত্র নিয়ে ঘুরে ঘুরে গেটমুখে যেতে যাতে ক্লান্তি না আসে যাত্রীদের, সে জন্য থাকে চলন্ত পথ। নতুন বিমানবন্দর হলে তো কথাই নেই।

বিজ্ঞাপন

মাথার ওপর অর্ধবৃত্তাকার ডোমের নিচে এই চলন্ত ওয়াকওয়ের দু’পাশে যুক্ত অসংখ্য বোর্ডিং গেট। একটি ওয়াকওয়েতে উঠে লোকজন একেক গেট থেকে যাত্রা করছে একেক দেশের দিকে। কেউ পাড়ি দেবে আটলান্টিক, কেউ প্রশান্ত। আবার কেউ ফিরতি পথে আরবসাগর পার, ভারত, চীন, জাপান সাগর বা বঙ্গোপসাগরের দেশের দিকে ছুটবে।  জীবন চলার পথে কখনো আমরা একই পথের পথিক, শেষমেষ পথ চলে যায় ভিন্নপথে। এ যেন ‘লাকুম দ্বীনুকুম, ওয়ালিয়া দ্বীন’-তোমার জন্য তোমার ধর্ম, আমার জন্য আমার। কিংবা ওই যে গান ‘আজ দু’জনার দুটি পথ, ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে’…..।

ডি-১১ থেকে ছাড়বে ফ্লাইট ২৮৯, ইস্তাম্বুল-সানফ্রানসিস্কো। গেটমুখে বেশিই কড়াকড়ি। আমেরিকা ঢোকার আগে এখান থেকেই যেন সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হচ্ছে। বিশেষ নিরাপত্তা সংস্থা বোর্ডিং ওয়েটিং এরিয়ায় প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করছে।  কোভিড টেস্টের সনদ, পাসপোর্ট-ভিসা, বোর্ডিং পাস দেখানোর পর আমাদের  লাগেজপত্র নিরাপত্তা চেকের যোগ্য হয়। পুঙ্খানুপুঙ্খ চেকের পর প্রবেশাধিকার পাই। কিছুক্ষণ পর ডাক আসে বিমানে ওঠার। আমি এক্সাইটেড। জীবনের শত শত উড়ালের মধ্যে আজ উঠতে যাচ্ছি ব্রান্ড নিউ বোয়িং ড্রিমলাইনার এর ৭৮৭-৯ এয়ারক্রাফটে। গেটমুখে আসার সময় ট্যাক্সিওয়েতে টার্কিশ উড়োজাহাজের যে বিশাল সারি দেখেছি, বোয়িং ড্রিমলাইনার তার মধ্য সবচেয়ে বিলাসবহুল ও আধুনিক। আমাদের আলটিমেট গন্তব্যও বোয়িংরাজ্য সিয়াটলে।

বিমানের ভিতরে ঢুকেই ‘সেইরাম’ শব্দটি মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলে আমার। আধুনিক বিমানটিতে তিন সারিতে তিনটি করে আসন। তুসু বিজনেস ক্লাসের পিছনের কম্পার্টমেন্টেই জানালার কাছে আসন পেয়েছে। আমি আর জলি এর পেছনেই পাখার ওপরের কম্পার্টমেন্টে আসন পেয়েছি। তুসুর পাশে বসেছে রাশভারী দুই গদাধরি মধ্যবয়স্ক। জানালার পাশ থেকে বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজনে দুই গদাধরিকে উঠতে বলা তার কম্ম নয়। তাই তার আসন জুৎসই হয়েছে বলে বলা যাবে না। যদি উপকারে না আসে, বহু মূল্যবান জিনিসও ফেলনা হয়ে যায় জীবনে।  আমাদের সারিতে তিন আসনের একটি ফাঁকা। ভয় পাচ্ছি কেউ যদি চলে আসে , দীর্ঘযাত্রার আয়েশ আরাম হারাম হবে। তুসুর পাশে দুই গদাধরিকে দেখার পর আল্লাহ আল্লাহ করছি কেউ যেন না আসে পাশে।


ভাবনার মধ্যেই বোর্ডিং চলার শেষপর্যায়ে  এক তন্বী তরুণী এগিয়ে এলো ঘাড় ঘুরিয়ে আসন নম্বর খুঁজতে খুঁজতে। মধ্য সারিতে নিজের আসন পাওয়ার পরও  সামনের আসনে বসা তরুণের পাশে ‘মে আই’ বলে বসে পড়লো । সদাহাস্য তরুণটি একাই বসেছিল তিন আসনের সারিতে। এখনও দুটি ফাঁকা। আলাপে বুঝেছি, ইউরোপ থেকে সে পাড়ি জমাচ্ছে আমেরিকায়। বোর্ডিং প্রায় শেষ। আমাদের সামনে পেছনে সবাই বসে গেছে। বিমান রানওয়ের দিকে রওয়ানা হবে হবে ভাব। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে সামনের দিক থেকে এক চিকন সুন্দরী আসন দেখতে দেখতে এগিয়ে আসছে। আধুনিক পরিধেয়সজ্জিত। পরনে জিন্স, ছোট্ টি শার্ট। লম্বা, স্লিমফিগারের। মন বলে ওঠে: সে যদি বসে বসুক।

জলিকে বললাম,

: আসন বোধ হয় আর ফাঁকা রাখা গেল না। পাশের আসন বোধ হয় এই আগমনীর। সে যদি বসে বসুক। 

: এতোক্ষণ তো আল্লাহ আল্লাহ করছিলে, কেউ যাতে না আসে। এখন তোমার আল্লাহ কোথায় গেল?’-জলি বললো।

: তার আসন হলে আর নিষেধ করতে পারবো না।

: হ্যাঁ, বুঝছি’

বলে জলি জানালা আমাকে ছেড়ে দিয়ে মাঝের আসনে বসতে উদ্যত হলো।

চিকনসুন্দরী ধীরপদক্ষেপে এগিয়ে এসে আমাদের সামনেই থামলো। হার্টবিট বাড়ছে, এই বুঝি এক্সিউজ মি বলে বসে পড়ে।

একবার  সেওপরের দিকে তাকালো। নব্য আগন্তুকা তখনও পাশের সদাহাস্য তরুণের সঙ্গে আলাপরতা। দু’চার কথায় কেবলতারা ঘনিষ্ঠমান। এ অঙ্কেই চিকন সুন্দরীর  উদয়। আসন নম্বরে চোখ বুলিয়ে অস্থিরকন্ঠে মেয়েটিকে প্রশ্ন করলো-

‘হোয়াটস ইওর সীট নম্বর”?

আগন্তুকা বিনাবাক্যব্যয়ে আসন ছেড়ে মধ্য সারিতে নিজ আসনে বসলো।

চিকন সুন্দরীর কন্ঠনি:সৃত ‘হোয়াটস ইওর সীট নম্বর’ বাক্যটি আমার কানে শোনালো ‘তুই ক্যাঠা, আমার ভাগ্যে ভাগ বহাতে আইছোস’ এর মতো। 

জলি আর আমার চোখ সামনের আসনের দিকেই স্থির। তিন আসনের সারিতে জানালায় তরুণের একাকী বসা, আরেক তন্বীর তার পাশে বসে আলাপ জমানো আর শেষমেষ আরেক এসে তাকে ভাগিয়ে নিজের আসন বুঝে নিয়ে আলাপ জমানোর মধ্য দিয়ে নাট্যাংশের যবনিকা। আমরা চোখাচোখি করি। পাশের আসনের গুঞ্জরণ প্রলম্বিত হওয়া শুরু হয়।  জানি না, ফ্লাইটের সঙ্গ আসন কতোজনের ভাগ্যে প্রেম জুটিয়ে দিয়েছে। আজকের গুঞ্জরণে মনে হচ্ছে অন্তত একটি হলেও সঙ্গআসন সঙ্গী জুটাবে।এরই মধ্যে বিমান রানওয়েতে টেকঅফের জন্য দৌড়াচ্ছে।


ইস্তাম্বুল থেকে সোজা পশ্চিমে আটলান্টিক সাগরের দিকেমুখ না করে ড্রিমলাইনার যাত্রা করলো সোজা উত্তরে।হালে আমেরিকা-কানাডার আকাশ রাস্তায় অতলান্ত-প্রশান্তকে এড়িয়ে যাওয়ার চল হয়েছে। পৃথিবী বৃত্তাকার, তাই যে কোন দিক থেকেচক্কর দিতে বাধা নেই।  অনেক এয়ারলাইন বেছে নিয়েছে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু। আমি নিজে একযুগ আগেই থাইএয়ারওয়েজের ননস্টপ ফ্লাইটে এসেছি নিউইয়র্কে। আটলান্টিক ও প্রশান্ত রুটে পানির ওপরই টানা আটদশঘণ্টা উড়তে হয়। উড়োহাজাজগুলো বাতাসের বেগ নিয়ে আকাশে চললেও মৃত্তিকামুখী। মাটির স্পর্শ না পেলেও এর ওপর দিয়েই চলতে চায়। মাটির স্পর্শ আমাদের বড় প্রয়োজন।

বলগেরিয়া, রোমানিয়া, ইউক্রেন, পোল্যান্ড ও ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন এর ওপর দিয়ে তা পাড়ি জমালো নরওয়ের আকাশে। গতিবেগ ঘন্টায় নয়শ কিলোমিটারের বেশি। আকাশ পথে পাড়ি দিতে হবে এগারোহাজার কিলোমিটার। নরওয়েজিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে পৌছালো গ্রিনল্যান্ডের বরফরাজ্যে। এসব দেখছি যখন বিমানের ত্রিমাত্রিক মানচিত্রে, তখন ভেতরে এক ভিন্ন জগত। বিমানের জানালাগুলোর গ্লাসের স্বাভাবিক রঙ বদল করে রাতের নীবিড়তা আনা হয়েছে। নিচের তুষাররাজ্যের ওপর সূর্যের আলো বড়  তীর্যক হয়ে পড়ে। জানালার রঙ বদল করে সূর্যালোকের কড়া তেজ থেকে যাত্রীদের প্রশান্তি দেয়ার আয়োজন। কৃত্রিম আলোয় ভেতরে আয়োজন খানাপিনার।

টার্কিশ এয়ার এ রুটটিতে অনেকখানিই উদার। ঢাকা-ইস্তাম্বুল যে আতিথ্য পেয়েছি, এখানে পাচ্ছি তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। ড্রিমলাইনারের হোস্টেজগণকে ডানাকাটা পরী বললে কম বলা হবে। ফর্সা লম্বালতা দেহে আঁটসাটো খয়েরি ইউনিফর্ম তাদের দিয়েছে আরও কমনীয়তা। তুরস্ক মুসলিম দেশ হলেও ইরেশিয়ার দেশ। ব্যবসা জানে। আজকের আতিথ্যে মেন্যু সার্ভ হয়েছে আগে ভাগে। যাতে খাওয়ার আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। মেন্যুতে দেখি,পাস্তা ও বিশেষ তুর্কি কেতার বিফ । এ্যাপিটাইজার, চা, কফি, কোমল ও’শক্ত’ পানীয়ও নেয়া যাবে ইচ্ছেমতো। তেরোঘন্টার ফ্লাইটে সারাক্ষণই থাকবে জুস আর স্যান্ডউইচ। পুরো দিন কাটাতে হবে আকাশে বাতাসে।  ভারী খাবার চাই। আমরা বিফেই কম্পোর্টেবল। পাতে তাই এলো।

আমার পাশ্ববর্তিনীর অনুযোগ খাওয়ার প্রসঙ্গ এলেই আমি নাকি দুইবার জিহ্বা নাড়িয়ে ঠোঁট লেহন করি। লোভাতুর মুখ চকচক করে ওঠে আমার। সে এখন চল্লিশ হাজার ফুট নিচে দেখার কসরত করে যাচ্ছে কিংবা ফ্লাইট রুটের মানচিত্রে বুঁদ, তাই খাওয়া নিয়ে আমার মুখের অভিব্যক্তি দেখার ফুরসত নেই তার।

আইসল্যান্ডকে বাঁয়ে রেখে গ্রিনল্যান্ডর সফেদ বরফরাজ্য কেটে উড়ছে বোয়িংয়ের বিস্ময়কর উড়ালপাখি ড্রিমলাইনার। নিচে সাদা ফকফকে। এখানে শ্বেতভল্লুকই কেবল বাঁচতে পারে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে দেখেছি, বাঁচা ও খাবারদাবারের সন্ধানে বরফরাজ্যের বিয়ার কতো না লড়াই করে চলে নিত্যদিন। উত্তরমেরুর ওপর দিয়ে উড়াল নিয়ে যখন নানা ভাবনা ভাবছি, আমাদের ফ্লাইট বাফিন বে পাড়ি দিয়ে কানাডায় ঢুকে পড়েছে। কানাডা বৃটিশ কলাম্বিয়া রাজ্যের ক্যালগেরি শহরকে ডানে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ও অরেগন রাজ্য পেরিয়ে উড়তে থাকে সানফ্রানসিস্কোর আকাশে। ভাগ্যিস, এখন কোন বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করছি না। তখন বন্ধু হয়তো বলতো, আমেরিকা যাবা তো কানাডা গেছো ক্যানে? সে দেশে তো আরও পশ্চিমে! একবার যুক্তরাষ্ট্রে আসার পথে চীনে একরাতের ট্রানজিটে ছিলাম। একবন্ধুর সঙ্গে ফোনে আলাপ হচ্ছিলো, সে বললো, আমেরিকা যাবা তো পূবের দেশ চীনে ক্যানে?

এখন বন্ধুর নয়, কেবিনক্রুর কণ্ঠ শুনি‘লেডিজ এ্যান্ড জেন্টেলম্যান, উই এ্যরাইভড সানফ্রানসিস্কো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট।

আরও পড়ুন: প্রশান্ত পশ্চিম-২

প্রশান্ত পশ্চিম, পর্ব-১