জাতীয় পার্টির লজ্জাজনক পরিণতি!

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

জাতীয় পার্টি

জাতীয় পার্টি

ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির পতন হয়েছে। গণফ্রন্টের চেয়েও কম ভোট পেয়েছেন জাপার মেয়র প্রার্থী। দলটির কাউন্সিলর পদে জয়ী হয়েছেন মাত্র একজন।

এমন ফল লজ্জাজনক বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা। তারা মনে করছেন সিটি নির্বাচনে এমন ভরাডুবির কারণে জাতীয় পার্টির চরম ইমেজ সংকট দেখা দিতে পারে। চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন দলীয় নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, এরপর নিজেদের তৃতীয় বৃহত্তম দল দাবি করাটা হাস্যকর দেখাবে।

বিজ্ঞাপন

জাতীয় পার্টি ঢাকার দুই সিটিতে শুধু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৯৪ ভোটারের এই সিটিতে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলের আসনে থাকা জাপার লাঙল প্রতীকে পড়েছে মাত্র ৫ হাজার ৫শ’ ৯৩ ভোট। অনেক সেন্টার রয়েছে যেখানে লাঙল প্রতীকে একটিও ভোট পড়েনি। পার্টির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ভোট দিলেও কয়েকগুণ বেশি ভোট পড়ার কথা লাঙল প্রতীকে।

একই সিটিতে জাতীয় পার্টির চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছে গণফ্রন্টের প্রার্থী আব্দুস সামাদ সুজন। গণফ্রন্টের প্রার্থী মাছ প্রতীকে ভোট পেয়েছেন ১২ হাজার ৬৮৭টি। আর চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী জাপার থেকে পাঁচগুণ বেশি ভোট পেয়েছেন। হাতপাখা মার্কায় তাদের ভোটের পরিমাণ ২৬ হাজার ৫২৫টি।

হাতপাখা ও মাছ মার্কার কাছে লাঙলের ধরাশায়ী হওয়ায় উদ্বিগ্ন জাতীয় পার্টির নেতারা। এমন সমীকরণে দাঁড়িয়ে জাপা যে সামনের দিনে সরকার গঠন করতে চায় সেই স্বপ্ন ম্লান হয়ে যায়। অন্তত সাধারণ মানুষকে গেলানো কঠিন হতে পারে। আর নেতাকর্মীদের স্বপ্ন দেখাতে ব্যর্থ হলে জাপার ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দিবাস্বপ্নে পরিণত হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।

তৃণমূল কর্মীরা মন্তব্য করেছেন, জাতীয় পার্টি কখনও এমন শোচনীয় পরাজয় বরণ করেনি। পার্টির দায়িত্বশীল নেতাদের অযোগ্যতার কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। প্রার্থীদেরও কোনো দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। ছিল না নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো সমন্বয়। কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো নির্দেশনা না থাকায় স্থানীয় নেতারাও হাত গুটিয়ে বসেছিলেন। আবার অনেকে গোপনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন।

অন্যদিকে দুই সিটির ১২৯ সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র ১৫ জনের মতো প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে ছিলেন শেষ পর্যন্ত। তাদের ভোটের ফলও হতাশাজনক। পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয় অবস্থিত উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে। ওই ওয়ার্ডের প্রার্থীর প্রাপ্ত মোট ভোটের পরিমাণ মাত্র সাড়ে ৫শ’। ওয়ার্ডটিতে পার্টির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটিতে থাকা নেতার সংখ্যাও এক হাজার ছাড়িয়ে যাবে।

সিটি নির্বাচনে লজ্জাজনক ফলের জন্য পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে দুষছেন অনেকে। তারা বলছেন, পার্টির কোনো ভূমিকা ছিল না এই ভোটে। এ কারণে চরম ভরাডুবি হয়েছে।

আর এই ভরাডুবির কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা নেমে এসেছে। তারা পার্টির ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তৃণমূলের নেতারা দাবি করেছেন, রংপুর সিটি করপোরেশনে বিপুল ভোটে বিজয়ের পর সারাদেশে একটি চাঙ্গাভাব চলে এসেছিল। ঢাকার এই লজ্জাজনক ফল তাতে ভাটার সৃষ্টি করবে।

জাতীয় সংসদ ছাড়া আর কোথাও অবস্থান নেই জাতীয় পার্টির। বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সারাদেশে মাত্র একজন জয়ী হয়েছেন। খোদ জাতীয় পার্টির দুর্গে একজন প্রার্থীও জয়ী হতে পারেননি। ইউনিয়ন পরিষদও হাতছাড়া। ভোটের পদ্ধতি নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলে ঢেঁকুর তুললেও প্রকৃত চিত্র ভিন্ন।

অনেকে ভেবেছিলেন জিএম কাদের পার্টির হাল ধরলে গুণগত পরিবর্তন আসবে। কিছুটা জোয়ারও শুরু হয়েছিল। কিন্তু কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে আবার স্থবিরতা নেমে এসেছে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে রাজশাহীতে গণপদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। অনেক নেতা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সম্পর্কের পরিসমাপ্তির কথা জানান দিচ্ছেন। একজন মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থী পার্টির কোনো সহায়তা না পেয়ে ভোটের পরে ফেসবুক লাইভে এসে জাপা ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, আমার চেয়ারম্যান (এরশাদ) মারা গেছেন, এখন দেখার কেউ নেই। তার কবরে গিয়ে পদত্যাগপত্র রেখে আসবো।

জি এম কাদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া রংপুর-৩ আসনের উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে এরশাদ পুত্র রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। রংপুরে অনেক শীর্ষ নেতা প্রকাশ্য বিদ্রোহ করে পার্টির বিপক্ষে ভোট করেন। আবার কেউ কেউ হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। সবকিছু দেখেও পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন নিরব দর্শকের ভূমিকায়। রংপুরের মতো ঢাকা সিটি নির্বাচনেও অনেক শীর্ষ নেতা হাত গুটিয়ে বসেছিলেন। কেউ কেউ তাদের অনুসারিদের আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামিয়ে দিয়েছেন। এমনকি নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হলেও তাদেরও কোনো সহযোগিতা পাননি মেয়র প্রার্থী।

জাতীয় পার্টির একজন সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, হাজী মিলন নিজে প্রার্থী হতে চাননি, তাকে চেয়ারম্যান অনেকটা জোর করে মাঠে নামিয়েছে। কেন্দ্র থেকে একটি পয়সাও তাকে দেওয়া হয়নি। কর্মীদের পোস্টার লিফলেটও সরবরাহ করা হয়নি। এই এলাকায় দলের দুই জন এমপি রয়েছেন। তাদের মধ্যে কাজী ফিরোজ রশীদের এলাকায় কোনো কর্মী মাঠে নামেননি। এমপির ছেলে ও তার ঘনিষ্টরা আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করেছেন। বিষয়টি পার্টির চেয়ারম্যানকে সময়ে সময়ে অবগত করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেননি তিনি।

একজন শীর্ষ নেতা বলেছেন, জাপা এখন ইনডোর পার্টিতে পরিণত হচ্ছে। ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো আর সেলফি তোলার মধ্যেই অনেক নেতার কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। তারা জিএম কাদেরের সামনে এসে মহড়া দেন। পার্টির কোনো কাজে তাদের দেখা যায় না।

এসব ব্যাপারে জানতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। ভোটের পরের দিন এক অনুষ্ঠানে জিএম কাদের বলেছেন, দেশের প্রধান তিনটি দলের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় জাতীয় পার্টি। মানুষ চায় আগামীতে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় আসুক। তবে ভোট নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।

গণআন্দোলনের মুখে বিদায়ের পর প্রথম ১৯৯১ সালে নির্বাচনে কাস্টিং ভোটের ১১.৯২ শতাংশ পেয়েছিলো জাতীয় পার্টি। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ১০.৬৭ শতাংশ, আর ২০০১ সালে ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রণ্টের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভোট পায় ৭.২৫ শতাংশ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পেয়েছে মাত্র ৭.০৪ শতাংশ। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি। কিন্তু যে আসনেই জোট ছাড়া নির্বাচন করেছে সেখানেই ধরাশায়ী হয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। আর এবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে দলটি ভোট পেয়েছে দশমিক ২৩ শতাংশ।