আওয়ামী লীগের ‘গোপন শাস্তি’তে নির্বিকার নেতারা
দেশে চলছে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। চার ধাপের এই নির্বাচনের প্রথম ধাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ৮ মে। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন মঙ্গলবার (২১ মে)। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ভোটার টানতে বাদ দিয়েছে নিজেদের প্রতীক নৌকা। মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের ওপরও আসে নিষেধাজ্ঞা, নির্দেশ না মানলে দেওয়া হয় শাস্তির হুমকি! তবে সব কিছুকে উপেক্ষা করে নির্বাচন থেকে সরেননি মন্ত্রী-এমপির স্বজনরা।
দলীয় প্রধান ও কেন্দ্রের কড়া নির্দেশনা উপেক্ষার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, নেতাদের প্রকাশ্য শাস্তি না দেওয়া, লঘু শাস্তি এবং শাস্তি দিয়ে সেটা আবার ক্ষমা করে দেওয়ার মতো ঘটনা কাজ করছে নির্দেশ অমান্যের পিছনে।
অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে, কেন্দ্র থেকে যে নির্দেশনায় দেয়া হউক, যদি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসা যায় তাহলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে না। আবার যেসব নেতাদের জনপ্রিয়তা আছে, জনভিত্তি আছে তারা মনে করছেন, শাস্তি দিলেও সেটা টিকবে না বেশি দিন। লঘু কোন শাস্তি দিলেও দল তার নিজের প্রয়োজনেই ক্ষমা করে সুযোগ করে দিবে আবার।
এদিকে প্রকাশ্যে শাস্তির কথা বললেও সেটার বাস্তবায়ন দেখতে না পাওয়ায় উৎসাহিত করছে দলের নির্দেশ অমান্যের বিষয়ে।
বার বার শাস্তি দেওয়া ও ক্ষমা করার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে প্রথমবারের মতো দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে দল থেকে বহিষ্কার হন তিনি। প্রায় এক বছর পর ২০২২ সালের ১৭ ডিসেম্বর জাহাঙ্গীর আলমের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে ক্ষমা করে দলটি।
তবে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ থেমে থাকেননি গাজীপুরের প্রভাবশালী এ নেতা। গত বছরের মে মাসে অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী ছিলেন গাজীপুর আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আজমত উল্লাহ খান। সে নির্বাচনে নৌকার বিপক্ষে গিয়ে, আওয়ামী লীগের নির্দেশ অমান্য করে প্রার্থিতা জমা দেন নিজের ও মা জায়েদা খাতুনের। এর জেরে আবারও দল থেকে বহিষ্কার করা হয় জাহাঙ্গীর আলমকে। তবে সে বহিষ্কারাদেরশও টেকেনি বেশিদিন। বরং দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলমের বিশাল কর্মী বাহিনী কাজে লাগানোর জন্য মাত্র পাঁচ মাস পর প্রত্যাহার করে নেয় বহিষ্কারাদেশও।
দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা ও আদর্শিক স্থান ধরে রাখার স্বার্থে গঠনতন্ত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা থাকলেও তা পালনে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে বরাবরই ঢিলেঢালা নীতি অনুসরণ করতে দেখা যায়। কখনো ব্যবস্থা নিলে সেটাও প্রত্যাহার করা হয় দ্রুতগতিতে। এর মধ্যে আছেন, চার জেলা ও উপজেলা চেয়ারম্যান, সাবেক এমপি, দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাসহ অনেকেই।
যদিও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বলছে, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের কাউকে কখনো ছাড় দেওয়া হয় না। অনেক সময় কৌশলগত কারণে প্রকাশ্য শাস্তি না দিলেও পরে বড় ধরনের শাস্তিতে পড়তে হয় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের।
এনিয়ে দলটির ভাষ্য, দলীয় নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে যথাসময়ে ব্যবস্থা নেন দলীয় প্রধান। প্রকাশ্যে কোন শাস্তি দিতে দেখা না গেলেও অনেক ক্ষেত্রেই দেওয়া হয় অপ্রকাশ্য শাস্তি। যা প্রকাশ্য শাস্তির চেয়েও বড় হয়। বাদ দেওয়া হয় দলীয় পদ-পদবি থেকেও। দেয়া হয় না মনোনয়ন। বাদ পড়তে হয় মন্ত্রিসভা থেকেও।
গত ১৭ মে বিকেলে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। যারা ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করবে অবশ্যই তাদের শাস্তি ভোগ করতে হবে। শেখ হাসিনার শাস্তি দেওয়ার কায়দা একটু ভিন্ন রকম। যারা বুঝেছেন, পেয়েছেন তারা ঠিকই বুঝেন। আর যারা পাননি তাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।
তিনি বলেন, ‘তার (দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা) নির্দেশনার বাইরে কেউ যেন আমরা কোনো অপকর্ম না করি। অপকর্ম যারা করেন শুদ্ধ হয়ে যান। মনে করছেন চুপচাপ আছে? কেউ শাস্তি পাচ্ছে না কেন? পাবে! শাস্তি পাবে। গত নির্বাচনে ৭৫ জন এমপি নমিনেশন পায়নি। এটিও শাস্তি। কাজেই এখানেই সব শেষ নয়। শাস্তি দেওয়ার অনেক সময় আছে। সময়মতো হিসাব হবে। কেউ রেহাই পাবে না।’
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, প্রকাশ্য শাস্তি যেহেতু দেখা যায়, তাই তার প্রতিক্রিয়াটাও হয় সরাসরি। সেক্ষেত্রে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গে নেতাকর্মীরা নিরুৎসাহিত হয়। আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকায় নানা উপকারভোগী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। ফলে সবসময় চাইলেই সাথে সাথে শাস্তি দেওয়া যায় না। আবার অনেক সময় দলের প্রয়োজনে দ্রুত সময়ে ক্ষমাও করে দিতে হয়। প্রকাশ্যে শাস্তি না পেলেও দলীয় প্রধান কাউকে ছেড়ে দেন না। তিনি সময় মতো ঠিকই ব্যবস্থা নেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই নেতারা বলেন, অপ্রকাশ্য শাস্তি দেওয়া হয়, সেটার প্রতিক্রয়া তৃণমূলে পৌঁছায় না। যার ফলাফল আমরা দেখতে পাচ্ছি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে। দল থেকে বার বার কড়া নির্দেশনার পরও তৃণমূলে গিয়ে ঠিক সেভাবে পালন হয়নি। এমপি-মন্ত্রীর স্বজনেরা সরে দাঁড়ায়নি নির্বাচন থেকে। তবে রাজনীতি করতে গেলে সকল বাস্তবতা মেনেই করতে হবে। আমরা সে লক্ষেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। যতটা পারা যায় যেনো দলীয় শৃঙ্খলা অক্ষুন্ন রাখা যায়।
প্রার্থীদের প্রকাশ্য শাস্তি না দেওয়ায় কেন্দ্রের নির্দেশ মানার ব্যাপারে প্রার্থীদের অনীহা আসছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন বার্তা২৪.কম-কে বলেন, আমরা চাচ্ছি নির্বাচনটা যেনো প্রভাবমুক্ত থাকে। আমরা সে লক্ষেই কাজ করছি। নির্বাচন কমিশন তাদের নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। তাই আমরা মনে করি এতে কোন সমস্যা হবে না।