ঐতিহাসিক রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস আজ
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দুই দিন পর। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ। মুক্তিকামী ওরাঁও, সাঁওতাল আদিবাসী জনগোষ্ঠীসহ সাধারণ জনগণ ঢোল বাজিয়ে একত্রিত হয়েছিল নিসবেতগঞ্জের ঘাঘট নদীর পাড়ে। উদ্দেশ্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীদের ক্যান্টনমেন্ট দখলে নেওয়া। এদিন দেশপ্রেমে উন্মত্ত বাঙালি জনগণ দা, বল্লম, তির-ধনুক আর লাঠি-সোডাসহ হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই নিয়ে এসেছে বর্বর পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে।
ক্যান্টনমেন্ট এলাকার যখন চার’শ গজের মধ্যে বাঙালি মুক্তিকামী জনতা ঠিক তখনই বৃষ্টির মত চলে পাকিস্তানি হায়েনাদের ট্যাংক আর ব্রাউনিং মেশিন গানের অবিরাম গুলি । মুহূর্তের মধ্যেই পাখির মত মাটিতে লুটিয়ে পড়ে শত শত প্রতিবাদী তরতাজা সাহসী প্রাণ। নিরস্ত্র সাহসী বাঙালিদের হত্যা করে ক্ষান্ত হয় পাক সেনারা। মটিতে পড়ে থাকা মৃত ও অর্ধমৃত প্রায় পাঁচ শতাধিক মুক্তিকামী জনগণকে নিসবেতগঞ্জ এলাকাতে পেট্রোল ঢেলে আগুনে পুড়ে ফেলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।
৪৯ বছর আগে স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারী বীর বাঙালির সেই আত্মত্যাগ আর সাহসিকতা আজও বিরল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই আক্রমণ নিরস্ত্র মানুষদের জোটবদ্ধ লড়াইয়ের এক ঐতিহাসিক উদাহরণ। এমন আক্রমণের ঘটনা সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসেও নজিরবিহীন। তাই আজকের এই দিনটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রংপুরের মানুষের কাছে এক অনন্য দিন।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে জানা গেছে, ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে পাকিস্তানি হায়েনাদেরা সারাদেশে বাঙালিদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে। কিন্তু এর এক দিন আগ থেকেই রংপুরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিলো। ২৪ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ট্যাংক ডিভিশনের পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনসহ তিন জওয়ানকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধ আরম্ভ করে রংপুরের মানুষ। এ ঘটনার পর পাকিস্তানি হায়েনার দল রংপুরে জ্বালাও পোড়াও শুরু করে।
২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনী সিরিজ হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। পুড়িয়ে দেয় গ্রামের পর গ্রাম। একই সাথে ৩২ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে পরের দিন জুমার নামাজের সময় লাহিড়িরহাটের কাছে একটি মাঠে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় মানুষ আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।
সারাদেশে যুদ্ধ শুরু হলে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে অবাঙালি সৈন্যদের বন্দী করে ক্যান্টনমেন্ট দখল করার সিদ্ধান্ত নেন রংপুরের উত্তেজিত মুক্তিকামী বাঙালি। ওরাঁও, সাঁওতাল তিরন্দাজ বাহিনীসহ হাজার হাজার মানুষ তির ধনুক-বল্লম, দা-কুড়াল আর বাঁশের লাঠি হাতে ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে নিসবেতগঞ্জহাট ও তার আশপাশ এলাকাসহ ঘাঘট নদীর তীর ঘেষে জমায়েত হতে থাকে।
কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার চেষ্টা করেছিলো সবাই। হঠাৎ বৃষ্টির মত ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসতে থাকে আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি। অসম সেই লড়াইয়ে সেদিন পাক বাহিনীর ছোঁড়া মেশিন গানের গুলিবিদ্ধ হয়ে শত শত মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভে গেছে। রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল নিসবেতগঞ্জ আর ঘাঘট নদীর পাড়।
ঐতিহাসিক সেই ২৮ মার্চের কথা আজও রংপুরের মানুষ স্মরণ করে। প্রতি বছর এই দিনটিতে নানান আয়োজন পালন করা হয় ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস। কিন্তু এবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকারি নির্দেশনার কারণে দিবসটি পালিত হচ্ছে না। সঙ্গরোধে থেকে করোনা মোকাবিলার সাথে শহীদ যোদ্ধাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করছে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠকরা।