দীর্ঘ সকালের পর নগরীতে বিজয়ের দিন

  • নাজমুল হাসান সাগর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট,বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

বিজয় উদযাপন/ ছবি: সুমন শেখ

বিজয় উদযাপন/ ছবি: সুমন শেখ

দীর্ঘ এক সকাল নিয়ে নগরীতে এসেছে আজকের দিন। গত দিন সন্ধ্যের পর যান্ত্রিক এই শহরে আর রাত নামেনি। লাল-সবুজের স্বাধীন স্পর্ধায় মলিন ছিলো রাতের আঁধার। রাজধানী ঢাকার প্রত্যেকটি আকাশচুম্বী ভবন হয়ে উঠেছিলো এক একটি লাল সবুজের বাংলাদেশ।

আলোকসজ্জার আবেশী প্রতিফলন যেন শিশির ঘেরা তিমির বিদায়ী বিজয়ী ভোরের আলো হয়ে নেমেছিল নগরীর প্রত্যেকটি পরতে পরতে।

বিজ্ঞাপন

আবেশী এই ভোর কাটিয়ে, বিদায়ী সকালের সোনা রোদ যখন চিকচিক করছে নাগরিক দালানের কার্নিশে কার্নিশে, তখন রাজপথ যেন পরিণত হয়েছে বিজয়ের মিছিলে।

দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর এক নদী রক্ত পেরিয়ে আনন্দ অশ্রুসিক্ত বিজয়ের মাধ্যমে আজকের এই দিনে অর্জিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ।

সমস্ত বাংলাদেশির জন্য এই দিন আনন্দের ও উদযাপনের। সেই সঙ্গে দেশপ্রেমী হৃদয়ে ৯ মাসে প্রাণ দেওয়া স্বাধীনতাকামী লড়াকু আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার দিন।

বিজয় উদযাপনে রাজধানীবাসী/ ছবি: বার্তা২৪.কম

১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে গত তিন দিন আগে থেকেই বদলে যেতে থাকে রাজধানী ঢাকার চিরচেনা চরিত্র। আজ যেন তা পূর্ণতা পেয়েছে শতভাগ। মাথায় লাল সবুজের পতাকা, গালে বিজয়ের আলপনা আর পরনে লাল-সবুজের মেলানো পোশাক। বাবা-মায়ের হাত ধরে বিজয় মিছিলে গুটি গুটি পায়ে সামিল হয়েছে কচিকাঁচার দল। কিশোর-কিশোরীরা গলা মেলায় মোড়ে মোড়ে বাজতে থাকা দেশাত্মবোধক গানের সঙ্গে। সুযোগ বুঝে প্রেয়সীর খোপায় একগুচ্ছ লাল গোলাপ গুঁজে বিজয়ের রক্তিম শুভেচ্ছা জানায় প্রেমিক ছেলেটিও। আকাশে এক অসীম স্পর্ধা নিয়ে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে নগর ছাড়িয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায় হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমানগুলো।

বিজয় দিবস উপলক্ষে নগরীর প্রত্যেক সরকারি দপ্তর এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উত্তোলন করেছে জাতীয় পতাকা। বাদ যায়নি বিপণিবিতানসহ আবাসিক দালানগুলোও। সেইসঙ্গে নগরীর সব ধরনের পরিবহনে উড়তে দেখা গেছে লাল সবুজের নিশান।

বিজয় উদযাপনে রাজধানীবাসী/ ছবি: বার্তা২৪.কম

বিজয় দিবস উদযাপনের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে সরকারি ছুটি। ছুটির দিনটিকে কাজে লাগাতে দুই সন্তান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দেখতে এসেছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা অনুরাধা রায়। বার্তা২৪.কমের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, আজই প্রথম নয়। আমার প্রথম ছেলের বয়স ১০ বছর। ও যখন আমার পেটে তখন থেকেই প্রত্যেকটি বিজয় দিবসে আমি বিজয় মিছিলে যোগ দিই। জাদুঘরে যাই, স্মৃতিসৌধ ও শহীদ মিনারসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলো ঘুরে বেড়াই। আমি বিশ্বাস করি আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেম সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেওয়া দরকার। সেই লক্ষ্যেই ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে থেকেই আমার সন্তানকে আমি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বিষয়গুলোর কাছাকাছি রাখতে চাই, যেন দেশ ও দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে ওরা কখনো ভুল পথে ধাবিত না হয়।

বিজয় উদযাপনে রাজধানীবাসী/ ছবি: বার্তা২৪.কম

ভোরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সাভার স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র আবু রাহিল আহমেদ। শ্রদ্ধা জানিয়ে হলে ফেরার পথে কথা হয় তার সঙ্গে। জাতীয় পতাকায় বাঁধা মাথা নেড়ে এই তরুণ বলছিলেন, আজকের এই দিনটা এলে আমার ভেতর অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। আমার জন্মদিন এলে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে যেভাবে আনন্দ করি, তেমনি বিজয়ের এই দিনটিতে আমার আনন্দ করতে ইচ্ছে করে। তবে, সবার আগে স্মরণ করা উচিত এই আনন্দের দিনটি আনতে গিয়ে যারা অকাতরে নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন তাদের। এজন্য ভোরে ঘুম থেকে উঠে গিয়েছিলাম সাভার স্মৃতিসৌধে।

জাতীয় সংসদ ভবন, শাহবাগ, জাতীয় জাদুঘর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার টিএসসি চত্বর, শহীদ মিনার ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঘুরে দেখা যায় বিজয় দিবস উদযাপন করতে সব শ্রেণি-পেশা, ধর্ম-বর্ণ ও সব বয়সের মানুষ বেরিয়ে এসেছেন ঘরের বাহিরে।

বিজয় উদযাপনে রাজধানীবাসী/ ছবি: বার্তা২৪.কম

জাতীয় শহীদ মিনারের বেদীতে, পরনে সাদা পাঞ্জাবি উপরে কালো মুজিব কোট, চোখে মোটা অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমের চশমা পরিহিত পাঁচ বছর বয়সী পার্থ তর্জনী উঁচিয়ে বলছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমাদের যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ো। এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো.........’

সত্যিই কয়েকটি শব্দের এই বাক্য ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হয়ে নিয়ে এসেছে আজকের এই দিন। এই শব্দগুলো যদি উচ্চারিত না হতো সেদিন, তাহলে হয়তো আজকের এই দিনে লাল সবুজের উপাখ্যান লেখা হতো অন্য কোনোভাবে, অন্য কারোর জন্য।