আজ ভয়াল ২৫ মে। এক দশক আগে এ দিনেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলার তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদ। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের কাছে এ দিনটি এখনো আতঙ্কের। দীর্ঘ ১০ বছর অতিবাহিত হলেও এখনও স্বাভাবিক হয়নি উপকূলের জনপদ।
এসব এলাকায় এখনও সুপেয় পানির সংকট প্রবল। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাড়েনি সাইক্লোন শেল্টার, মেরামত করা হয়নি পাউবো’র ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ। তাই এখনও দুর্যোগ ঝুঁকিতে আতঙ্কিত অবস্থায় থাকেন উপকূলবাসী।
২০০৯ সালের ২৫ মে এ দিনে ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার বেগে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। নোনা জলে ভাসিয়ে নেয় উপকূলীয় অঞ্চলের হাজার হাজার বসতভিটা, আবাদি জমি, সম্পদ আর মানুষ।
সরকারি হিসেবে, এ ঝড়ে ৩৩২ জনের প্রাণহানি হয়। এ দিনে কেউ হারায় সহায়-সম্পদ, কেউবা স্বজন। সহায়-সম্পদ হারানোর কথা অনেকে ভুলতে পারলেও স্বজন হারানোর বেদনা ভুলেনি উপকূলবাসী।
১০ বছর আগের এদিনে বঙ্গোপসাগর থেকে নেমে আসা উঁচু জলোচ্ছ্বাস ও প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট সর্বগ্রাসী ‘আইলা’ আঘাত হানে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জনপদে। মুহূর্তের মধ্যে খুলনা জেলার দাকোপ, কয়রা উপজেলার অধিকাংশ এলাকার বেড়িবাঁধ লণ্ডভণ্ড হয়ে লোকালয় প্লাবিত হয়।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, পদ্মপুকুর, আশাশুনিতেও বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। স্বাভাবিকের চেয়ে ১৪-১৫ ফুট উচ্চতায় সমুদ্রের পানি এসে নিমিষেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় এলাকার নারী ও শিশুসহ কয়েক হাজার মানুষ, হাজার হাজার গবাদি পশু, ঘরবাড়িসহ অসংখ্য ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
ক্ষণিকের মধ্যে গৃহহীন হয়ে পড়ে হাজারো পরিবার। কয়েক লক্ষ হেক্টর চিংড়ি ঘের ও ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যায়। সর্বনাশা ‘আইলা’র আঘাতের পর ভাঙা রাস্তার উপর ঝুপড়ি ঘর বেঁধে বসবাস করতে শুরু করেন উপকূলবাসী।
প্রলয়ংকরী আইলা’র আঘাত হানার ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের আতঙ্ক কাটেনি। দু’মুঠো ভাতের জন্য জীবনের সঙ্গে রীতিমত লড়াই করতে হচ্ছে তাদের। আইলার পর থেকে এসব এলাকায় সুপেয় পানি সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।
খাবার পানির জন্য এখনো ছুটতে হচ্ছে মাইলের পর মাইল। আইলা কবলিত অঞ্চলের রাস্তাঘাট এখনও ঠিকমত মেরামত হয়নি। দুর্যোগ মুহূর্তে আশ্রয়ের জন্য খুবই কম সংখ্যক সাইক্লোন সেন্টার রয়েছে। আইলা বিধ্বস্ত এলাকায় গেলে ১০ বছর আগে ঘটে যাওয়া আইলার চিহ্ন স্পষ্ট দেখা যায়। বর্তমানেও এলাকায় বসবাসরত মানুষের চোখে মুখে স্পষ্ট সেদিনের ভয়ঙ্কর সেই স্মৃতি।
আইলার পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও উপকূলীয় জনপদের মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই নাজুক। বর্ষার দিনে এসব এলাকার মানুষের নৌকা ও ট্রলার একমাত্র ভরসা। আইলায় নোনা পানিতে তলিয়ে থাকায় জমিতে কৃষি ফসল ও চিংড়ি উৎপাদন বন্ধ থাকায় গোটা এলাকা জুড়ে কাজের সুযোগ কমে গেছে। যে কারণে সেই সময় থেকে অনেকেই এলাকা ছেড়েছেন। যাদের অধিকাংশই আজও তাদের বসতভিটায় ফিরে আসতে পারেনি।
এছাড়া অধিকাংশ এলাকার বেড়িবাঁধের অবস্থা খুবই খারাপ। সবার ধারণা বর্ষা মৌসুমে বেড়িবাঁধ টিকবে না। আইলার পর ১০ বছর অতিবাহিত হলেও সমগ্র আইলা দুর্গত এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধগুলোর এখনও তেমন কোন সংস্কার হয়নি। সামান্য ঝড়-বৃষ্টিতেও ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হচ্ছে এসব জনপদের কয়েক লাখ মানুষকে।
আইলা বিধ্বস্ত উপকূলে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে স্থানীয়দের দাবি ছিল, ‘পরিকল্পিত বাঁধ চাই, জীবন-জীবিকা ও সম্পদের নিরাপত্তা চাই।’ তবে ১০ বছর কেটে গেলেও তাদের দাবি এখনো সোনার হরিণ হয়ে আছে।