কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি-প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠি দিলেন আমান আযমী
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমীকে বরখাস্তের আদেশ ‘প্রমার্জনা’ করে এর পরিবর্তে ভূতাপেক্ষভাবে ‘অকালীন (বাধ্যতামূলক) অবসর’ দেওয়া হয়েছে। এই আদেশ প্রদানের জন্য তিনি রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন।
ওই চিঠিতে তিনি লিখেছেন, আমি ৫ম বিএমএ (বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি) লং কোর্সের অফিসার হিসেবে ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৭ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করি। আমি কখনো আত্মপ্রচার পছন্দ করিনা। কিন্তু, এখন পরিস্থিতির শিকার হয়ে একান্ত নিরুপায় হয়েই দেশবাসীর কাছে কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই।
কমিশনপ্রাপ্তির সময় সর্ব বিষয়ে সেরা চৌকষ ক্যাডেট হিসেবে আমি “সোর্ড অব অনার”, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিগ্রী পরীক্ষায় কলা বিভাগ থেকে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১ম শ্রেনীতে ১ম স্থান অধিকার করে “স্বর্ণপদক” এবং রণকৌশলে সেরা নৈপূণ প্রদর্শনের জন্য আমি “ট্যাকটিক্স প্ল্যাক” অর্জন করি। বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর সচিত্র মুখপত্র “সেনানী” এর জানুয়ারি ১৯৮২ সংখ্যার ৭ ও ৮ নং পৃষ্ঠায় এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনের ৮ নং পৃষ্ঠায় লেখা আছে, “তিনি [প্রেসিডেন্ট এরশাদ] সামরিক একাডেমির ইতিহাসে সর্বোচ্চ মেধায় উত্তীর্ণ সেরা চৌকষ ক্যাডেট ব্যাটালিয়ান সিনিয়ার আন্ডার অফিসার আব্দুল্লাহিল আমান আযমীকে সন্মাসূচক তরবারী ও স্বর্ণপদক প্রদান করেন।“ (ছবি ও রিপোর্ট সংযুক্ত)। আমার জানামতে বিএমএ’র ইতিহাস কেউ এই রেকর্ড ভাংতে পারেনি। কমিশন পরবর্তী অধিকাংশ কোর্সেই প্রথম স্থান অধিকার করেছি। কেবলমাত্র মেডিকেলজনিত কারণে ২/৩টিতে ১ম স্থান অর্জন করতে পারিনি। কমান্ড, স্টাফ এবং ইনসট্রাক্টর সকল ধরণের দায়িত্বে আমি সেরা নৈপূণ্য প্রদর্শন করতে সক্ষম হই। মাস্টার্স পরীক্ষায় (৭০.৫ নম্বর পেয়ে) ১ম শ্রেনীতে ২য় এবং এম.ফিল (প্রথম পর্বে) প্রথম শ্রেণীতে ১ম স্থান অধিকার করেছি। সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করায় এম.ফিল সম্পূর্ণ করতে পারিনি। মহান আল্লাহর দয়ায় এবং বাবা-মা এর দোয়ায় প্রায় তিরিশ বছরের সামরিক জীবনে একজন আদর্শ সেনা অফিসার হিসেবে এবং পাশাপাশি একজন উন্নত নৈতিক চরিত্রের অফিসার হিসেবে আমি সকলের জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে কোন অফিসারই এক বাক্যে আমার এই বক্তব্যের স্বপক্ষে সাক্ষ্য দিবে।
আমার কৃতিত্বপূর্ণ এই চাকুরীর পরও ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালীন আমার মেজর থেকে লেঃ কর্ণেল পদে পদোন্নতি বন্ধ করে রেখেছিল। ২০০২ সালে ৪ দলীয় জোট ক্ষমতায় এলে আমার লেঃ কর্ণেল পদে পদোন্নতি হয়। পরবর্তীতে, যথাযথ প্রক্রিয়ায় আমি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে পদোন্নতি পাই।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ২০০৯ সালে ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসে। আমি তখন দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার অন্তর্গত খোলাহাটি ক্যান্টনমেন্টে ১৬ পদাতিক ব্রিগেড কমান্ডার এবং পাশাপাশি ষ্টেশন কমান্ডার এর দায়িত্ব পালন করছিলাম। জুন মাসে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন উ আহমেদ অত্যন্ত অপমানজনকভাবে আমাকে আমার পদ থেকে অপসারণ করে পদবিহীন অবস্থায় ঢাকা সেনানিবাসের সদর দপ্তর লজিস্টিক এরিয়ায় সংযুক্ত করে রাখেন। এর পর, ২৩ জুন ২০০৯ তারিখে এক সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করে ২৪ জুন তারিখ ২০০৯ তারিখে আমাকে সেনাবাহিনীর চাকুরী থেকে নজিরবিহীনভাবে “বরখাস্ত” করা হয়। এই আদেশের দ্বারা আমার অবসরের আর্থিক সুবিধাসহ অন্যান্য সকল সুবিধাদি থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হয়। বিনা অপরাধে, বিনা অভিযোগে, বিনা তদন্তে ও বিনা বিচারে একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তো দূরের কথা একজন সৈনিককেও বরখাস্ত করার কথা নয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তো বটেই, পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরণের ন্যাক্কারজনক ঘটনার কোন নজির আছে বলে জানা নেই।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, গণমাধ্যমের এক শ্রেণীর দায়িত্বজ্ঞানহীন অংশ “আমি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে” মর্মে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই বক্তব্য মিথ্যা, ভিত্তিহীণ, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমি এই ধরণের হলুদ সাংবাদিকতার তীব্র নিন্দা জানাই। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আমি শীঘ্র যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার ইচ্ছা রাখি। সেনাসদর (আইএসপিআর) কতৃক এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট রিপোর্ট গণমাধ্যমে পাঠিয়ে জাতির কাছে বিষয়টি পরিষ্কার করবে বলে আমি আশা রাখি। বলা বাহুল্য, আমি নিজে সেনাসদরের সংশ্লিষ্ট কর্মকতাকে এ বিষয়ে অনুরোধ করেছি।
আমান আযমী লিখেছেন, বরখাস্ত পরবর্তী ৭ বছর ২ মাস (আমাকে অপহরণের পূর্ব পর্যন্ত) আমাকে গোয়েন্দা বাহিনীসমূহের অনেক হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। আমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী পরিচালক/ কনসালটেন্ট এর দায়িত্ব পালন করছিলাম। সকল কতৃপক্ষকে সরকার চাপ দিয়ে দিয়ে আমাকে সকল দায়িত্ন থেকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য করা হয়। পরবর্তীতে, ২০১৬ সালের ২২ আগস্ট আমাকে আমার বাসা থেকে অপহরণ করে ডিজিএফআই সদর দপ্তর, কচুক্ষেতে অবস্থিত তথাকথিত “আয়নাঘর” এ ২৯০৮ দিন (৬৯,৭৯৪ ঘন্টা) আটক রেখে আমার উপর সীমাহীন মানসিক নির্যাতন করা হয়। ৫ আগস্ট ২০২৪ এর বিপ্লবের মাধ্যমে (যা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত) দেশ ফ্যাসিবাদমুক্ত হলে সেই রাতেই আমাকে ঢাকা থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। ৭ আগস্ট ২০২৪ রাত আনুমানিক ১১:৪৫ মিনিটে যমুনা ব্রিজের নিকট এলেঙ্গা নামক স্থানে আমাকে রাস্তার পাশে নামিয়ে দেয়া হলে আমি বাসে করে ৮ তারিখ ভোরে আমার বাসায় ফিরে আসি। আমার এই বিবৃতির মূল উদ্দেশ্য শিরোনাম এ লেখা আছে। প্রসঙ্গক্রমে কিছু কথা বলতে হলো।
চিঠির শেষে তিনি লিখেছেন, ২৪ জুন ২০০৯ তারিখে আমাকে বরখাস্ত করা ন্যক্কারজনক আদেশ বাতিল করে গত ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে এক সরকারি প্রজ্ঞাপণ জারি করা হয়, যা সেনাসদর কতৃক ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে আমাকে অবহিত করা হয়। একই প্রজ্ঞাপণের দ্বারা ২৪ জুন ২০০৯ তারিখ হতে আমাকে অকালীন বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করে আমার অবসরের আর্থিক সুবিধাসহ অন্যান্য সকল সুবিধাদি প্রদান করা হয়। আমার উপর যেই সীমাহীন যুলুম করা হয়েছে তার কোন আর্থিক বা অন্য কোন প্রতিদান কোনদিনও সম্ভব নয়। আমার বৃদ্ধা, বিধবা ও অসুস্থ অসহায় মা প্রায় তিন বছর আমার শোকে কাঁদতে কাঁদতে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। পৃথিবীর সকল সম্পদ দিয়েও কি আমার মাকে ফিরিয়ে আনা যাবে? যা হোক, বিলম্বে হলেও আমার অবসরের এই আদেশ আমার উপর যে সীমাহীন নির্যাতন ফ্যাসিবাদ সরকার করেছে তার প্রতিদানের একটি অংশ (যতটুকুই হোক) হিসেবে বিবেচ্য।
আমার বরখাস্তের আদেশ বাতিল করে আমাকে অবসর প্রদানের এই আদেশ প্রদানের জন্য আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানকে আমার এবং আমার পরিবারের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এর জন্য মহান আল্লাহ্ আপনাদের উত্তম প্রতিদান দান করুন এই দোয়া করি।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) ২০০৯ সালের ২৪ জুন থেকে এই ‘অকালীন (বাধ্যতামূলক) অবসর’ কার্যকর ধরা হয়েছে বলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানায়।
এতে বলা হয়, ২০০৯ সালের ২৪ জুন থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমীকে প্রযোজ্য সব প্রকার আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধাসহ ‘অকালীন (বাধ্যতামূলক) অবসর’ দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে ইতিপূর্বে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ২০০৯ সালের ২৩ জুন জারিকৃত ওই কর্মকর্তার বরখাস্তের প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করা হয়েছে।