কলকাতায় বিকেল গড়িয়ে রাত

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

রাতের কলকাতা, ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর

রাতের কলকাতা, ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর

কলকাতা এলে আমি সচরাচর শহরের উত্তর দিকে অবস্থান করি এবং চেষ্টা করি এয়ারপোর্টের কাছাকাছি কোথাও থাকতে। সেন্ট্রাল কলকাতা বা দক্ষিণ কলকাতায় কাজ সেরে উত্তরেই ফিরে আসি। বিমান থেকে অবতরণ ও আরোহণ এবং আনুসাঙ্গিক যাতায়াতের ক্ষেত্রে যানজট, টেনশন ও দৌড়-ঝাঁপ কমানোর দিকটি মাথায় রেখে কলকাতা অবস্থানের বিষয়টি বিবেচনা করতে হয় আমাকে।

এবারও উত্তর ভারতের সোনালি ত্রিভুজে যাওয়ার পথে কয়েক ঘণ্টার জন্য কলকাতা থেকেছি শহরের উত্তরাংশে। ঠিক উত্তরাংশ বলা যাবে না জায়গাটিকে। বলতে হবে পূর্ব ঘেঁষা উত্তরাঞ্চল। দমদম-বাগুইহাটি আর সল্টলেক-নিউটাউনের মাঝামাঝি চিনার পার্ক থেকে চট করে এয়ারপোর্ট যাওয়া যায়। বাইপাস ধরে কেউ হলদিরাম হয়ে দেখা করতে আসতে পারেন সহজে। আমারও মূল শহরে যাতায়াতের সুবিধা হয়। ফলে যখনই কলকাতা এসেছি, এই এলাকাটিকেই বেছে নিয়েছি। চেনা-জানা লোকও আছেন এখানে প্রচুর। ফলে অজানা-অচেনার অস্বস্তি পোহাতে হয় না।

বিজ্ঞাপন

এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে হতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল শুরু হয়েছে। মহানগরের আকাশের নীলচে শরীরে শরতের ছোঁয়া। কিছুক্ষণ পর লালাভ আলো ছড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। রাজারহাট-চিনার পার্কের মোড়ে বাহারী আলোয় ঝলমল করছে বিপণি বিতান ও এভিনিউ। এনপিজি হোটেল পেরিয়ে আসতেই টের পেলাম কলকাতার দিন ও রাত্রির সন্ধিক্ষণ। পথের বিন্যাস ও শহরের গন্ধে অনুভব করা গেলো সমাগত উৎসবের আবাহন। কলকাতায় দুর্গাপূজা যে এক বিশাল উৎসব, সর্বত্র আয়োজন-প্রস্তুতির উৎসাহজনক নাগরিক উদ্দীপনার মধ্যে দেখা গেলো।

চট্টগ্রাম থেকে শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) মধ্য দুপুরের সংক্ষিপ্ত উড়ালপথে রিজেন্টের বিমান কলকাতায় পৌঁছাতে পাড়ি দিয়েছে ঘোলাটে আকাশ। সিডিউলেও হেরফের হয়েছে। 'সময় ঠিক রাখতে পারছে না বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান কোম্পানিগুলো'। প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করলেন কয়েকজন যাত্রী। কলকাতার রিজেন্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে উদাসীন ভাব দেখে বিরক্ত হলেন অনেক যাত্রী। ব্যবসা ক্রমশ প্রসারিত হলে সুনাম, দক্ষতা ও যাত্রীসেবার মানও যে তুলনামূলকভাবে বাড়িয়ে দিতে হয়, বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোর সে খেয়াল নেই। মনোপলির সুবিধা নিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা করার ফলে এদের মধ্যে গা ছাড়া ভাব এসেছে। বিদেশি বিমান সংস্থার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এ কারণেই এরা পিছিয়ে যাচ্ছে।

চট্টগ্রামের মতোই নিম্নচাপের কারণে কিছুটা মেঘলা ও গুমোট পরিবেশ কলকাতায়। কলকাতার আকাশে মেঘের আভাস। মেঘ ভেঙে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে অস্তায়মান সূর্য। বিচিত্র রঙের খেলায় আকাশে আলো ও ছায়ার দোলাচল চলছে। বিচিত্র স্কাইলাইনের আলোর প্রহর চলছে কলকাতার প্রাচীন আকাশে।

খানিক বিশ্রাম নিয়ে বাইরে এসেছি। এয়ারপোর্ট থেকে খোকন সঙ্গে আছে। আমাকে সঙ্গ দিয়ে জয়পুরের পথে রাতের বিমানে তুলে দেবে। খোকন লোকাল গাইডের কাজ করে। বাংলাদেশের লোকজনের ভ্রমণ, চিকিৎসার ব্যাপারে সে একজন এক্সপার্ট। ইতিমধ্যে বাংলাদেশপ্রেমী হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে এই তরুণ।

বাইরের আকাশের একদিক তখন নীল তো আরেক দিক থমথমে। পশ্চিমাকাশে আবির খেলায় শরতের বিখ্যাত দিগন্ত উঁকি দিচ্ছে বহুতলের ফাঁক গলে। নীল হারিয়ে কালো সিঁদুরে-মেঘের উদ্ভাস নিয়ে রাত নামলো কলকাতায়। আমরা পথে নেমেছি শেষ বিকেলের শরীরে মাখা সন্ধ্যা ছুঁয়ে।

আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে পুরো সপ্তাহ জুড়েই থেমে থেমে চলবে মেঘ ও বৃষ্টির দোলাচল। কলকাতাতেও মাঝে মধ্যে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। এরই মাঝে বাতাসে পূজার আমেজ স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে। চিনার পার্কের মোড়ে তন্দুরি চা বিক্রি হয়। কেসর দেওয়া চা এখানে বেশ বিখ্যাত। এক কাপ খেলে শরীর-মন চনমনে হয়। চা কাপে চুমুক দিতে দিতে চোখের সামনে নগরের প্রবাহমানতা দেখে কেটে গেল খানিক সময়।

চিনার পার্কের মোড়ে তান্দুরি চায়ের বিশেষ দোকানটির কথা এই ফাঁকে বলে রাখা যায়। বাইরে থেকে দোকানটি দেখতে আহামরি না হলেও চা বানায় খাসা। গত ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ‘ছায়ানট কলকাতা’র অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত বক্তা হিসাবে এসে চিনার পার্কে থেকেছি। তখন চা দোকানের পরিচালকদের সঙ্গে পরিচয় হয়। দুই ভাই চাকরি ও পড়াশোনার ফাঁকে দোকান চালায় বিকেল থেকে রাত অবধি। বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমে এদের নিয়ে লিখেছিলাম। কয়েক মাস পর আবার আমাকে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরল।

চা খাওয়ার সময়ের মধ্যে কাছের আটঘরা থেকে দেখা করতে এলো নওশের আলি, সেও ট্যুর অপারেট করে। নপাড়া থেকে এলো আকবর। দমদম গোরাবাজারের মোবারক ভাই এলেন। রবীন্দ্র ভারতী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.ফিল, পিএইচডি করে, এমন কয়েকজন ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীও এলো। ওদের নিয়ে ঘণ্টা খানেক সময় দিব্যি কেটে গেলো।

'বাঙালির প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এ উৎসবের জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেন। মহালয়া থেকেই নানা আয়োজন শুরু হয়ে যায়', বললেন অসীম দাস। চিনার পার্কের মোড়ে তার মোবাইল ফোনের শোরুম। রিচার্জ করতে করতে কথা হলো তার সাথে।

অসীম বাবু বললেন, 'সারা ভারতবর্ষের বাঙালি পূজার ছুটিতে কলকাতা চলে আসেন। অভিবাসী বাঙালিরাও আসেন পৃথিবীর নানা দেশ থেকে। কলকাতার দুর্গাপূজা মানেই বিরাট উৎসব। রাস্তায় ভিড়, হোটেলে জায়গা নেই। পূজায় কলকাতার আরেক রূপ উদ্ভাসিত হয়।'

চিনার পার্ক কলকাতার নতুন ও পুরনো অংশের সেতু বিশেষ। ভিআইপি রোড থেকে হলদিরামের মোড় দিয়ে চার্ণক্য হাসপাতালের সামনে দিয়ে খানিক এগিয়ে গেলে চিনার পার্ক চৌরাস্তা। একদিকে নিউটাউন-সল্টলেকের পথ। আরেক দিকে জোড়া মন্দির। অন্যদিকে আটঘরা-রাজারহাট-হাড়োয়া-ভাঙ্গুর।

চিনার পার্কে নামকরা চেইন শপ, ফুড আউটলেট গমগমে ভিড়। ভিড় নাকি আরও বাড়বে পূজার ছুটিতে। কেনাকাটায় আর বেড়ানোতে মেতে উঠবে তাবৎ কলকাতা। মহানগরের কল্লোলিনী রূপ আস্তে আস্তে খুলতে থাকবে উৎসবে, আনন্দে, আয়োজনে।

আগে কলকাতায় জনসংযোগের জন্য আমি বি.টি রোডের ডানলপের যেতাম। সেখানে বাংলাদেশ থেকে আসা বেশ কিছু শিক্ষার্থী বাস করতো। কয়েকজন তরুণ শিক্ষকও ছিল তাদের দলে। ফলে ওখানে সবাইকে হাতের কাছে পাওয়া যেতো। পরে কলকাতার মধ্যস্থলের বাবুঘাটের দিকে বসেছি। উত্তর ও দক্ষিণ দিকের বাসগুলো এখানে আসে এবং হাওড়া থেকে নদী পেরিয়ে কেউ কেউ চলে আসতে পারে।

এবার হাতে এতো সময় নেই। সবাইকে বলাও হয়নি। আড্ডা আর টুকিটাকি কাজ সারতে বিকেল গড়িয়ে রাত নেমে এসেছে। রাত সাড়ে দশটায় আবার ফিরে এলাম দমদম এয়ারপোর্টে। সাড়ে এগারোটায় ইন্ডিগো এয়ার জয়পুরের পথে উড়াল দেবে। শুরু হবে উত্তর ভারতের বিখ্যাত সোনালি ত্রিভুজ ভ্রমণ।