কলকাতায় অনুষ্ঠিত হলো বাংলা কবিতা উৎসব
কলকাতা: কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাংস্কৃতিক খবর সাহিত্যপত্রের আয়োজনে ৩৪ ও ৩৫তম বাংলা কবিতা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গত ৪ ডিসেম্বর। অনুষ্ঠানটির উদ্বোধন করেন কবি কমল দে সিকদার।
উদ্বোধন করে কবি কমল দে সিকদার বলেন, এত বছর ধরে একক উদ্যোগে একটা লিটিল ম্যাগাজিন কীভাবে চালাচ্ছেন সম্পাদক কাজল চক্রবর্তী ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, শুধু তাই নয় এই পত্রিকার প্রায় প্রতিটি সংখ্যা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এত সমৃদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হয়, সচেতন পাঠক সংগ্রহে রাখতে বাধ্য হন। আরও বিস্ময়ের জায়গা এই যে একটা লিটিল ম্যাগাজিন কী করে পাঁচ হাজার টাকা অর্থমূল্যের সাহিত্য-পুরস্কার দেয়।
উৎসবের শুরুতে পৃথিবীজুড়ে কোভিডে মৃত মানুষদের স্মরণে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
উৎসবটি হওয়ার কথা ছিল ৪ ও ৫ ডিসেম্বর। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে একদিনে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। সূচনা হয়েছিলো ১৯৮৭ সালের ২০ ডিসেম্বর। ভারত-বাংলাদেশের কবিদের নিয়ে এই উৎসব হয়ে আসছে। এ বছর সল্টলেকের পূর্বশ্রী প্রেক্ষাগৃহে কোভিড বিধি মেনে অনুষ্ঠিত হলো ৩৪-৩৫তম বাংলা কবিতা উৎসব।
প্রধান অতিথি রথীন কর তার অভিভাষণে বলেন, কাজল চক্রবর্তীর এসব কাজের পাশাপাশি যে কাজটি আমাকে মুগ্ধ করে সেটি হলো বিভিন্ন ব্যক্তিকে নিয়ে সম্পাদিত প্রামাণ্য গ্রন্থগুলো।
সাংস্কৃতিক খবরের ১৭৪তম উৎসব সংখ্যাটির আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন করেন মাসুদ করিম এবং কাজল চক্রবর্তীর হাইকু কাব্যগ্রন্থটির আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন করেন কবি রুনা রায়।
সম্পাদকের কিছুকথা বলতে গিয়ে কাজল চক্রবর্তী জানান, ১৯৯৬ সাল থেকে পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র আমাদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রেক্ষাগৃহ দিয়ে সহযোগিতা করে আসছে। আপনারা জানেন শহর কোলকাতায় এক বছর আগেই কোন হল পাবার নিশ্চয়তা কেউ জোগাড় করতে পারে না। পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র আমাদের জন্য সেটা করে, আমি আজ জানিয়ে রাখছি আগামী বছরের ডিসেম্বর মাসের প্রথম রোববার ৩৬তম বাংলা কবিতা উৎসব হবে এখানেই। এবছরে উৎসব দুদিন হবার কথাছিলো, প্রকৃতি যে দুর্যোগের ঘনঘটা আমাদের মাতিয়ে রেখেছে, সেখানে আগামীকাল উৎসবের ঘোষণা ফিরিয়ে নিলাম। আজকেই ৩৪-৩৫তম বাংলা কবিতা উৎসব শেষ হবে। আপনারা ভাবতেই পারেন কবিতা হলো একান্তে পাঠের বিষয়, সেখানে উৎসব কেন? হ্যাঁ আমিও আপনাদের সঙ্গে সহমত, কবিতা নিয়ে উৎসব হয় না তবে এই ‘উৎসব’ শব্দটি কেন? উৎসব শব্দটি আমাদের বিভিন্ন কবির স্বকণ্ঠের সঙ্গে পরিচয় ঘটায়, আর যেটা হয় সেটা মেলবন্ধন। মাতৃভাষার দেশ বাংলাদেশ থেকে যারা এসেছেন তারা আমাদের ভালোবেসে নিজ দায়িত্বে এসেছেন। আমার সামান্য সামর্থে আমি বাংলাদেশের কবিদের এক হাজার টাকা ও পশ্চিমবাংলার কবিদের ২শ’ টাকা দিয়ে সঙ্গে স্মারক, সাংস্কৃতিক খবরের উৎসব সংখ্যা দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবো।
বাংলা কবিতা উৎসবে প্রদত্ত হয় সাংস্কৃতিক খবর পদক’, ‘বিষ্ণু দে পুরস্কার’ ও ‘সমীর চন্দ পুরস্কার’। ভিসার জটিলতার কারণে কবি মাহমুদ কামাল ও কবি সাবেদ আল সাদ ২০২১ সালের ‘বিষ্ণু দে পুরস্কার (২০২১)’ নিতে আসতে পারেননি। একই কারণে ‘সাংস্কৃতিক খবর পদক (২০২১) গ্রহণ করতে পারেন নি কবি ও সাংবাদিক আবদুর রশীদ চৌধুরী। ২০২০ সালের ‘বিষ্ণু দে পুরস্কার গ্রহণ করেন কবি গৌরশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রহণ করে তিনি জানান, পেশায় চিকিৎসক হলেও আমাদের সাহিত্যের পাঠ নিতে হতো, সেই পাঠ নিতে গিয়ে আমি শ্রদ্ধেয় কবি বিষ্ণুদের ছাত্র ছিলাম একসময়, তার নামাঙ্কিত এই পুরস্কার আমাকে আরো ভালো লেখার প্রেরণা জোগাবে। সাংস্কৃতিক খবর পদক (২০২০) প্রতিনিধি মারফৎ গ্রহণ করেন কবি স্বপন রায়।
উৎসব মঞ্চে এবছর প্রথম প্রদান করা হয় ‘সমীর চন্দ পুরস্কার-২০২১’। এই পুরস্কার প্রবর্তনের বিষয়ে সাংস্কৃতিক খবর সম্পাদক কাজল চক্রবর্তী জানান, সমীর আমার স্কুলের বন্ধু, স্কুলের পাঠ শেষ করে সমীর আর্ট কলেজে ভর্তি হয়। শৈশব থেকেই ওর আঁকার প্রতি ঝোক ছিলো সেটা আভিধানিক হয় আর্ট কলেজের পাঠান্তে। একসময়ে বোম্বের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে বিখ্যাত আর্ট ডিরেকটার হিসেবে নিজের জায়গা করে নেয় সমীর। ওর জীবদ্দশায় সর্বশেষ শিল্প নির্দেশিত ফিল্ম দুটি হলো ‘রাবন’ ও ‘মনের মানুষ’। ওঁর অকাল প্রয়াণে এবছর থেকে ‘সমীর চন্দ পুরস্কার’ চালু হলো। এই পুরস্কার গ্রহণ করেন মাসুদ করিম ড. আনিসুজ্জামানকে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র ‘বাতিঘর’র জন্য।
পুরস্কার গ্রহণ করে তিনি জানান, সমীর চন্দ পুরস্কার অবশ্যই আমাকে আরো ভালো কাজ করতে প্রেরণা দেবে। ধন্যবাদ জানাচ্ছি সাংস্কৃতিক খবরকে আমাকে নির্বাচন করার জন্য। পরের পর্বে বাংলাদেশ থেকে আগত চারজন কবি জরিনা আখতার, নাসরীন সুলতানা, সৈয়দা নাজনীন আখতার, ইসমত জেরিন স্মিতা একসঙ্গে মঞ্চে ওঠেন। জরিনা শুরু করেন কবিতা, কানে জেগে থাকে সেই অমোঘ লাইন ‘রঙিন ঘুড়ি ওড়াতে চায় মন’। ইসমত জেরিন স্মিতা একপা এগিয়ে বলেন, “সময়কে আলিঙ্গন করে সে আমার প্রেম।
পরের পর্বে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের জেলার কবিরা মঞ্চে উঠে আসেন। সৌমিত বসু কবিতা পড়াবার আগে জানান, যে সময়ে মুড়িমুড়কির মতো কবিতা নিয়ে উৎসব হতো না সেইসময়ে এই কবিতা উৎসব ছিলো, আজ এত বছর ধরে চলমান এই উৎসবে ইতিহাস জড়িয়ে আছে। ইতিহাসের অন্য দিকটা এইরকম আমাদের আশির দশককে একা সাংস্কৃতিক খবরের সম্পাদক কাজল চক্রবর্তী পাদপ্রদীপের আলোয় এনেছে, কাজলের উপন্যাস, গল্প, কবিতা কতদূর কী থাকবে সেটা আমরা কেউই জানি না, মহাকাল জানে, কিন্তু যেটা আমরা জানি আশির দশকের জন্য কাজলের এই পরিশ্রম সবাই মনে রাখতে বাধ্য। একে একে আশির দশকের সুমিত্রা দত্তচৌধুরী, অলোক বিশ্বাস, অদীপ ঘোষ, গৌতমকুমার দে, কাশীনাথ দাস চাকলাদার, পীযূষ বাকচি, পঙ্কজ মন্ডল প্রায় এক রকমের কথা বলেন, পড়েন কবিতা।
পরের পর্বে মঞ্চে আসেন অমল কর, বিমল রায়, সসীমকুমার বাড়ৈ, খগেশ্বর দাস, রুহুল আমিন হক মন্ডল, অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়, নবনীতা বসু হক, তাজিমুর রহমান, ভবানীশংকর চক্রবর্তী ও মোহাম্মদ সাদউদ্দীন।
শেষের ঠিক আগের পর্বে কবিতা পড়েন দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায়, অভিজিৎ বিশ্বাস, শ্রী পিনাকী রায়, অনিমেষ চন্দন, শঙ্খশুভ্র পাত্র, শোভন বিশ্বাস, সন্দীপ জানা, অনিন্দিতা মুখার্জী সাহা, অনিমেষ রায়, মৃন্ময় ভৌমিক, শ্রীরাজীব দত্ত, মধুবন চক্রবর্তী, রীতা বেরা পাল ও প্রলয় বসু। সকলেই কবিতা পাঠে স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন। শেষ পর্বে মঞ্চে আসেন সল্টলেকের বাসিন্দা কবি রথীন কর, ইমানুল হক, অনিল দা ও কাজল চক্রবর্তী। প্রত্যেকেই তাদের পাঠে ছিলেন অনন্য। এঁদের কবিতা পাঠের আগে মঞ্চে আসীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিব (প্রেস) শ্রী রঞ্জন সেনকে ফলক, পত্রিকা ও গ্রন্থ দিয়ে বরণ করে নেন রীতা বেরা পাল।
উৎসব উদ্বোধনের কথা ছিলো শ্রী সেনের, বিশেষ কাজে আটকে পড়ায় তিনি দেরিতে আসেন। তার শুভেচ্ছা ভাষণে জানান, আমি এই রকম উদ্যোগে সামিল হতে পেরে খুশি, বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সুযোগ্য কন্যা আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে বর্তমান বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে, সেই রাষ্ট্রটির ভাষাও বাংলা। এটাও বাংলা কবিতা উৎসব। এখানে বাংলাদেশের কবিদের উপস্থিতির কথাও জানলাম। আমি একটা বিশেষ কাজে আটকে পড়ায় সময়মতো আসতে পারিনি, আমাকে মার্জনা করবেন। আমি এই বাংলা কবিতা উৎসবের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করছি।
ঘড়ির কাটা সে সময়ে রাত ৮টা পার করে ফেলেছে, উৎসব শেষ করার আগে কাজল চক্রবর্তী উপস্থিত সকলকে মঞ্চে ডেকে নেন, কবি নাসরীন সুলতানার আনা ঢাকার মিষ্টি দিয়ে সকলকে আপ্যায়ন করে ৩৪ ও ৩৫তম বাংলা কবিতা উৎসব শেষ হয়।