কোরবানির আমলের ধারাবাহিকতা ও বাধ্যবাধকতা
কোরবানির ইতিহাস ততটাই প্রাচীন যতটা প্রাচীন মানব অথবা ধর্মের ইতিহাস। কোরবানি হজরত আদম আলাইহি সালামের পর থেকে মানবজাতির প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত সকল শরিয়তেই কার্যকর ছিলো। সকল নবীর উম্মতের মধ্যেই অবিচ্ছিন্নভাবে কোরবানির ধারাবাহিকতা চলে আসছে তথা সকল নবীর উম্মতকেই কোরবানি করতে হয়েছে। প্রত্যেক নবীর উম্মতের ইবাদতের এ ছিল একটা অপরিহার্য অংশ।
মানবসভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয় যে, পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায় কোনো না কোনোভাবে আল্লাহর দরবারে নিজেদের প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করে। এটাই মানুষের চিরন্তন স্বভাব। এই স্বভাবের স্বীকৃতি প্রদান করে আল্লাহতায়ালা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির এক বিশেষ রীতি-পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন (সে উম্মতের) লোকেরা সে পশুদের ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যে সব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন।’ -সূরা হজ: ৩৪
আমাদের কোরবানি সুন্নতে ইবরাহিমি
আমাদের ওপর যে কোরবানির নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলত হজরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক শিশুপুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) কে আল্লাহর রাহে কোরবানি দেওয়ার অনুসরণে ‘সুন্নতে ইবরাহিমি’ হিসেবে চালু হয়েছে।
মক্কা নগরীর জনমানবহীন ‘মিনা’ প্রান্তরে আল্লাহর দুই আত্মনিবেদিত বান্দা হজরত ইবরাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.) আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তুলনাহীন ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, বর্ষপরম্পরায় তারই স্মৃতিচারণ হচ্ছে- ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। হজরত ইবরাহিম (আ.) যেমন আল্লাহর নির্দেশে জীবনের সবচাইতে প্রিয় বস্তু পুত্র ইসমাইলকে তার উদ্দেশ্যে কোরবানি করতে প্রস্তুত ছিলেন, ঈদুল আজহার দিন মুসলমানরাও তেমনি পশু কোরবানির মাধ্যমে নিজেদের প্রিয়তম জানমাল আল্লাহর পথে কোরবানি করার সাক্ষ্য প্রদান করেন। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সেই মহত্ত্ব ও মাকবুল কোরবানিকে শাশ্বত রূপদানের জন্যই আল্লাহতায়ালা ও তার রাসূল (সা.) এই দিনে মুসলমানদেরকে ঈদুল আজহা উপহার দিয়েছেন এবং কোরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন।
হজরত ইবরাহিম (আ.) কে স্বপ্নের মাধ্যমে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়। তিনি স্বপ্নযোগে তার সবচেয়ে প্রিয়বস্তু কোরবানি দেওয়ার জন্য আদিষ্ট হন। কোনো কোনো বর্ণনা মতে জানা যায়, এই স্বপ্ন হজরত ইবরাহিম (আ.) পরপর তিন রাত্রি দেখেছিলেন। প্রথমবার তিনি ১০টি উট কোরবানি করেন। আবারও একই স্বপ্ন দেখলে এবার তিনি ১০০টি উট কোরবানি করলেন। তৃতীয়বার যখন একই স্বপ্ন দেখলেন তখন তিনি বুঝতে পারলেন, আমার কাছে প্রিয়বস্তু একমাত্র কলিজার টুকরা সন্তান ইসমাইল ছাড়া তো আর কিছুই নেই। মূলত আল্লাহতায়ালার ইচ্ছাও তাই। প্রাণপ্রিয় পুত্রকে কোরবানি করার নির্দেশ তাকে এমন সময় দেওয়া হয়েছিল, যখন অনেক দোয়া কামনা করে পাওয়া সন্তানকে লালন-পালন করার পর পুত্র পিতার সঙ্গে চলাফেরা করতে পারে এবং তাকে সাহায্য করার যোগ্য হয়েছে। তাফসিরবিদগণের কেউ কেউ লিখেছেন, এ সময় হজরত ইসমাইলের বয়স ছিল তেরো। কেউ বলেছেন তিনি তখন বয়প্রাপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তবে তাফসিরে রুহুল বয়ানে আছে ৯ বছরের কথা।
এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত সত্য যে, নবী-রাসূলগণের স্বপ্নও অহির অন্তর্ভুক্ত। স্বপ্নে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর একমাত্র পুত্রকে জবেহ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ হুকুমটি স্বপ্নের মাধ্যমে দেওয়ার কারণ হলো- হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আনুগত্যের বিষয়টি পূর্ণমাত্রায় প্রমাণিত করা। হজরত ইবরাহিম (আ.) মহান প্রতিপালকের নির্দেশ সত্বর পালনের নিমিত্তে যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন।
কিন্তু এ পরীক্ষাটি যেহেতু ইবরাহিম (আ.)- এর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সঙ্গে তার পুত্রও সংশ্লিষ্ট ছিলেন- তাই তিনি পুত্র ইসমাইলের সঙ্গে পরামর্শ করার নিমিত্তে তাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখি তোমাকে আমি জবেহ করছি, এখন বলো, তুমি কি মনে করো?’ -সূরা আস সাফফাত: ১০২
হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আদর্শের ছাঁচে গড়া পুত্র ইসমাইল তৎক্ষণাৎ আত্মসমর্পণে মস্তক অবনত করে জবাবে বললেন, ‘হে আব্বাজান! আপনাকে যা হুকুম দেওয়া হচ্ছে তা করে ফেলুন, আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ সবরকারীই হিসেবে পাবেন।’ -সূরা আস সাফফাত: ১০২
এরপর পিতা ও পুত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে কোরবানির নির্দেশ পালনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং এ কাজ সমাধার জন্য তারা মিনা প্রান্তরে গমন করেন। ইতিহাস ও তাফসিরভিত্তিক কোনো কোনো রেওয়ায়েত থেকে জানা যায়, শয়তান কোরবানির মহান এ কাজে বিভিন্নভাবে বাধার সৃষ্টি করে। সে প্রথমে মা হাজেরা ও ইসমাইল (আ.)-কে উল্টো বুঝিয়ে এ থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু তারা শয়তানের প্ররোচণাকে কোনো পাত্তা দিলেন না। মরদুদ শয়তান হজরত হাজেরা (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.)-কে ধোঁকা দেওয়া থেকে নিরাশ হয়ে মদিনা যাওয়ার পথে তিন জায়গায় তিনবার হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে এবং হজরত ইবরাহিম (আ.) তাকে প্রত্যেকবারই সাতটি করে কঙ্কর নিক্ষেপের মাধ্যমে তাড়িয়ে দেন। অদ্যাবধি এ প্রশংসনীয় কাজের স্মৃতিস্বরূপ মিনায় ওই তিনটি স্থানে কঙ্কর নিক্ষেপ করার বিধান হাজিদের জন্য ওয়াজিব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
অবশেষে পিতা-পুত্র উভয়ে যখন কোরবানির উদ্দেশে মিনায় গিয়ে পৌঁছলেন এবং ইবরাহিম (আ.) ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করার জন্য শোয়ালেন, তখন পুত্র ইসমাইল পিতা ইবরাহিম (আ.) কে বললেন, আব্বাজান! আমার হাত-পা খুব শক্ত করা বেঁধে নিন যাতে আমি নড়াচড়া করতে না পারি। আর আপনার পরিধেয় বস্ত্রাদি সামলে নিন, যাতে আমার রক্তের ছিটা তাতে না পড়ে। অন্যথায় এতে আমার সওয়াব হ্রাস পেতে পারে। এ ছাড়া রক্ত দেখলে আমার মা অধিক ব্যাকুল হয়ে যেতে পারেন। আপনার ছুরিটি ভালো করে ধার দিয়ে নিন এবং আমার গলায় দ্রুত চালাবেন, যাতে আমার প্রাণ সহজে বের হয়ে যায়। আপনি আমার আম্মাজানের নিকট আমার শেষ বিদায়ের সালামটুকু অনুগ্রহপূর্বক পৌঁছে দেবেন। যদি আমার জামা তার নিকট নিয়ে যেতে চান, তবে নিয়ে যাবেন। একমাত্র আদরের সন্তানের মুখে এমন কথা শুনে পিতার মানসিক অবস্থা কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
কিন্তু হজরত ইবরাহিম (আ.) দৃঢ়তায় অটল পাহাড় হয়ে জবাব দিলেন, ওগো আমার প্রাণপ্রিয় বৎস! আল্লাহর নির্দেশ পালন করার জন্য তুমি আমার চমৎকার সহায়ক হয়েছো। হজরত ইবরাহিম (আ.) পুত্রকে আদর করে চুম্বন করলেন এবং অশ্রুসজল নয়নে তাকে বেঁধে নিলেন। অতঃপর তাকে সোজা করে শুইয়ে দিয়ে তার গলায় ছুরি চালালেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার যে, বারবার ছুরি চালানো সত্ত্বেও গলা কাটছে না। কেননা আল্লাহতায়ালা স্বীয় কুদরতে পিতলের একটা টুকরা মাঝখানে অন্তরায় করে দিয়েছিলেন। তখন পুত্র নিজেই আবদার করে বললেন, আব্বাজান! আমাকে উপোড় করে শুইয়ে নিন। কারণ আমার মুখমন্ডল দেখে আপনার মধ্যে পিতৃস্নেহ উথলে ওঠে। ফলে গলা কাটা যাচ্ছে না। হজরত ইবরাহিম (আ.) তাকে উপোড় করে শুইয়ে দিলেন এবং পুণরায় সজোরে প্রাণপণে ছুরি চালালেন। কিন্তু তখনও গলা কাটছে না। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর এ প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা প্রত্যক্ষ করে মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট হলেন এবং হজরত ইসমাইলের বিনা জবেহেই তার কোরবানি কবুল করে নিলেন।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘অবশেষে যখন পিতা-পুত্র উভয়ে আল্লাহর কাছে নিজেদের আনুগত্যের শির নত করে দিলেন এবং ইবরাহিম (আ.) পুত্রকে উপোড় করে শুইয়ে দিলেন (জবেহ করার জন্য), তখন আমরা তাকে সম্বোধন করে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছো। আমরা সৎকর্মশীলদের এরূপ প্রতিদানই দিয়ে থাকি। বস্তুত এ এক কঠিন পরীক্ষা। আর আমরা বিরাট কোরবানি দিয়ে ফিদিয়াস্বরূপ তাকে (ইসমাইলকে) উদ্ধার করেছি।’ -সূরা আস সাফফাত: ১০৩-১০৭
অতঃপর মহান আল্লাহ নির্দেশ দিলেন এখন পুত্রকে ছেড়ে দিন এবং আপনার নিকট যে দুম্বাটি দাঁড়ানো রয়েছে, পুত্রের পরিবর্তে সেটাকে জবেহ করুন। তখন ইবরাহিম (আ.) পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখেন একটি হৃষ্ট-পুষ্ট দুম্বা দাঁড়ানো আছে। আল্লাহর শোকর আদায় করে তিনি সে দুম্বাটিকে জবেহ করলেন। এটাই সেই কোরবানি যা আল্লাহর দরবারে এতই প্রিয় ও মাকবুল হয়েছিল যে, আল্লাহতায়ালা পরবর্তী সকল উম্মতের মধ্যে তা অবিস্মরণীয় রূপে বিরাজমান রাখার ব্যবস্থা করে দিলেন। যার কারণে মিল্লাতে ইবরাহিমে তথা দ্বীন ইসলামের এক মহান ওয়াজিব ইবাদত হিসেবে এ কোরবানি আজও পালিত হয়ে আসছে।
আল্লাহু আকবার তাকবিরের প্রেক্ষাপট
মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজরত ইবরাহিম (আ.) যখন কলিজার টুকরা পুত্রের গলায় ছুরি চালাতে লাগলেন, তখন হজরত জিবরাইল (আ.) আল্লাহর নির্দেশে বেহেশত থেকে একটা দুম্বা নিয়ে রওনা হলেন। তিনি ভাবলেন, না জানি আমি পৃথিবীতে পৌঁছার আগেই ইবরাহিম (আ.) জবাই কাজ শেষ করে দেন! আর এ জন্যই জিবরাইল (আ.) আকাশ থেকে উচ্চস্বরে ধ্বনি দিতে থাকেন, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। এমন মধুর ধ্বনি শুনে হজরত ইবরাহিম (আ.) স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠলেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার। হজরত ইসমাইল (আ.) পিতার মুখে তাওহিদের বাণী শুনতে পেয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠলেন, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ। হজরত জিবরাইল (আ.) এবং দুই নবীর কালামগুলো আল্লাহর কাছে এতই পছন্দনীয় হলো যে, কিয়ামত পর্যন্ত ঈদুল আজহা এবং ঈদুল ফিতরের দিনগুলোতে বিশ্ব মুসলিমের কণ্ঠে ওই কালামগুলো উচ্চারিত হতে থাকবে।