বিনয় সৌভাগ্যের সোপান

  • মুফতি জাওয়াদ তাহের, অতিখি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মুমিনরা সহজ-সরল, বিনয়ী ও স্বভাবে নম্র হয়, ছবি: সংগৃহীত

মুমিনরা সহজ-সরল, বিনয়ী ও স্বভাবে নম্র হয়, ছবি: সংগৃহীত

প্রকৃতিগতভাবে ফুলকে সবাই ভালোবাসে। কেন ফুলকে সবাই ভালোবাসে, এর নির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই। তবে, ফুল মানুষকে সুবাস বিলায়, মনে আনন্দ জোগায়, বিষন্ন মনে শান্তির পরশ বিলিয়ে দেয়। ফুলের সুঘ্রাণ নিস্তেজ শরীরকে করে তোলে প্রাণবন্ত। এ থেকে বুঝা যায় সুন্দরের প্রতি মানুষের তীব্র আকর্ষণ রয়েছে। তাই নিজের অজান্তে তার প্রতি ভালোবাসা জন্মে।

ফুলের মতো বিনয় মানুষের সৌন্দর্য। বিনয়ী মানুষকে সবাই ভালোবাসে। বিনয় মানুষের ভূষণ আর ভদ্রতা ও নম্রতার সহায়ক। বিনয় দ্বারা ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, এমনকি বিশ্ব বিজয়ও। যার মধ্যে যত বেশি বিনয় পাওয়া যাবে, সে তত বেশি সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। কারণ, বিনয় দ্বারা অন্যের চোখে ভালোবাসার সৌধচূড়া নির্মাণ করা যায়। বিনয়ী ব্যক্তিকে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা ভালোবাসেন। বিনয়ী ব্যক্তি হাশরের মাঠেও পাবেন বিশেষ মর্যাদা।

বিজ্ঞাপন

হাদিসের ভাষায়, ‘সার্মথ্য থাকা সত্ত্বেও আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে বিনয়ের পোশাকে যে নিজেকে আবৃত করবে, আল্লাহতায়ালা কিয়ামতের ময়দানে তাকে ডেকে সব সৃষ্টির সামনে নিয়ে আসবেন এবং তাকে তার পছন্দমতো একজোড়া ঈমানের পোশাকে সুসজ্জিত করে সাজাবেন।’ –সুনানে তিরমিজি: ২৪৮১

বিনয় বলা হয় কাজে-কর্মে, আচরণ-উচ্চারণে আমিত্ব ভাবকে দমন করা। নিজের মাঝে যে সব গুণাবলী ও যোগ্যতা রয়েছে আল্লাহর দয়া ও দান মনে করা। নিজের কোনো কৃতিত্ব ও বাহাদুরি মনে না করা। নিজের গুণাবলীকে তুচ্ছ ও অর্থহীন মনে করার নাম কিন্তু বিনয় নয়।

বিজ্ঞাপন

আল্লাহতায়ালা বিনয়ী ব্যক্তির প্রশংসায় বলেন, ‘রহমানের বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সঙ্গে যখন মূর্খরা কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে, সালাম (শান্তি)। -সূরা আল ফুরকান: ৬৩

তারা পৃথিবীতে নম্রতা সহকারে চলাফেরা করে। গর্বভরে চলে না, অহংকারীর মতো পা ফেলে না। অহংকারের সঙ্গে বুক ফুলিয়ে পথ চলে না। গর্বিত স্বৈরাচারী ও বিপর্যয়কারীর মতো নিজের চলার মাধ্যমে নিজের শক্তি প্রকাশ করার চেষ্টা করে না। বরং তাদের চাল-চলন হয় একজন ভদ্র, মার্জিত ও সৎস্বভাবসম্পন্ন ব্যাক্তির মতো।

হজরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইরশাদ করতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিনয় অবলম্বন করে, আল্লাহতায়ালা তাকে উঁচু করেন। ফলে সে নিজের চোখে ও নিজের ধারণায় ছোট হয় কিন্ত মানুষের দৃষ্টিতে সে উঁচু। আর যে অহংকার করে আল্লাহতায়ালা তাকে নীচু করে দেন। ফলে সে মানুষের চোখে ছোট হয়ে যায়, যদিও সে নিজের ধারণায় বড় হয়। এমনকি সে মানুষের দৃষ্টিতে কুকুর ও শূকুরের চাইতে নিকৃষ্ট হয়ে যায়।’ -শোয়াবুল ঈমান: ৭৭৯০

হাদিসের মাঝে একটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, ‘তাওয়াযায়া লিল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর জন্য বিনয়। এই মহৎ গুণটি একমাত্র আল্লাহর জন্য হতে হবে। আমাদের মাঝে অনেক বিনয়ী মানুষ পাওয়া যায়, কিন্তু উদ্দেশ্য আল্লাহ নয়; বরং অন্যকোন দুনিয়ার হীন স্বার্থ। এর দ্বারা কখনও সে আল্লাহর কাছে সম্মানিত হতে পারবে না। বরং এটি অহংকারের ভিন্ন রূপ।

আমাদের সমাজে বাহ্যত বেশভূষায় বিনয়ী মানুষে ভরে গেছে। এর দ্বারা নতুন নতুন ফেতনা সৃষ্টি হয়। বিনয়ের মূল উদ্দেশ্য ব্যহত হয়। নামের শুরুতে অধম লেখলেই বিনয়ী হওয়া যায় না, বরং তা অন্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

বিনয়ী ব্যক্তিদের মর্যাদা সম্পর্কে অসংখ্য আয়াত ও হাদিস বর্ণিত হয়েছে। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে, সৎকর্ম করেছে এবং বিনীত হয়েছে তাদের রবের প্রতি, তারাই জান্নাতবাসী, তারা সেখানে স্থায়ী হবে।’ -সূরা হুদ: ২৩

হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ করেছেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে জানাবো না যে, কারা জাহান্নামের জন্য হারাম বা কার জন্য জাহান্নাম হারাম করা হয়েছে? জাহান্নাম হারাম আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী প্রত্যেক বিনয়ী ও নম্র লোকের জন্য।’ –সুনানে তিরমিজি: ২৪৮৮

হজরত নবী করিম (সা.) ছিলেন বিনয়ের সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন। তাইতো নবীর কণ্ঠে বারবার বিনয়ের বাণী উচ্চারিত হয়েছে। আম্মাজান হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘হে আয়েশা! আল্লাহতায়ালা অতি নম্র ব্যবহারকারী। সুতরাং তিনি নম্রতা ভালোবাসেন। তিনি নম্রতার জন্য এমন কিছু দান করেন যা কঠোরতার জন্য দান করেন না, এমনকি অন্য কিছুর জন্যও তা দান করেন না।’ –সহিহ মুসলিম: ৬৩৬৫

আমাদের নিকট অতীতের বরেণ্যরা ছিলেন সেই হাদিসের জীবন্ত নমুনা। এক কথায়, মুমিনরা সহজ-সরল, বিনয়ী ও স্বভাবের নম্র হয়। ঠিক যেন লাগাম দেওয়া উটের মতো, তাকে টানা হলে চলতে শুরু করে এবং পাথরের ওপরে বসতে ইংগিত করলে বসে যায়।

মুফতি জাওয়াদ তাহের: সিনিয়র মুদাররিস, জামিয়া বাবুস সালাম, বিমানবন্দর, ঢাকা- ১২৩০