মৌমাছির জীবন থেকেও রয়েছে শেখার অনেক কিছু

  • মুফতি জাওয়াদ তাহের, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মৌমাছির চাক, ছবি: সংগৃহীত

মৌমাছির চাক, ছবি: সংগৃহীত

কঠিন বিষয়কে সহজ করে বুঝানোর জন্য উপমা দেওয়া হয়। কারণ উপমা দ্বারা দ্রুত দুর্বোধ্য বিষয় উপলব্ধি করা যায়। ভাবাতুর বিষয়কে চাক্ষুষ করে তোলে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের বিভিন্ন বিষয়ে উপমা দিয়ে বুঝিয়েছেন। পরকালের ভয়ংকর দৃশ্যকে উপমার মাধ্যমে চিত্রায়িত করেছেন। হাদিসে এমন কিছু উপমা রয়েছে যেগুলো নিয়ে ভাবলে মুমিনের ঈমানে জোয়ার আসে। এমনি একটি উপমা হচ্ছে মৌমাছি ও মুমিনকে নিয়ে।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ওই সত্তার শপথ- যার পবিত্র হস্তে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন, নিশ্চয়ই মুমিনগণ হলো- মৌমাছির মতো। উত্তম জিনিস খায় উত্তম জিনিস তার পেট থেকে বের হয়। সে (ফুলের) ওপর বসে এবং তাকে নষ্ট কিংবা ভেঙে ফেলে না। -মুসনাদে আহমদ: ৬৮৭২

বিজ্ঞাপন

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মুমিনের উপমা দিয়েছেন মৌমাছির সঙ্গে। মানুষের জীবন আর মৌমাছির জীবনচক্রের মাঝে চমৎকার কিছু মিল রয়েছে। মৌমাছির চরিত্র, আচরণ এবং কর্মকাণ্ডে অসাধারণ মিল রয়েছে। একটু সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে চিন্তা করলে খুঁজে পাবো।

আমিরের অনুসরণ ও আনুগত্য
সুষ্ঠু সমাজ গড়তে আমিরের অনুসরনের বিকল্প নেই। যোগ্য, সৎ ও আদর্শবান নেতা ব্যতিত কোনো আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা হতে পারে না। তাই পরিবার, সমাজ, দল ও রাষ্ট্র নিখুঁতভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্ব। যার পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনায় পরিচালিত হবে পরিবার, সমাজ, দল বা রাষ্ট্রের লোকজন। এই আনুগত্যের মাধ্যমে সমাজে শান্তির সুবাতাস বইবে। প্রতিটি মৌচাকে একজন রাণী থাকে, যার নেতৃত্বে অন্য মাছিরা চলে। নিজেদের সম্পূর্ণরুপে তার কাছে সোপর্দ করে দেয়। সে যেভাবে পরিচালনা করে, সেটাই তাদের নিয়ম। তদ্রুপ প্রকৃত মুমিনরা তাদের নেতাকে পূর্ণরুপে আনুগত্য করে। নিজেদের মাঝে বিবাদ করে না। সম্প্রতি ও সৌহর্দ্য বজায় চলে।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য করো, নির্দেশ মান্য করো রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়ো, তাহলে তা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ করো- যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের ওপর বিশ্বাসী হয়ে থাকো। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।’ -সূরা নিসা: ৫৯

উৎকৃষ্ট জিনিস ভক্ষণ করে
মৌমাছি যেকোনো জায়গা থেকে মধু আহরণ করে না। অপবিত্র ও অপরিচ্ছন্ন জায়গায় বসে না। পবিত্র জিনিস সে আহরণ করে। তেমনি একজন মুমিন ও তার অন্তর স্বচ্ছ, ঈমানের আলোয় আলোকিত; অন্তর কলুষমুক্ত। আর তার বিশুদ্ধ অন্তর উৎকৃষ্ট জিনস পছন্দ করবে। তখন তার উপার্জন, তার কথা, ইবাদত-বন্দেগি, খাবার পানীয় ও পরিধান করার আসবাবপত্র সব হবে পবিত্র। যা হাদিসে এসেছে। সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূল (সা.) বলেছেন, হে লোক সকল! আল্লাহতায়ালা পবিত্র। তিনি পবিত্র জিনিস ছাড়া অন্যকিছু কবুল করেন না। আল্লাহ তার রাসূলদের যেসব বিষয়ের হুকুম দিয়েছেন, মুমিনদেরও সেসব বিষয়ের হুকুম দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু হতে আহার করো এবং সৎকাজ করো। তোমরা যা করো সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবগত।’ -সূরা আল মুমিনূন: ৫১

তিনি আরও বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদেরকে আমি যে রিজিক দিয়েছি তা হতে পবিত্র বস্তু আহার করো।’ -সূরা আল বাকারা: ১৭২

বর্ণনাকারী বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতে যার মাথার চুল বিক্ষিপ্ত, অবিন্যস্ত এবং সারা শরীর ধূলি মলিন। সে আসমানের দিকে হাত উত্তোলন করে বলে, হে আমার প্রভু! হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য ও পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, তার জীবন-জীবিকাও হারাম। এমতাবস্থায় তার দোয়া কীভাবে কবুল হতে পারে? -জামে তিরমিজি: ২৯৮৯

মৌমাছি কোনো কিছুর ক্ষতি করে না
মৌপোকা যেকোনো ফুলের ওপর বসে না। বরং ফুলের ওপর বসতে গিয়ে তারা প্রথমে লক্ষ্য করে, তারা যদি ফুলের ওপর বসে- তবে ফুলটির কোনো ক্ষতি হবে কিনা? এরপর তারা বিবেচনা করে ফুলের মাঝে মধুর পরিমাণ ও অবস্থা। যদি মধু আহরণ করার উপযুক্ত হয় তাহলে তারা শুধু ফুল থেকে ততটুকু মধু আহরণ করে, যতটুকু গ্রহণ করলে ফুলের পরাগায়ন-গর্ভধারণ এবং ফল ফলাতে কোনো সমস্যা না হয়। এর ব্যতিক্রম হলে মৌমাছিরা শুধু ওড়ে কিন্তু বসে না, বরং অন্য ফুলের কাছে চলে যায়। তেমনি মুমিনরা কারও ক্ষতি করে রিজিক অন্বেষণ করে না। যে সব জায়গায় গেলে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে, সেসব স্থান এড়িয়ে চলে। বরং তারা মানুষের কল্যাণে সর্বদা এগিয়ে আসে। ভালো কাজে উৎসাহ প্রদান করে আর মন্দ কাজ থেকে নিজেও দূরে থাকে ও অন্যকে বাধা প্রদান করে।

সাহাবি হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, ক্ষতি করাও যাবে না, ক্ষতি সহ্যও করা যাবে না। যে অন্যের ক্ষতি করলো আল্লাহ তার ক্ষতি করবেন এবং যে তার সঙ্গে শত্রুতা করবে আল্লাহ তাকে শাস্তি দেবেন। -সুনানে দারা কুতনি: ২৮৮

তারা কর্মঠ ও পরিশ্রমী
মৌমাছি উদ্যমতার সঙ্গে সে তার কাজগুলো করে যায়। কারণ অলসতা উদ্যমহীন ও কর্মবিমুখতা কোনো জাতির উন্নতি বয়ে আনতে পারে না। বরং তা নিজেদের অবক্ষয় ডেকে আনে। তাই মৌমাছি সর্বদা নিজেদের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে। তেমনি একজন মুমিন তার জানমাল, সময় সামর্থ্য দিয়ে উদ্যমতার সঙ্গে কাজ করে যায়। এর দ্বারা সে সফলতার মুখ দেখতে পায়। কারণ পরিশ্রম হলো- উন্নতির অন্যতম সিঁড়ি। যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী সে জাতি তত বেশি উন্নত।

আমানতদার
মৌমাছিরা মধু আহরণ থেকে নিয়ে পৌঁছানো পর্যন্ত পূর্ণ আমানতদারীর সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তারা তাদের রাণীর আদেশ এমনভাবে পালন করে যে, একবিন্দু মধুও তারা তাদের পাকস্থলিতে রাখে না। কখনও তারা মধুকে নিজের সম্পদ মনে করে না। তেমনি একজন মুমিন তার সম্পদ তার কাছে আমানত মনে করে। যত্রতত্র ব্যবহার করে না। নিষিদ্ধ পথে ব্যয় করে না। যে পথে ব্যয় করলে আল্লাহ ও তার রাসূল খুশি হবেন সে পথেই ব্যয় করে। বিলাসিতা ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন করে সম্পদ নষ্ট করে না। -ফয়জুল কাদির: ৫১১

মুফতি জাওয়াদ তাহের: সিনিয়র শিক্ষক, জামিয়া বাবুস সালাম, বিমানবন্দর, ঢাকা- ১২৩০