লোকশূন্য মক্কায় অভুক্ত নেই কবুতরগুলো
পবিত্র হজ কিংবা উমরা পালনের সুবাদে মক্কার মিসফালা এলাকা সবার কাছে বেশ পরিচিত। মক্কা নগরীর অন্য এলাকার তুলনায় স্থানটি সমতল হওয়ায় বাংলাদেশিদের কাছে প্রিয়। তাছাড়া মিসফালায় রয়েছে বাংলাদেশি খাবারের হোটেল, কাঁচা বাজার ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার সুবিধা।
মিসফালা এলাকায় বাংলাদেশি হাজিদের বেশিরভাগ থাকেন হজের সময়। মিসফালার মুন্সিয়াবাজার, কেদুয়া, আল হিজরা রোড, ইবরাহিম খলিল রোড, দাখালা রোড ও হারাতুর রুশদসহ এসব এলাকায় প্রচুর বাংলাদেশি বসবাস করেন। তাই এ এলাকাটিতে মনে হয়, মক্কার বুকে একখণ্ড বাংলাদেশ।
মসজিদে হারামের কাছে সুবিশাল জমজম টাওয়ারের (ঘড়িওয়ালা বিল্ডিং) পেছনের এলাকার নামই মিসফালা। মিসফালায় ইবরাহিম খলিল রোডের শেষ অংশে ছোট্ট মাঠের মতো একটি খোলা জায়গা রয়েছে। সেখানে দিনের বেলা প্রায় সব সময় অসংখ্য কবুতর থাকে। এসব কবুতর কোথা থেকে এসেছে, কেউ জানে না। দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের জালালি কবুতরের মতো। কবুতরের বিচরণ ভূমি হিসেবে ওই জায়গার নাম হয়েছে- কবুতর চত্বর বা কবুতরের মাঠ।
বাংলাদেশ থেকে হজ-উমরা করতে যাওয়া লোকজন সহজ যোগাযোগের জন্য কবুতর চত্বরকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করেন।
তাওয়াফ বা নামাজের জন্য পবিত্র কাবা শরিফে আসা-যাওয়া করা হাজিরা এ কবুতরগুলোর জন্য গম বা খাবার কিনে ছিটিয়ে দেন।
সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো- কবুতর চত্বরসহ এর আশেপাশের এলাকায় কবুতরের রাজত্ব চললেও তারা মসজিদে হারামের দিকে যায় না। তাদের পাশ দিয়ে যাওয়া-আসা করে হাজিরা, তাতেও কোনো সমস্যা নেই। এসব কবুতর তখনও থাকে নির্বিকার, শুধু একটু উড়ে জায়গা বদলায়। কোনো কোনো সময় কাবার জামাত এ এলাকা পর্যন্ত চলে আসে। নামাজেও কোনো ব্যাঘাত ঘটায় না কবুতরের ঝাঁক। তাদের উড়াউড়ি কিংবা বাক-বাকুম আওয়াজ হজযাত্রীদের প্রচুর আনন্দ দেয়।
এসব কবুতর কেউ খান না। তাদের ধরারও চেষ্টা করা হয় না। মক্কার লোকজন তাদের বাসা-বাড়ি কিংবা হোটেলের বাইরে কাঠ দিয়ে বিশেষ ধরনের খাঁচা বানিয়ে রেখেছে। রাতে ওই স্থানে কিংবা পাহাড়ে চলে যায় কবুতরগুলো।
‘দানা লে লো, দানা লে লো,’ ‘দানা দানা, খামছা রিয়াল’ বলে ডেকে ডেকে কবুতর চত্বরে আফ্রিকান ও পাকিস্তানি অনেকে প্যাকেটে করে কবুতরের জন্য বিক্রি করেন গম, যব ও ভুট্টা প্যাকেট। এক দানা (প্যাকেট) তিন রিয়াল, দু’দানা পাঁচ রিয়াল। হজপালনকারীরা এসব কিনে পরম মমতায় খাইয়ে থাকেন কবুতরগুলোকে। অনেকে বিভিন্ন মান্নত করেও কবুতরকে খাওয়ান। তবে বেশিরভাগ মানুষ শখের বশেই খাওয়ান। অনেকে আবার কুসংস্কারবশত কবুতরের খাবার সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন বিভিন্ন উদ্দেশ্যে পূরণের নিমিত্তে।
করোনার কারণে এখন মক্কায় নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া আর কোনো মানুষ নেই। কারফিউর কারণে ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ। তাই কবুতরগুলোকে নিয়মিত খাবার দিচ্ছে মক্কার নিরাপত্তা রক্ষীরা।
সৌদি আরবের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমনই কিছু ছবি ভাইরাল হয়েছে। যে ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মক্কার এক নিরাপত্তারক্ষী পরম মমতা ও উচ্ছ্বাসে কবুতরদের খাবার দিচ্ছেন। তার উচ্ছ্বাস দেখে মনে হচ্ছে, ‘অন্য সময় তো আর তোমাদের খাবার দিতে পারি না মেহমানদের (হজযাত্রী) জন্য, এবার পেলাম সুযোগ। খাও পরম আনন্দে, ভয় নেই। আমরা তো আছি!’
পশু-পাখির প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি খাবারদাবার ও প্রয়োজনে ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, ইসলাম এগুলোকে প্রকৃতি ও পৃথিবীর সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইসলাম ধর্ম মতে, পশু-পাখির সঙ্গে যথাসম্ভব দয়াশীল আচরণ করতে হবে। এদের সঙ্গে যথেচ্ছ ব্যবহার করা যাবে না। পশু-পাখির অঙ্গহানি করা নিষিদ্ধ। এসব ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করাও ওয়াজিব।
নিরাপত্তারক্ষীরা কবুতরগুলোর দেখভাল করে তথা ওদের জন্য খাবারের বন্দোবস্ত করে যেন ইসলামের এই শিক্ষাকেই তুলে ধরছেন। আশা করি, আল্লাহ এই দুর্যোগ থেকে আমাদের মুক্তি দেবেন। হাজিদের পদচারণায় আবার মুখরিত হয়ে উঠবে পবিত্র শহর মক্কা-মদিনা। হাজিদের আশায় যেন কবুতরগুলোও প্রহর গুনছে। হাজিরাও সখ্যতা গড়ে তুলবেন কবুতরগুলোর সঙ্গে। দুর্যোগের মেঘমুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াবে মক্কা-মদিনার কবুতরগুলো।