ঘরে নফল নামাজ কল্যাণ বয়ে আনে

  • ফয়সল আহমদ জালালী, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

নামাজরত মুসল্লি, ছবি: সংগৃহীত

নামাজরত মুসল্লি, ছবি: সংগৃহীত

আমাদের উপমহাদেশের মুসল্লিদের সিংহভাগ মসজিদে সব ধরনের নফল ও সুন্নত আদায়ে অভ্যস্ত। তা ফরজ নামাজের পূর্বের সুন্নত হোক আর পরের সুন্নত। ফরজ আদায়ের পর কেউ বেরিয়ে আসতে চাইলে তাকে রীতিমতো তিরস্কারের সম্মুখীন হতে হয়। অনেকে শাসন করে আর বাধ্য করে মসজিদে সুন্নত আদায়ে। অনেক আলেমকেও নিয়মিত সুন্নত ও নফল মসজিদে আদায় করতে দেখা যায়। শুধু তাই নয়, ফরজ আদায়ের স্থান থেকে সামান্য এদিক-সেদিক হতে রাজি নন- অনেকেই। ফরজ ও শেষ সুন্নতের মাঝে সামান্যতম সময়ের বা স্থানের দূরত্ব অবলম্বন করা হয় না।

অথচ আমরা যেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুকরণে ইবাদত-বন্দেগি করি। তিনি কিভাবে এসব আদায় করতেন সেদিকে তাকানোর প্রয়োজনই মনে করি না।

বিজ্ঞাপন

হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর খিলাফত কাল। একবার তার পাশে জুমার নামাজ আদায় করা মাত্র একজন সুন্নত আদায়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি তাকে বললেন, এরূপ করো না। আমাদেরকে নবী করীম (সা.) আদেশ করেছেন, কথার মাধ্যমে বা মসজিদ থেকে বেরিয়ে গিয়ে উভয় নামাজের মধ্যে তফাৎ সৃষ্টি করতে। -সহিহ মুসলিম: ৮৮৩

সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ফরজ নামাজ আদায়ের পর তোমরা আগে-পিছে বা ডানে-বামে স্থান পরিবর্তন করতে অক্ষম হয়ে যাও? -সুনানে আবু দাউদ: ৮৫৪

বিজ্ঞাপন

ইমাম সাহেবের স্থান পরিবর্তনের জন্য স্বতন্ত্র হাদিস রয়েছে। হজরত মুগিরা ইবনে শোবা (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ইমাম যে স্থানে ফরজ নামাজ আদায় করেছেন, সেখান থেকে স্থানান্তর হওয়া ছাড়া তিনি অন্য নামাজ শুরু করবেন না। -সুনানে আবু দাউদ: ৬১৬. সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৪২৮

বর্তমান সময়ের দুর্যোগ করোনাভাইরাস। এটা থেকে সুরক্ষা লাভের জন্য ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সাধ্যমতো সাবধানতা অবলম্বন করছেন। কোনো কোনো দেশে আজানের পর মসজিদে না এসে ঘরে নামাজ আদায়ের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। এ সম্পর্কে অনেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন, আবার কেউ কেউ প্রমাণ উপস্থাপন করছেন। আল্লাহর ঘর মুসল্লি শূন্য দেখলে আবেগ সামলানো কঠিন। আবার বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের ভয়াবহ অবস্থা দেখলে মনে হয়, সাবধানতা অবলম্বন ছাড়া গত্যন্তর নেই। আল্লাহর গজব আর আজাব এমন অন্ধ যা কোথাও আঘাত হানলে কাউকে ছাড় দেয় না। কে অপরাধী আর কে নিরাপরাধ, কে নিষ্পাপ শিশু আর কে অবলা নারী, এসব বাছ-বিচার করে না।

যারা আজানের পর ঘরে নামাজের ঘোষণা দিচ্ছেন তারা দলিল দিচ্ছেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) দুর্যোগকালে আজানের পর এভাবে ঘোষণা দিতেন। হ্যাঁ, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হতে এরূপ হাদিস বর্ণিত আছে। তবে তা উদ্ভূত সংকটকালে। এটি দীর্ঘ সময়ের জন্য গৃহীত ব্যবস্থা নয়। বাংলাদেশে আমরা এখনও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি। আমরা আল্লাহর অপার দয়ার কাছে আশ্রয়প্রার্থী।

আমাদের প্রতি আহ্বান এসেছে ঘরে সুন্নত আদায় করে মসজিদে যেতে আর ফিরে এসে ঘরে সুন্নত আদায় করতে। উল্লেখ্য যে, মসজিদে যাওয়ার পর সময় থাকলে দু’রাকাত সুন্নত পড়ে বসার কথা জোর দিয়ে বলেছেন প্রিয় নবী (সা.)। আমরা যাকে তাহিয়্যাতুল মসজিদ বা দুখূলিল মসজিদের নামাজ বলে থাকি। এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, সাহাবি হজরত আবু কাতাদা (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে দু’রাকাত নামাজ আদায় করা ছাড়া বসবে না। -সহিহ বোখারি: ১১৬৭, সহিহ মুসলিম: ৭১৪

ঘরে অজু করে সুন্নত পড়ে মসজিদে যাওয়ার পরামর্শটি সুন্দর একটি আহ্বান। এটি শুধু আপদকালীন সমাধান নয়, বলতে গেলে এটিই হলো- হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সার্বক্ষণিক সুন্নত।

এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (সা.) বলেছেন, নামাজের কিছু অংশ তোমরা তোমাদের ঘরসমূহে আদায় করো আর ঘরগুলোকে কবরস্থানে পরিণত করো না। -সহিহ বোখারি: ৪২২, সহিহ মুসলিম: ৭৭৭

উম্মত জননী হজরত আয়েশা (রা.) বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তাকে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নফল নামাজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি বর্ণনা দিলেন, নবী করীম (সা.) আমার ঘরে জোহরের পূর্বে ৪ রাকাত পড়ে মসজিদে রওয়ানা করতেন আর মসজিদে গিয়ে মুসল্লিদের সঙ্গে ফরজ নামাজ আদায় করে আবার ঘরে ফিরে এসে দুই রাকাত পড়তেন। তিনি মানুষের সঙ্গে মাগরিবের নামাজ আদায় করতেন অতঃপর ঘরে ফিরে দু’রাকাত পড়তেন। মানুষের সঙ্গে ইশার নামাজ আদায় করে ঘরে ফিরে দুই রাকাত পড়তেন...। –সহিহ মুসলিম: ৭৩০

উল্লেখ্য, নফল মানে অতিরিক্ত। ফরজ এবং ওয়াজিব ছাড়া বাকি সব সুন্নতও মুস্তাহাব নামাজকে হাদিস ও ফিকহের গ্রন্থাদিতে নফল নামাজের অধ্যায়ের অধীন করা হয়েছে। যদিও আমাদের সমাজে নফল বলতে স্বতন্ত্র কিছু ইবাদতকে বুঝানো হয়। এগুলো মূলত মুস্তাহাব আমল।

ঘরে নফল নামাজ কল্যাণ বয়ে আনে
আল্লাহর ইবাদত-আনুগত্য যেখানে করা হয়, সেখানে রহমতের ফেরেশতারা আসা যাওয়া করেন। এতে সেখানে কল্যাণ নেমে আসে। হজরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ নামাজ আদায় করলে ঘরে আদায়ের জন্য একটি অংশও যেন সে রেখে দেয়। কারণ আল্লাহতায়ালা নামাজের ফলে তার ঘরে কল্যাণ দান করবেন। -সহিহ মুসলিম: ৭৭৮

আল্লামা নাওয়ারি বলেন, নিয়মিত নফল (পাঁচ ওয়াক্তের সুন্নত) নামাজসমূহ ঘরে আদায় করা জমহুর উলামার মতে মুস্তাহাব। এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। -শারহু মুসলিম: ঌ/৬

আল্লামা মানাবি বলেন, নফল নামাজ মসজিদে আদায় করা থেকে ঘরে আদায় করা উত্তম। তা মসজিদে হারামে হলেও। -ফয়জুল কাদির: ১/৪১৮

বিখ্যাত ফিকহবিদ ইবন কুদামা বলেন, নফল নামাজ ঘরে আদায় করা উত্তম। এ কারণে যে, এতে ইখলাস বা একনিষ্ঠতা উত্তমরূপে হাসিল হয়। রিয়া বা প্রদর্শনীর মানসিকতা থেকে পরিত্রাণ লাভ হয়। -আল মুগনি: ১/৪৪২

লেখক: মুহাদ্দিস ও ভিজিটিং ইমাম নিউ ইয়র্ক ঈদগাহ