দান-খয়রাত করে দোয়া চাওয়া প্রসঙ্গে
আমরা অনেক সময় ভিক্ষুক বা কোনো অভাবগ্রস্ত মানুষকে কিছু দিয়ে বলি, ‘আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’ এভাবে দোয়া চাওয়া নিয়ে মতভেদ রয়েছে ইসলামি স্কলারদের মাঝে।
এমনটি বলা নানাদিক থেকে ক্ষতির কারণ। কারণ তখন ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায়, আপনি দানের বিনিময়ে তার থেকে দোয়া ক্রয় করলেন! তাহলে দানের প্রতিদান তো ভিক্ষুকের কাছ থেকেই নিয়ে নিলেন; আল্লাহর কাছ থেকে আর কী প্রত্যাশা করেন?
আম্মাজান হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একটি ভেড়া উপহার দেয়া হলে, তিনি বলেন, এটি বণ্টন করে দাও। খাদেম ফিরে এলে হজরত আয়েশা (রা.) তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তারা কী বলল? খাদেম জানান, তারা বলেছে, বারাকাল্লাহু ফিকুম (আল্লাহ আপনাদের বরকত দিন)। তখন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ওয়া ফিহিম বারাকাল্লাহ (আল্লাহ তাদের বরকত দিন)। হজরত আয়েশা (রা.) আরও বলেন, তারা যা বলেছে আমরাও তাদের অনুরূপ বলে দিচ্ছি। আর আমাদের সওয়াব তো আমাদের থাকছেই।
ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, আমাদের কাছে এ মর্মে সংবাদ পৌঁছেছে যে, দান-সদকার ক্ষেত্রেও তিনি অনুরূপ বলতেন।
হাদিসটিতে লক্ষ্য করুন, হজরত আয়েশা (রা.) বা তার খাদেম কিন্তু ভিক্ষুককে এটি বলেননি যে, তুমি আমাদের জন্য বরকতের দোয়া করো, বরং ভিক্ষুক স্বেচ্ছায় দোয়া করেছে। তবুও হজরত আয়েশা (রা.) তার দোয়া তাকেই ফেরত দিয়ে দিয়েছেন, যাতে আখেরাতে দানের প্রতিদানে কোনো কমতি না আসে।
আর আমরা কী করি, কোনো কিছু দিলেই ভিখারীর কাছে দোয়া চেয়ে বসি!
তবে হ্যাঁ, স্বাভাবিকভাবে যে কারও কাছেই দোয়া চাওয়া যায়, এতে কোনো সমস্যা নেই। ভিক্ষুকের কাছেও চাওয়া যায়। তবে, দানের পর দোয়া চাওয়াটা এক ধরনের বিনিময় চাওয়ার মতোই হয়ে যায়। তাই, এটা পরিহার করাই উত্তম।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হাদিসে বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন যে সাত শ্রেণির লোক আল্লাহর ছায়ার নিচে আশ্রয় পাবে, তাদের অন্যতম হলো- যে ব্যক্তি ডান হাতে দান করে, অথচ বাম হাত টের পায় না।’
অন্যদিকে জান্নাতি বান্দাদের দুনিয়ার বৈশিষ্ট্য বলতে গিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য মিসকিন, এতিম ও কয়েদিদের খাদ্য দান করে থাকে।’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, তারা বলে, আমরা কেবল আল্লাহর চেহারা অন্বেষণের জন্য তোমাদের খাদ্য দান করে থাকি। আমরা তোমাদের নিকট থেকে কোনো প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না। তবে যাকে বা যে প্রতিষ্ঠানে সদকা করা হলো, তাদের উচিৎ দানকারীর জন্য দোয়া করা। -সূরা তওবা: ১০৩ (আয়াতের ভাবার্থ)
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তোমাদের কোনো উপকার করলো, তোমরা তাকে উত্তম বিনিময় প্রদান করো, সক্ষম না হলে অন্ততঃপক্ষে তার জন্য দোয়া করো, যাতে সে বুঝতে পারে যে, তোমরা তাকে উপযুক্ত উপঢৌকন প্রদান করেছো।’ -সুনানে আবু দাঊদ: ৫১০৯
যেমন হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) দোয়া করে বলতেন, বারাকাল্লাহু লাকা ফি আহলিকা ওয়া মালিকা অথবা বহুবচনে ‘কুম।’ অর্থ আল্লাহ আপনার জন্য আপনার পরিবারে ও সম্পদে বরকত দান করুন। -সহিহ বোখারি: ৩৭৮০
আর মুমিনদের পরস্পরে দোয়া চাওয়া জায়েজ। যেমন হজরত সাফওয়ান (রা.) বলেন, আমি শামে গেলাম আবু দারদা (রা.)-এর সাক্ষাতের জন্য। কিন্তু তিনি ওই সময় বাড়িতে ছিলেন না। তখন উম্মু দারদা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি হজে যাবে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, আমাদের জন্য কল্যাণের দোয়া করো। কেননা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলতেন, ‘কোনো মুসলমান কারও জন্য তার পেছনে খালেস মনে দোয়া করলে, সে দোয়া কবুল হয়। সেখানে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত থাকে। যখনই ওই ব্যক্তি তার ভাইয়ের জন্য দোয়া করে, তখনই উক্ত ফেরেশতা বলে আমিন। তোমার জন্যও অনুরূপ হোক। -সহিহ মুসলিম: ২৭৩৩
তবে দোয়া কোনো মৃত ব্যক্তির নিকট চাওয়া হারাম। আর যদি কোনো জীবিত ব্যক্তির কাছে দোয়া চাওয়ার মধ্যে তার ওপরে ভরসা করা হয়, তবে সেটাও নিষিদ্ধ। যদি এই বিশ্বাস করা হয় যে, তার দোয়া কবুল হবেই, সেটাও নিষিদ্ধ। সর্বাবস্থায় ভরসা ও প্রার্থনা কেবলমাত্র আল্লাহর কাছেই করতে হবে।